শিবের (Sandeswartala) জটা থেকে যার উৎপত্তি, তার বাঁকে বাঁকে ইতিহাস প্রহর জাগবে এটাই তো স্বাভাবিক। সমগ্র হিমাচল, উত্তরপ্রদেশ, বিহারকে একসূত্রে বাঁধার পর রাজমহল থেকে ভিন্ন নামে বাংলার কণ্ঠহার হয়ে বিরাজ করছে গঙ্গা। পশ্চিমবঙ্গের ভাগীরথী। তীর ধরে যতোই এগোবেন ইতিহাস ও লোকাচারের এক নতুন অধ্যায় ততই চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠবে। কালের নিয়মে প্রাচীনত্বের ধুলো পড়লেও সেসবের আদি অকৃত্রিম ভাব এতটুকুও নষ্ট হয়নি। তবে সংরক্ষণের সময় কিন্ত চলে যাচ্ছে। এমন আদরণীয় ইতিহাসের অংশ হল হুগলির ষণ্ডেশ্বরতলা (Sandeswartala)।
Sandeswartala: ষণ্ডেশ্বরতলার ইতিকথা
প্রায় ৫০০ বছর আগের কথা। অবিভক্ত বঙ্গদেশে ভাগীরথীর তীরে তখনও ডাচ নগরী গড়ে ওঠেনি। আর সমগ্র হুগলি ছিল নিতান্তই এক পল্লী বাংলার গ্রাম। বনাঞ্চলে ঢাকা ছিল বেশিরভাগ জায়গা। সেই গ্রামের দক্ষিণ পূর্ব কোণে ভাগীরথী লাগোয়া এলাকায় ছিল বিরাট শ্মশান। কাছেই পরিবার পরিজনদের নিয়ে বসবাস করতেন শিবভক্ত দীগম্বর হালদার। ষণ্ডেশ্বরের (Sandeswartala) অর্থই হল স্বয়ং শিব। শোনা যায়, এক রাতে শৈব দীগম্বরের স্বপ্নে দেখা দিয়ে মহাদেব বললেন, “আমি শ্মশান সংলগ্ন ভাগীরথীর জলে নিমজ্জিত আছি। আগামী রথযাত্রার পরদিবস শুভ তৃতীয়া তিথিতে তেওর (জেলে) সম্প্রদায়ভুক্ত নীলমণি জেলের দ্বারা ভাগীরথীতে জাল ফেলিয়া আমার মূর্তি উদ্ধার কর এবং আমার যথারীতি নিত্য পূজার্চ্চনার ব্যবস্থা কর।” আরও পড়ুন-Saptagram Port: অতীতের সপ্তগ্রাম ও সৈয়দ জামালুদ্দিন মসজিদ
মহাদেবের স্বপ্নাদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন দীগম্বর হালদার। নির্দিষ্ট দিনে ভাগীরথীর জল থেকে নীলমণি জেলের জালে উঠে এল ষণ্ডেশ্বর (Sandeswartala) শিবলিঙ্গ, একটি ত্রিশূল, ভৈরব বিগ্রহ (যেটি আসলে সাতটি শিলা), সঙ্গে পুজোর বিবরণ লেখা তাম্রপত্র। সেই শ্মশানেই ষণ্ডেশ্বরকে স্থাপনের পর নিত্যপুজোর ব্যবস্থা করলেন ব্রাহ্মণ দীগম্বর হালদার। জেলে নীলমণি তেওর, একজন কর্মকার ও একজন রুইদাস অর্থাৎ চর্মকার বা মুচিকে সঙ্গে নিয়ে হুগলির গ্রামদেবতা ষণ্ডেশ্বরের (Sandeswartala) আরাধনায় মেতে ওঠেন দীগম্বর। অল্প দিনের মধ্যে সেই পুজো জনপ্রিয়তা পায়।
কিছুদিন পরে দীগম্বর হালদার শিবলিঙ্গকে ঘিরে তৈরি করলেন মাটির একচালা ঘর। সেটিই ষণ্ডেশ্বরের (Sandeswartala) মন্দির হিসেবে পরিচিতি পেল। এর অনেক দিন পরে সিদ্ধেশ্বর রায়চৌধুরি নামে হুগলির এক বাসিন্দা ষণ্ডেশ্বরের মন্দিরটিকে পাকা করে দেন। তারও অনেককাল পরে মন্দিরটির সংস্কার করান গৌরীকান্ত রায়। মনে করা হয়, সিদ্ধেশ্বর রায় যে ষণ্ডেশ্বরের মন্দিরটি তৈরি করিয়েছিলেন, সেটিরই সংস্কার করান গৌরীকান্ত রায়। গাজন উৎসবের জন্য সবিশেষ প্রসিদ্ধ এই ষণ্ডেশ্বর (Sandeswartala) তলার মন্দির। সেসময় সন্ন্যাসীরা গাজনে নানারকম হাড়হিম করা কর্মদক্ষতা দেখাতেন, খ্রিস্টান মিশনারীদের তা পছ্ন্দ ছিল না। তাই গাজন বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, বলাবাহুল্য ষণ্ডেশ্বরতলাও (Sandeswartala) বাদ পড়েনি। আরও পড়ুন-Haji Muhammad Mohsin: দানবীর হাজি মহম্মদ মহসীন ও ইমামবাড়া
Sandeswartala: লৌকিক কাহিনী ও ষণ্ডেশ্বরতলা
সেখানে সন্ন্যাসীদের ঝাঁপের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। সেবছর গাজন দেখতে এসেছিলেন তৎকালীন চুঁচুড়ার ডাচ গভর্নর জে এন বার্চ। এদিকে ঝাঁপ দেওয়া নিষেধ হওয়ায় ষণ্ডেশ্বর জিউ-র (Sandeswartala) মাহাত্ম্য প্রচারে বিঘ্ন ঘটেছে। গাজনে উপস্থিত সকলের সাবধানবাণী উপেক্ষা করে সন্ন্যাসীরা মঞ্চ থেকে সোজা ধারালো বাণের উপরে ঝাঁপ দিলে বাণ খণ্ড খণ্ড হয়ে ভেঙে পড়ে। এই ঘটনায় সন্ন্যাসীরা বিন্দুমাত্র আঘাত পাননি। এই দেখার পর ঝাঁপের নিষেধাজ্ঞা বাতিল করেন বার্চ সাহেব। সেই সঙ্গে মন্দিরে একটি পিতলের ঢাক ও অষ্টধাতুর পঞ্চমুখ উপহার দেন ওই ওলন্দাজ গভর্নর। পরে স্থানীয় লাহাবাড়ির তরফে আরেকটি পিতলের ঢাক ও অষ্টধাতুর ষণ্ডেশ্বর মূর্তি (Sandeswartala) ষণ্ডেশ্বর জিউ-র মন্দিরে দান করা হয়। সেই ঢাকদুটি দেখতে এখনও গাজনের সময় দর্শণার্থীতে ভরে হুগলির ষণ্ডেশ্বরতলা।
Sandeswartala:ষণ্ডেশ্বরতলার মাহাত্ম্য
এর অনেক বছর পরে বিশ শতকের সাতের দশকে জীর্ণ হয়ে যাওয়া ষণ্ডেশ্বর জিউ-র মন্দির সংস্কারের কাজে এগিয়ে আসেন চুঁচুড়ার বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাক্তার মুরারিমোহন মুখোপাধ্যায়। তাঁর উদ্যোগেই হুগলির বাসিন্দাদের কাছ থেকে চাঁদা তোলা শুরু হয়। শোনা যায়, মহানায়ক উত্তম কুমারও ষণ্ডেশ্বরের মন্দির সংস্কারের জন্য বিরাট অংকের অনুদান দিয়েছিলেন। মহানায়কের স্ত্রী গৌরীদেবী দারুণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর মুরারিমোহনের চিকিৎসায় তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। উত্তম কুমার যখন সম্মান দক্ষিণা দিতে উদ্যোগী হলে ডাক্তারবাবু ষণ্ডেশ্বর জিউর (Sandeswartala) মন্দির নির্মাণ প্রকল্পে অনুদানের প্রসঙ্গ তোলেন। সেখানেই অর্থ দান করেছিলেন মহানায়ক।
ইংরেজি ১৯৭৪ সালের ৪মে এবং বাংলা ১৩৮১ সালের ২০শে বৈশাখ বর্তমান মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। এরপর ১৩৮৫ সালের অঘ্রায়ন মাসে ৮৭ ফুট উচ্চতার ছয়তলা বিশিষ্ট মন্দিরটির নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ হয়। শ্বেতপাথরে নির্মিত এই মন্দিরের স্থপতি ছিলেন শ্রী উপেন্দ্রনাথ ঘোষ দস্তিদার। পরের বছর অর্থাৎ ১৩৮৬ সালের ১ বৈশাখ ইংরেজি ১৯৭৯ সালের ১৫ এপ্রিল ষণ্ডেশ্বরতলার (Sandeswartala) মন্দিরটির উদ্বোধন হয়। আরও পড়ুন-Bansberia: চলুন যাই দেখে আসি, বাঁশবেড়িয়ার ৩৪১ বছরের অনন্ত বাসুদেব মন্দির
বিশ শতক এখন অতীত, তবে ৫০০ বছরের ইতিহাসকে বুকে নিয়ে আজও বহমান ভাগীরথীর তীরে ষণ্ডেশ্বরতলা বিরাজমান। সময়ের ব্যবধানে লোকাচারে অনেক পরিবর্তন এলেও স্থানীয়দের কাছে ষণ্ডেশ্বর জিউ-র (Sandeswartala) গুরুত্ব একবিন্দুও কমেনি। দৈনিক ক্লান্তি দূর করতে বেলা পড়তেই ষণ্ডেশ্বরতলায় স্থানীয়দের ভিড় জমে। দীগন্ত রেখায় তখন ভাগীরথীকে রাঙিয়ে সূর্য ডুবছে।