Kashful

রাত পোহালেই দেবীপক্ষ, দুর্গা ফিরছে দূর গাঁয়…

ওহ এক কাপ চা না হলে আর চলছে না, বৃষ্টিতে কাক স্নান করে ফিরতে ফিরতে নমিতার একথাটাই মনে হচ্ছিল। আকাশের যা অবস্থা তাতে সারাদিনে বৃষ্টি ধরবে বলে তো মনে হচ্ছে না। থেকে থেকে আবার গুড় গুড় করে ডেকে উঠছে। একেবারে আষাঢ়ে বৃষ্টি যাকে বলে তাই, আর মাত্র একটা দিন তারপরেই বীরেন ভদ্রর কণ্ঠে আপামর বাঙালির ঘরে বেজে উঠবে ‘আশ্বিনের শারদ প্রাতে…’, তার আগে একি বৃষ্টি শুরু হল বল দেখি। বারান্দায় উঠে তড়িঘড়ি আলোটা জ্বালিয়ে দিল, গেল বর্ষায় বেড়াগুলো ভেঙেছে। এই শীতের মধ্যে না পাল্টালে আর রক্ষে নেই। বাড়ি ফিরে দেখবে পাড়ার পোষ্যরা সব জটলা পাকাচ্ছে। সারা মেঝেটাই পিচ্ছিল হয়ে আছে। এঃহে চুল থেকে জল পড়ছে। এই বেলা স্নান না করলে পুজোর আগেই একটা অসুখে পড়বে। ছাতাটাও ফুটো হয়েছে, আর সেলাই করা যাচ্ছে না, লক্ষ্মী টাকাটা দিলে আগে একটা ছাতা কেনা, বাকিটা পড়ে দেখা যাবেখন।



বারান্দার এক কোণে ছাতাটাকে মেলে দিয়ে সোজা স্নানঘরে চলে যায় নমিতা। এর মধ্যে ভটচাযদের বড় ঘড়িতে ঢং ঢং করে সময় জানান দিল, কলঘরের জলের শব্দে তা নমিতার কানে পৌঁছায়নি। সে কতকাল আগের কথা, শ্রাবণেই বিয়ে হয়ে এবাড়িতে পা রেখেছিল নমিতা। তারপর গঙ্গা দিয়ে কত জল গড়িয়ে গিয়েছে। সংসারে তখন দেওর, ননদ, খুড় শ্বশুর, শ্বাশুড়ি মিলিয়ে একবাড়ি লোক, এই ছোট্ট বাড়িটিতেই বেশ কুলিয়ে যেত। এত লোকজনকে দেখে প্রথমে বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিল নমিতা, তবে দিলদরিয়া শ্বশুরমশাই কখনওই তাকে ভয় পেতে দেননি। হাসি মজায় সবসময় মাতিয়ে রাখতেন। লোকেশ কোলিয়ারিতে কাজ করতেন ১৫ দিন অন্তর তাঁর দেখা পেত নমিতা, শাশুড়ি হেমাঙ্গিনী ও শ্বশুর ঠাকুরের অভিভাবকত্বে বেশ দিন কাটছিল। চোখের সামনে দেওর পড়াশোনা শেষ করে চাকরিবাকরিও শুরু করল। মোটামুটি স্বচ্ছল সংসার নিয়ে মজুমদারবাড়ি যেন কানায় কানায় ভরে থাকত। সহদেব মজুমদার ইংরেজ আমলে ছাপাখানায় বড় পদে চাকরি করতেন। তারপর অবসর নিয়েছেন, পেনসনের টাকা আর বড় ছেলে লোকেশর উপার্জনে বেশ চলে যায়। ছোটজন স্বদেশ, সে চাকরি পেতেই হেমাঙ্গিনীর খুশি আর ধরে না, এবার লিলির বিয়ের তোরজোর করতে হবে। মাস পয়লা বেতন এনে স্বদেশ মায়ের হাতে দিতেই বণিকবাড়িতে গয়না গড়াতে গেলেন হেমা্ঙ্গিনী, মুখে তাঁর চওড়া হাসি। ভাগ্যলক্ষ্মীও তখন অলক্ষ্যেই হেসেছিলেন, রান্নার ঠাকুরকে সমস্ত বুঝিয়ে দিয়ে আশাপূর্ণাদেবীর একখানা গল্পের বই নিয়ে আয়েশ করে পড়া শুরু করেছে নমিতা, মানুষটা এখনও বাড়ি এল না, আর কদিন পরেই পুজো। বলেছিল দেরি হবে, কিন্তু সুখবরটা যে তাকে না দিয়ে সে থাকতেই পারছে না। বউমা বাবু কবে আসবে তারিখটা জানিয়েছিল? সহদেববাবু খবরের কাগজখানা ভাঁজ করে রাখতে রাখতে রাখতেই হাঁক পাড়েন, ব্যস্তসমস্ত নমিতা মাথা হেলিয়ে উত্তর দেয়। মেয়েটা বড় ভাল, বছর খানেক হল এবাড়ির বউ হয়ে এসেছে শখ আহ্লাদের লেশমাত্র নেই, বাবুটাও তেমন। পুজোর আগে কদিন মেয়েটাকে নিয়ে কোথাও বেরিয়ে আসবে কিনা। এবার ফিরলে খুব করে বকে দেবেন। রাতেই আসানসোল থেকে তার এসে পৌঁছায়, স্বদেশ অফিস থেকে ফিরছিল, পোস্টমাস্টার কাকা তাকেই তারখানা গচিয়ে কেটে পড়েছেন। বাড়িতে এসে জলখাবার খেয়ে ক্লাবে ছুটেছে সে, তারখানা তখনও পড়ে বিছানায়। সন্ধ্যা দিতে এসে নমিতারই প্রথম নজরে পড়ে, আসানসোলের তার। তাড়াতাড়ি খুলতেই চোখের সামনে দুলে ওঠে পৃথিবীটা, খাদানে ধস নেমেছে, তখন ইন্সপেকশন চলছিল, খাদান শ্রমিকদের সঙ্গে ছিলেন অফিসাররাও পুরো দলটাই খনিগর্ভে তলিয়ে গিয়েছে চারদিন হল। বিস্তর খোঁজাখুঁজি চললেও কাউকেই উদ্ধার করা যায়নি। এই ঘটনায় কর্তৃপক্ষ দুঃখিত, তবে ক্ষতিপূরণ হিসেবে এককালীন টাকা লোকেশবাবুর পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হবে। বউদি বউদি, এই শাড়িটা তোমার জন্য আনল মা, দেখবে এসো। আরে গেলে কোথায় প্রায় উড়তে উড়তে ঘরে ঢুকল লিলি, কিছুতে পা পড়েছে বুঝতে পেরেই জিভ কেটে দূরে সরে যায়। আলো জ্বালাতেই দেখে মেঝেতে পড়ে অচেতন নমিতা।



পাড়ার ডাক্তারবাবু এসেছিলেন, বাড়িতে যে বংশপ্রদীপ আসছে তার খবর দিয়ে গেলেন, খুশির রোল উঠল। এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি ফিরল স্বদেশ, বাবাকে দাদার তারের খবরটা দেওয়া হয়নি, ঘরে ঢুকে বিছানা হাতড়ে সেখানা না পেয়ে সোজা বউদির ঘরে জিজ্ঞাসা করতে গেল। কাকা হতে চলেছে সে, কিন্তু বউদির মুখটা এত শুকনো কেন, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে নাকি। অ্যাজমা নয়তো, সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে মাথার কাছে বসতেই নজরে এল বউদির ডানহাতের মুঠিতে ধরা সেই তার, হাত ধরতেই খসে পড়ল, বউদি ফের জ্ঞান হারালেন। হতবাক স্বদেশ তারটি পড়া শুরু করতে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। আরে মিষ্টিমুখ কর পরে অন্যকথা, সুখী বাবার মুখটাকে অন্তরে গেঁথে ফেলল স্বদেশ, দাদা আর ফিরবে না বাবা। কী, সে আজ রাত হয়েছে কাল তো ফিরবে, তখন নাহয় তাকে সুখবরটা দিস। তর্কে না গিয়ে টেলিগ্রামের কাগজটা বাবার হাতে দিয়ে বেরিয়ে পড়ল স্বদেশ। এক ধাক্কায় যেন তাসের ঘরের মতো হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল মজুমদারবাড়ি। বছর ঘুরতেই কোল আলো করে আসা নয়নাকে দেখে হেমাঙ্গিনী খুশি হতে পারেননি, পাড়ার একটি বেসরকারি স্কুলে পড়ানোর কাজ নিয়েছে নমিতা। মেয়েটাকে তো মানুষ করতে হবে। স্বদেশের পদোন্নতি হয়েছে, অশৌচের দোহাই দিয়ে রেজিস্ট্রি বিয়ে করে ফিরল। লিলিটার কথা কারোর মাথাতেই এল না। সহদেববাবু নাতনিকে নিয়ে সময় কাটান। হেমাঙ্গিনী কেমন খিটখিটে হয়ে আছেন, সাতদিনের জ্বরে তিনিও চলে গেলেন। স্কুল, ঘরকন্না সামলে শ্বশুরের দিকে আর তেমন নজর দেওয়াই হয় না। কলকাতা থেকে বেশ দূরের পথ সোনারপুর নিত্য যাতায়াতে কষ্ট হচ্ছে, এই বলে বউকে নিয়ে শহরে চলে গেল স্বদেশ। একদিন স্কুল থেকে ফিরে প্রতিবেশী রায়গিন্নির কাছে নমিতা খবর পেল লিলি পালিয়েছে। চার বছরের বিবাহিত জীবনে একের পর এক ঝড়, মজুমদারবাড়িতে সেদিন আর শাঁখ বাজল না। রবিবার ডাক্তারকাকা এসে দেখে গেলেন বাবাকে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে বললেন ভাল বুঝছি না বউমা, মাথার কোনও সমস্যা হয়েছে। লিলি চলে যাওয়ার পর বাবার কাছেই মেয়েকে রেখে স্কুলে যাচ্ছিল নমিতা, সেদিন হঠাৎ করেই প্রিন্সিপালের ঘরে ডাক পড়ল, সেখানে মেয়েকে কোলে নিয়ে রায়গিন্নি বসে আছেন। বাবা নাকি কোথায় বেরিয়েছেন সেই সকালে, দুপুর নামলেও ফেরেননি। মেয়েটা খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাই মায়ের কাছে নিয়ে এসেছেন, সেদিন সাততাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল নমিতা। সারারাত বসে থেকেও বাবা ফিরলেন না, পরের দিন আর স্কুলে যাওয়া হল না। ভটচায গিন্নি বললেন থানায় ডায়রি করো বউমা, সন্ধ্যাবেলা ক্লাবের ছেলেরা বাবাকে দিয়ে গেল, চম্পাহাটিতে নাকি বসেছিল দিল্লির ট্রেন ধরবে বলে।



রাত বাড়তেই পাড়ার সকলে বিদায় নিল, রান্নাঘরের দরজা দিতে গিয়ে নমিতা স্পষ্ট শুনল রায়গিন্নি বলছেন, সোমত্ত মেয়েমানুষ ওই দুধের বাছাকে নিয়ে কোথায় যাবে। বুড়োটা মলে তো চিল শকুনে ছিঁড়ে খাবে। দিনদুয়েক বাদে সহদেববাবু একটু সুস্থ হতেই নমিতাকে স্কুল ছুটি নিতে বললেন, বাড়ি বিষয় আশয় বলতে যা ছিল সব বউমার নামে উইল করে দিলেন, স্বদেশের নামটা একবার তোলার চেষ্টা করেছিল নমিতা, সাফ জানালেন যে অসহায় পরিবারকে ফেলে নিজের স্বার্থ বুঝে নেয় তার দায়ভার সহদেব মজুমদারের নয়। এরপর আর বেশিদিন বাঁচেননি বাবা। মেয়ের কথা ভেবে স্কুলে চাকরিটা ছেড়ে একটা ফাস্টফুডের দোকান দিয়েছে নমিতা, শতচক্ষুর লোলুপ দৃষ্টির সামনে দিয়েই একাহাতে মেয়েকে বড় করেছে। দূরে কোথায় বাজ পড়ল, উফ! আজকাল কী হয়েছে, শুধু পুরনো কথা এসে মাথায় জেঁকে বসছে আর কাজকর্ম সব ভুলে যাচ্ছে সে। কখন চানঘরে ঢুকেছিল এবার তো শুকনো কাপড় দরকার নাহলে নিউমোনিয়া হয়ে যাবে। নয়নাটা জানতে পারলে আর রেহাই নেই। মেয়ে এখন সমাজবিদ, উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন সফল হয়নি, মেয়েক দিয়ে সেই সাধ মেটাচ্ছে নমিতা। আগে পাড়ার লোকজন করুণার দৃষ্টিতে দেখত, এখন সেসব চোখে সমীহ। টোএফেল দিয়েছে, আসছে ডিসেম্বরে ইউরোপ চলে যাবে, না না একা হওয়ার কোনও ভাবনা নেই নমিতার। কতকাল হয়ে গেল তো একাই আছে। কতকালই বটে, ২৫টা বছর। নাহ এবার দোকানে যেতে হবে, বৃষ্টিটা তেড়ে আসার আগেই। নমিতার ৪৪, চুলে পাক ধরেনি এখনও। সময়ও তার নেই, পাড়ার অসহায় মেয়েদের নিয়ে একটা সেলাইয়ের স্কুল খুলেছে, দোকানের পর অবশিষ্ট সময় সেখানেই কাটে। একটা এনজিও এবার ফান্ডিংয়ের দায়িত্ব নিতেই বেশ খুশি, এই কৃতিত্ব মেয়ের। পুজোর আনন্দে স্কুল ছুটি। এদিকে ফোনেই আবদার এসেছে,  মা চুনো মাছের ঝাল চচ্চড়ি আর গুড়ের পায়েস খাব। মেয়ের বায়না মনে পড়তেই চাল ভিজিয়ে দিল নমিতা। দেবীপক্ষে তার ঘরেও যে দুগ্গা আসছে, এটুকু আয়োজন যে করতেই হয়।

Facebook Comments Box

Post Author: bongmag

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।