শরৎ এলেই কানে আসে ঢাকের বাদ্যি৷ দুর্গা মায়ের (Durga Puja ) আগমনী ডাক। ধর্মতত্ত্বের আঙিনা ছাড়িয়ে সেই কতকাল আগেই বঙ্গজীবনের সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে উঠেছে এই দুর্গাপুজো।
ক্যাটাগরি আমার পুজো
মা কাঁদছেন, বিসর্জনের সুর ছুঁয়ে যায় অভাগী মেয়ের আত্মকথন…
মেঘ পিওন ব্যাগে করে সবসময় যে কেন এত দিস্তা দিস্তা মন খারাপ নিয়ে আসে কেই বা জানে। হয়তো এই মন খারাপের মধ্যেই ভাল থাকার পাসওয়ার্ডের চাবি মিলতে পারে। না না আজ আর কাব্য নয়। এক সপ্তাহের ধুমধাম সেরে ঝলমলে চন্দননগর যেন আজ রাতভর অন্ধকারে ডুবে থাকবে। প্রবল বেগে বাংলা অভিমুখে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় বুলবুল যে পূর্বভাস দিচ্ছে, তাযেন এই মন খারাপের সঙ্গে মানিয়ে যাওয়া বেহাগ। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর কাজের বাড়ি থেকে ফিরতেই বেলা গিয়েছে। আজ ডায়মন্ড হারবার লোকালের ভিড়টার কথা মনেই করতে চাইল না শ্যামা। কিন্তু ভিড়ের মাঝে আলো ছড়িয়ে বসে থাকা অমন সুন্দর মুখখানি যে সে ভুলতেই পারছে না।
বিদায় বেলায় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রায় চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী, রাতভর যেন রূপকথার জাল বোনে গঙ্গার পাড়ের এই শহর
সকাল থেকেই মনে যেন বিদায়ের সুর। বুধবার বেলাতেই দশমী তিথি শুরু হয়ে গিয়েছে। বনেদি বাড়ির ঠাকুর বিসর্জন হয়ে গিয়েছে গতকালই। এবার নজরে বারোয়ারি, এসে গেল বিদায়ের ক্ষণ। এবছরের মতো জগ্ধাত্রীকে বিদায় জানাতে সেজে উঠেছে চন্দননগর। সেখানকার বারোয়ারির প্রতিমার শোভাযাত্রা নজর কাড়া। হেলাপুকুর ধার থেকে শুরু করে আদি মা, তেঁতুল তলা, অম্বিকা, খলিসানি, কলপুকুর ধরা, কলুপুকুর, বাগবাজার। কাকে ছেড়ে কার কথা বলি। প্রত্যেক বারোয়ারির তরফেই লরি ভাড়া করে তার উপরে প্রতিমা তোলা হয়। এরপর চলে সাজগোজ। জগদ্ধাত্রীকে দেখতে তখন কাতারে কাতারে লোক নেমেছে চন্দননগরের রাস্তায়। জমকালো বিদায়বেলা নাহলে কী মানায়? এই আনন্দের অবসরেই যেন নিরঞ্জনের দুঃখ লুকিয়ে আগামী বছরের জন্য দিন গুনতে শুরু করে চন্দননগর।
চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী প্রতিমার কাঠামো পুজো হয় দুর্গা দশমীতে, পুজোর কয়েকদিনের অনুভূতি অসামান্য
শরৎকালের আকাশ দেখতে পেলে খুশিতে মনটা ভরে ওঠে না, এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া দুস্কর। শরৎ এল মানেই কাশের দোলায় মন ভুলিয়ে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভাসিয়ে সে আসবে। আরে তাকে তো চেনোই, আমাদের দুগ্গা মা। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে আশ্বিনের শারদ প্রাতে শোনার পর আর কাজকর্মে মন বসে না। মনে হয় সবকিছুতে তালা ঝুলিয়ে এখন শুধু মনের সুখে ঘুরে বেড়াই। ছেলেমেয়েকে সঙ্গে করে উমা এল বলে। কলকাতার দুর্গাপুজো তো বহুকাল হল মহোৎসবের আকার নিয়েছে। আর গঙ্গা পাড়ের একদা ফরাসী কলোনি চন্দননগরে? মা দুগ্গা সেই নগরে খুশির বার্তা বয়ে আনলেও আলোর বার্তার জন্য জগদ্ধাত্রীর পথ চেয়েই চন্দননগরের দিন কাটে।
‘আলো নিয়ে চন্দননগর আজ যা ভাবছে, গোটা দেশ তা ভাববে আগামী বছর’
রাত পোহালেই নবমী তিথি, ইতিমধ্যেই জগদ্ধাত্রীর আরাধনায় জমজমাট চন্দননগর। প্রতিমা থেকে মণ্ডপ সবেতেই কে কাকে ছাড়িয়ে যাবে তানিয়ে চলছে সুস্থ প্রতিযোগিতা। আর এর মাঝেই নিজেদের স্বকীয়তা প্রমাণে শৈল্পিক স্বাক্ষর রাখছেন চন্দননগরের আলোকশিল্পীরা। সারা বছর ধরে একটু একটু করে ভাবনাকে পুঞ্জীভূত করেন, আর পুজো এলেই তাইই আলোক মালায় ফুটিয়ে তোলেন। আগে টুনিতে হাতেকলমে কাজ করতে অনেক সময় যেত। খরচও হত প্রচুর। এখন এলইডি সেই খরচকে কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সেদিনের চ্যালেঞ্জটাই যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছে। চন্দননগরের প্রসিদ্ধ আলোশিল্পী সুজিত মাজী, Bongmag.com-এ একান্ত আলাপচারিতায় শোনালেন নিজের কথা।
দেবী মূর্তিকে স্বপ্নে দেখে জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু করেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র, কেন জানেন?
জগদ্ধাত্রী শব্দের আভিধানিক অর্থ জগৎ+ধাত্রী অর্থে জগতের ধাত্রী। ব্যপ্ত অর্থে দূর্গা, কালী-সহ অন্যান্য শক্তির দেবীও জগদ্ধাত্রী। তবে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন তুলনামূলক আধুনিককালে ঘটে| অষ্টাদশ শতকে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় তাঁর রাজধানী কৃষ্ণনগরে এই পূজার প্রচলন করার পর এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়| যদিও দেবী জগদ্ধাত্রী যে বাঙালি সমাজে একান্ত অপরিচিত ছিলেন না, তার প্রমাণ পাওয়া যায়| শূলপাণি খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতকে ‘কাল বিবেক’ গ্রন্থে কার্তিক মাসে জগদ্ধাত্রী পুজোর উল্লেখ করেন| পূর্ববঙ্গের বরিশালে খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে নির্মিত জগদ্ধাত্রীর একটি প্রস্তর মূর্তি পাওয়া যায়| বর্তমানে এই মূর্তিটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ সংগ্রহশালার প্রত্ন বিভাগের রক্ষিত| রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকালের আগে নির্মিত নদীয়ার শান্তিপুরের জলেশ্বর শিব মন্দির ও কোতোয়ালি থানার শিব মন্দিরের ভাস্কর্য জগদ্ধাত্রীর মূর্তি লক্ষিত হয়|
রবিবার বিকেল থেকে গোটা রাত চন্দননগর হয়ে যাক, রইল জগদ্ধাত্রী পুজোর রুট ম্যাপ
জগৎমাতা জগদ্ধাত্রী এখন চন্দননগরের অঙ্গনে, আলোর মালায় সেজে তাঁকে অভ্যর্থনা করতে তৈরি গঙ্গার পাড়ের একদা এই ফরাসী কলোনি। আজ রবিবার সপ্তমী, স্নান খাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নিয়েই বেরিয়ে পড়া যাবে। গতকাল শনিবার ষষ্ঠী ছিল, এদিন থেকেই শহরজুড়ে প্রতিমা দর্শনে উপচে পড়েছে ভিড়। রবিবার ছট পুজো থাকায় রাজ্য সরকার সোমবার ছুটি ঘোষণা করেছে। তাই আরও একটি দিন হাতে পাওয়া গেলে মনে হয় পড়ে পাওয়া ১৪ আনা। এখন শুধু এই ১৪ আনার সদ্ব্যবহার করাটাই জরুরি। কিন্তু বাইরে থেকে আসছেন যখন, তখন তো কীভাবে এই দুদিনে চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর পরিক্রমা সম্ভব হবে তার তো একটা প্রাথমিক খসড়া প্রয়োজন। bongmag.com আপনাকে সেই পথের দিশাই দেখাতে চলেছে।
ইতিহাসের মুহূর্ত ছুঁয়ে জগদ্ধাত্রী পুজোয় চন্দননগরের ইতিকথা
চন্দননগর নামটা শুনলেই দুটো তিনটে জিনিস প্রথমেই মনে আসে, এক ফরাসী কলোনি, দুই জগদ্ধাত্রী পুজো, তিন আলোকসজ্জা। জগদ্ধাত্রী পুজোর জন্য সুবিখ্যাত হুগলি জেলার গঙ্গার পাড়ের এই শহর। তবে বিখ্যাত হওয়ার পিছনেও রয়েছে একটা লম্বা চওড়া ইতিহাস। একবার সেই ইতিহাসের অঙ্গনে চোখ রাখি। লোকমুখে প্রচারিত আছে যে ফরাসী সরকারের দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী এই পুজোর প্রবর্তক| এ কথা বহুল প্রচলিত যে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র আর ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর মধ্যে সখ্যতা ছিল| এক বার কৃষ্ণচন্দ্রের বাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজো দেখে পরের বছর ইন্দ্রনারায়ণ চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জ চালপট্টির নিচুপট্টিতে জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা করেন, এটিও চন্দননগরের আদি পুজো বলে পরিচিত| এখনও পর্যন্ত পুরুষানুক্রমে দেওয়ান চৌধুরীদের উত্তরপুরুষের নামে এই পুজোর সংকল্প হয়| তাই অনেকেই মনে করেন, ইন্দ্রনারায়ণের মাধ্যমে কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজো চন্দননগরে প্রবেশ করেছিল|
রাত পোহালেই দেবীপক্ষ, দুর্গা ফিরছে দূর গাঁয়…
ওহ এক কাপ চা না হলে আর চলছে না, বৃষ্টিতে কাক স্নান করে ফিরতে ফিরতে নমিতার একথাটাই মনে হচ্ছিল। আকাশের যা অবস্থা তাতে সারাদিনে বৃষ্টি ধরবে বলে তো মনে হচ্ছে না। থেকে থেকে আবার গুড় গুড় করে ডেকে উঠছে। একেবারে আষাঢ়ে বৃষ্টি যাকে বলে তাই, আর মাত্র একটা দিন তারপরেই বীরেন ভদ্রর কণ্ঠে আপামর বাঙালির ঘরে বেজে উঠবে ‘আশ্বিনের শারদ প্রাতে…’, তার আগে একি বৃষ্টি শুরু হল বল দেখি। বারান্দায় উঠে তড়িঘড়ি আলোটা জ্বালিয়ে দিল, গেল বর্ষায় বেড়াগুলো ভেঙেছে। এই শীতের মধ্যে না পাল্টালে আর রক্ষে নেই। বাড়ি ফিরে দেখবে পাড়ার পোষ্যরা সব জটলা পাকাচ্ছে। সারা মেঝেটাই পিচ্ছিল হয়ে আছে। এঃহে চুল থেকে জল পড়ছে। এই বেলা স্নান না করলে পুজোর আগেই একটা অসুখে পড়বে। ছাতাটাও ফুটো হয়েছে, আর সেলাই করা যাচ্ছে না, লক্ষ্মী টাকাটা দিলে আগে একটা ছাতা কেনা, বাকিটা পড়ে দেখা যাবেখন।
কাশের বনে লাগল দোলা, উমা আসে বাপের বাড়ি…
সুহিতা অফিস থেকে ফেরার পথেই সেই ফোনটা পেয়েছিল। প্রতিবার পুজো এলে এই ফোনের অপেক্ষাটা সে করে, এবারও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। তাইতো আজ তাড়াতাড়ি বেরিয়েছে, মণি স্কয়্যার মলের সামনে শাশ্বত তার অপেক্ষায় আছে। তারপর দুজনে মিলে একটু খাওয়াদাওয়া আর কেনাকাটা। মধ্যবিত্ত মানসিকতাকে লালন করে চলা সুহিতা আজ শপিংমল থেকেই জামাকাপড় কিনবে, এই বিলাসিতা তার ভালবাসা, অহঙ্কার নয়। ওই তো শাশ্বত, বাস থেকে নেমে তড়িৎ গতিতে এগিয়ে যায় সে। একবছরে তেমন বদল না হলেও বেশ স্বাস্থ্য হয়েছে ছেলেটার, নিজে যে মুটিয়ে যায়নি তা নয়। তবে শরীরচর্চার মধ্যে থাকায় ততটা বোঝা যায় না। আজই তো বাসে এল, নাহলে অফিস থেকে ফেরার সময় সল্টলেক থেকে হেঁটে ফুলবাগান চলে আসে।