শান্তিনিকেতনের আশ্রমের পরিবেশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম জন্মদিন পালিত হয় ১১০ বছর আগে। ১৩১৭ বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখ, ১৯১০ সালের ৮ মে, দিনটা ছিল রবিবার। সে বছর ৪৯ পেরিয়ে কবি ৫০-এ পদার্পণ করেছেন। তাঁর জন্মদিনকে কেন্দ্র করে এই উৎসব পালনের কথা কবিকে আগে থেকে জানানো হয়নি। সেবার পুরীতে যাবেন কবি, সেজন্য ১২ই বৈশাখ তিনি কলকাতায় যান কিন্তু ১৮ই বৈশাখ শান্তিনিকেতনে ফিরে আসেন। তখন দেখলেন আশ্রমময় তাঁর জন্মোৎসবের সাজো সাজো রব।
এই উৎসবকে কেন্দ্র করে উদ্যোক্তাদের আন্তরিকতার যে পরিচয় গুরুদেব পেলেন সে কথা জন্মদিনের ভাষণে তিনি আবেগজড়িত কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন,“বাপ মায়ের ঘরে যখন জন্মেছিলুম তখন অকস্মাৎ কত নূতন লোক চিরদিনের মতো আপনার হয়ে গিয়েছিলেন, আজ ঘরের বাইরে আর একটি ঘরে আমার জীবন যে জন্ম লাভ করেছে এখানেও একত্র কত লোকের সঙ্গে আমার সম্বন্ধ বেঁধে গেছে। সেই জন্যই আজকের এই আনন্দ।” আরও পড়ুন-২৫ বৈশাখ ও স্মৃতির মোড়কে শান্তিনিকেতন
সেদিনই প্রিয়ংবদা দেবী-কে কবি লেখেন, “আজ প্রাতে আমার জন্মদিন উৎসব হয়ে গেল। আমার যে একটা জন্মদিন আছে সে কথা ভুলে গিয়েছিলুম। … আজ মনে হল আর এক জন্ম লাভ করেছি – এখন যারা আমার কাছে এসেছে, আমাকে কাছে পেয়েছে, তাদের ছেলে। তারাই আনন্দ করে আজ সকালে আমাকে নিয়ে উৎসব করেছে – এই আমার আশ্রমের জীবন, এই আমার মঙ্গললোকে নূতন জন্ম লাভ – ঈশ্বর এই জন্মকে সার্থক করুন প্রার্থনা করি।”
১৯১১ সালের ২৫শে বৈশাখ, ভোরে শান্তিনিকেতনে আম্রকুঞ্জে গুরুদেবের জন্মোৎসবের আয়োজন হয়। কাশীর ব্যাসবেদীর অনুকরণে বেদী নির্মাণ করে আলপনা, ধূপ, গন্ধপুষ্প দিয়ে সাজানো হয়। দীনেন্দ্রনাথ ছাত্রদের নিয়ে গান করেন। কবিকে আশ্রমের পক্ষ থেকে কিছু উপহার দেওয়া হয়। কবি বলেন, “আমাকে আপনারা যে উপহার দিলেন, সেগুলি পাবার আমি কতখানি যোগ্য তা যদি আমি মনে করতে যাই তা হলে আমাকে লজ্জিত হতে হবে। কিন্তু একটা ক্ষেত্র আছে যেখানে মানুষের কোনও লজ্জা নেই, সেটা প্রীতির ক্ষেত্র। এই সব উপহার আমাকে আপনারা প্রীতির সঙ্গে দিচ্ছেন, সেই জন্য এ সব গ্রহণ করতে আমার কোনও বাধা নেই।” সভার কার্য শেষ হতেই কবিকে প্রণাম করার ধুম পড়ে গেল। প্রায় তিনশো ব্যক্তির প্রণাম গ্রহণ করতে হল তাঁকে। আরও পড়ুন- “আজ প্রাতে আমার জন্মদিন উৎসব”
১৩২১ বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখ কবি ৫৩ বছর পূর্ণ করে ৫৪ বছরে পদার্পণ করলেন। সেবার তাঁর জন্মজয়ন্তী পালিত হয় কলকাতাতেই। এবার কবির অনুপস্থিতিতেই সুদূর আমেরিকার আরবানায় ৬ই মে ১৯১৪ [বুধবার, ২৩শে বৈশাখ ১৩২১] রবীন্দ্রজন্মোৎসব পালিত হল। সেখানকার অনামা সাংবাদিক শ্রীমতী সেমুর গুরুদেবকে পত্রে লেখেন, ‘Our little Circle has met tonight to commemorate their Poet’s birthday and to send him tier cordial greetings … After the public meeting, the Circle met and each recited a favourite poem while Mr. Barman and Mr. Saymour sang Bengali songs from the book on Indian music.’
১৩৩১ বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখ, সেবারের জন্মদিনে কবি চিনে রয়েছেন। সেই দিন পিকিং-এর Crescent Moon Society ২৫শে বৈশাখকে ‘রবীন্দ্রদিবস’ নাম দিয়ে কবির জন্মদিন পালনের আয়োজন করল। পিকিং ইউনিয়ন মেডিক্যাল কলেজের বিরাট হলঘরে অনুষ্ঠানের এই আয়োজন। অনুষ্ঠানমঞ্চ জনপূর্ণ। দোভাষী পণ্ডিত মিস্টার লিয়াঙ্-চি-চাও চিনা ভাষায় রবীন্দ্রনাথের নতুন নামকরণ করেন “চু-চেন-টান্”। প্রাচীন চীনা ভাষায় ভারতবর্ষকে বলা হত “চু”, রবি শব্দের চৈনিক প্রতিশব্দ “চেন” এবং ইন্দ্র শব্দের প্রতিশব্দ “টান্”, অর্থাৎ উপাধিটির অর্থ হল – “ভারতের মেঘমন্দ্রিত প্রভাত”। একটি মূল্যবান প্রস্তরখণ্ডের উপরে “চু-চেন-টান্” খোদাই করে সেটি তুলে দেওয়া হয় কবির হাতে।