Rath yatra

মায়ের মুখ চেয়ে এখনও রথ টানি

 

শ্রয়ণ সেন

“বড়ো হয়ে গিয়েছি। ক্লাস সিক্সে পড়ি। এ বার আর রথ (Rath Yatra) টানব না।” তখন ক্লাস সিক্সে উঠে যাওয়া মানে সত্যিই বড়ো হয়ে যাওয়া ভাবতাম। হাইস্কুলে উঠেছি তো! অনেকের থেকেই বড়ো হয়েছি। তাই ‘ছোটদের’ মতো রথ টানার প্রতি আর কোনও আগ্রহ আমার নেই। মাকে বলেই ফেললাম এ বার থেকে আর রথ টানব না। মা সেটা মেনেও নিল। ছেলে সত্যিই বড়ো হয়ে গিয়েছে। ওর হাতে খেলনা-রথের দড়ি আর মানাবে না। সবার মতো ছোটবেলায় আমারও একটা খেলনা-রথ ছিল। বেশ বড়ো, তিনতলা। রথটা টানার জন্য প্রতি বছর আমার দাদা-দিম্মার বাড়িতে যেতাম, সোজা আর উল্টোরথের দিন। জন্ম থেকে পরের ন’-দশ বছর বাড়িটার সঙ্গে সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর ছিল। বাড়িটার সঙ্গেই ছিল বড়ো বাগান। যে বাগানে কত ফল হত, কত ফুল ফুটত। একতলা বাড়ি আর সেই বাগানে খেলাধুলো করে আমার ছোটবেলা কেটেছে। এর পর ধীরে ধীরে দাদা, দিম্মা মারা গেলেন। আমি, বাবা, মা – আমরা তিন জন মাঝেমধ্যেই ওই বাড়িতে গিয়ে সপ্তাহান্ত কাটিয়ে আসতাম।

আমার রথ ((Rath Yatra)) টানা শুরু ক্লাস ওয়ানে পড়ার সময় থেকে। আমিই রথের ‘মালিক’। মনে পড়ে উৎসবের আগের দিন কী সুন্দর করে সাজিয়ে তোলা হত রথটা। ওই বাড়ি যিনি দেখভাল করতেন, তিনিই এই কাজটা করতেন। মার্বেল পেপার দিয়ে রথ সাজানো হত। জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রাকে রাখা হত মাঝের তলে। ওপর আর নিচের তলায় নকুলদানা, ধূপ এই সব। রথের দিন স্কুলে ছুটি থাকত না। কিন্তু মর্নিং স্কুল হওয়ার সুবাদে একটা বিশাল সুবিধা পাওয়া যেত। বেলা বারোটার পর থেকে বাকি সময়টা বাড়িতেই কাটত। ছোট্ট থেকে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত রথের দিন ওই বাড়িতে যাওয়াটা বাধ্যতামূলক ছিল। স্কুল থেকে ফিরে, দুপুরে কিছুটা ঘুমিয়ে নিয়ে বিকেল হতেই চলে যেতাম সেখানে। রথ টানব ভেবে ভীষণ উত্তেজিত লাগত। বাড়িতে পৌঁছে, একটুও সময় নষ্ট না করেই সেই রথটা নিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তাম। তবে বাগানটা অনেক বড়ো হওয়ার ফলে সেখানেই মূলত ঘুরতাম। বাইরের রাস্তায় খুব একটা বেরোতাম না। সোজারথ আর উল্টোরথ, দু’ দিনই রথ টানতে চলে যেতাম ওই বাড়িতে। এ ভাবেই বড়ো হতে লাগলাম।


এ বার আমি ক্লাস সিক্সে উঠেছি। অনেকের থেকে বড়ো এখন আমি। তাই আর রথ ((Rath Yatra)) টানার প্রশ্নই নেই। স্কুলবাসে স্কুলে যেতাম তখন। ওই বাসযাত্রাটাও বেশ উপভোগ করতাম। আমার ভ্রামণিক মনটা জেগে উঠত। সকাল ৬:১০-এ বাস আসত। কলকাতার দক্ষিণ শহরতলির একটা বড়ো অংশ ঘুরিয়ে ৭টায় স্কুলে পৌঁছে দিত। আবার সাড়ে এগারোটায় বাড়ি ফেরার বাস। রথের দিন বলে স্কুল ছুটি হয়েছে এক ঘণ্টা আগে। ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। অন্য দিনের থেকে বেশি তাড়াতাড়িই বাড়ি পৌঁছে যাব। ঠিক তখনই একটা ভীষণ বড়ো ভুল করে বসলাম। তাড়াতাড়ি বাসে ওঠার জন্য স্কুল থেকে দিলাম দৌড়। এর আগে কিন্তু কোনো দিন বাস ওঠার জন্য দৌড় দিইনি। কিন্তু সে দিন আচমকা কী মনে হল দৌড়োতে শুরু করলাম। ভাঙাচোরা রাস্তা, স্টোন চিপস বেরিয়ে আছে এখানে সেখানে। ঠিক এই রাস্তাতেই পড়লাম রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে। সেখানে পড়লে যা হওয়ার সেটাই আমার হল। সাংঘাতিক রক্তারক্তি কাণ্ড। ডান হাঁটু প্রায় ছারখার।


ছোট থেকে খুব একটা দূরন্ত ছিলাম না বলে এ ভাবে পড়ার কোনো অভিজ্ঞতা আমার নেই। এত রক্ত দেখে হকচকিয়ে গেলাম। আশপাশের মানুষজনই আমায় তুলে ধরে বাস পর্যন্ত পৌঁছে দিলেন। প্রাথমিক শুশ্রূষা করলেন দাসকাকিমা, আমাদের স্কুলবাসের মালকিন। খুব স্নেহ করতেন আমায়। বাসে ফার্স্ট এইড বক্স ছিল। সেখান থেকে লাল ওষুধ লাগিয়ে হাঁটুটাকে কিছুটা ঠ্যাকনা দিলেন। তার পর তো বাড়ি পৌঁছে বাকি শুশ্রূষা। হাঁটুতে এই কেটে যাওয়ার চিহ্নটা কিন্তু এখনও রয়েছে। যখনই ওই চিহ্নটার দিকে তাকাই কুড়ি বছর আগের এই রথের ((Rath Yatra)) দিনটার কথা মনে পড়ে। যাই হোক, হাঁটুর চোটটাকে কিছুটা সারিয়ে আবার স্কুলে গিয়েছি। সপ্তাহ ঘুরে এসে গেল উল্টোরথের দিন। টিফিন টাইমে ক্লাস রুম থেকে বেরিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে একটু খেলছি। অদ্ভুত ভাবে, আবারও দৌড়োদৌড়ি করতে লাগলাম এবং আবার হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। এ বার স্কুলের সিঁড়ির কোণা গিয়ে ঠুকল আমার কপালে। আবার রক্তারক্তি। এ বার আরও সাংঘাতিক। আমার পরিষ্কার মনে পড়ে ক্লাসের দু’-তিন জন বান্ধবী আমাকে ধরে ধরে তিনতলায় ইনচার্জ ম্যাডামের ঘরে নিয়ে গেল। এমন ভাগ্য আমার, যে জীবনে প্রথম বার বান্ধবীদের ঘাড়ে মাথা রেখে কোথাও গেলাম, কিন্তু মুহূর্তটা উপভোগই করতে পারলাম না।


ইনচার্জ ম্যাডাম দেখলেন কপালটা। সুবিধার ঠেকছে না। খবর গেল বাড়িতে। মা ট্যাক্সি নিয়ে চল এল। আমাকে নিয়ে সোজা ডাক্তারমামার চেম্বারে। মামা ক্ষত দেখেই বুঝে গেল সেলাই ছাড়া কোনো উপায় নেই। এ বার গন্তব্য বাঘা যতীন অঞ্চলের একটি নার্সিংহোমে। পাঁচ-ছ’টা সেলাই পড়ল। সেই সঙ্গে কপাল জুড়ে ব্যান্ডেজ। এই নিয়ে আমার মাথায় তিন বার সেলাই পড়ল। অথচ ছোটোবেলায় কোনও দস্যিপনা আমি যে করিনি সেটা হলফ করে বলতে পারি। এই পরিস্থিতির পরেও কিন্তু স্কুল থেকে ছুটি নিইনি। কপালজোড়া ব্যান্ডেজ নিয়েই স্কুল যাওয়া শুরু করলাম। তবে এ বার সেরে উঠতে বেশ কিছু দিন সময় লাগল। ঘটনার প্রায় দশ দিন পর সেই স্টিচ কাটা হল।

সোজা এবং উল্টোরথের ((Rath Yatra)) দিন কাকতালীয় ভাবে ঘটে যাওয়া দু’টো ঘটনা আমার মায়ের মনে অদ্ভুত একটা কুসংস্কার ঢুকিয়ে দিল। রথের দিন আমাকে এক বার রথের দড়ি ছুঁতেই হবে। সে কারণে রথের দিন বিকেলে গড়িয়ার রথতলায় যাওয়া নিয়মে পরিণত হয়ে গিয়েছে প্রায়। যখন রথতলায় যাওয়া সম্ভব হয় না, তখন বাড়ির নিচে কোনও না কোনো রথ ঠিক দেখা যাবেই। কচিকাঁচারা বেরোয় তো রথ নিয়ে। মায়ের কথামতো, ওদের রথের দড়ি একটু ছুঁই, ২টো টাকা দক্ষিণা দিই। পরিবর্তে দু’টো নকুলদানা জুটে যায়। বেশ মজা লাগে ব্যাপারটা। মনে হয় আজও বিকেলে বাচ্চাগুলো রথ নিয়ে বেরোবে। দু’টো টাকার বিনিময়ে একটু রথের দড়িটা ছুঁলে, ওদের মুখেও খুব সুন্দর একটা হাসি ফোটে। সেটা দেখতে বেশ লাগে। আর আমার মা-ও ভীষণ শান্তি পাবে। এক এক সময় মনে হয় কাকতালীয় দু’টো ঘটনাকে মনে রেখে কেন এখনও ছোট্ট এই কুসংস্কারকে নিজের ভেতরে রেখে দিয়েছে মা। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবি, এটা কুসংস্কার কখনোই নয়। এটা একটা বিশেষ ভালবাসা, যে ভালবাসার সংজ্ঞা শুধু মায়েরাই জানে, আর কেউ না।

Facebook Comments Box

Post Author: bongmag

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।