সবুজকলি সেন
তাঁকে দেখলেই মনটা আলোয় ভরে ওঠে। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে অত্যন্ত সাবলীল। কখনও এগিয়ে গিয়ে কথা বলতে দ্বিধাবোধ হয়নি, তিনি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ডক্টর সবুজকলি সেন। ছাত্রছাত্রীদের প্রিয় দিদি। বসন্ত উৎসবের অনুভূতি ভাগ করে নিলেন bongma.com– এর সঙ্গে।
আমার ছোটবেলাটা কেটেছিল কয়লাখনি অঞ্চলে। সেখানে বসন্ত উৎসব ছিল অন্যরকম। বসন্ত উৎসবের প্রায় একমাস আগে থেকে শিল্পাঞ্চলের খনি এলাকায় শ্রমিক মহল্লায় শুরু হত গান বাজনা। সন্ধ্যা হলেই চকোমকো চকোমকো করে বাজতো, সঙ্গে “হোলি হ্যায়” গান। ওই বাজনা শুনে বুঝতাম দোল এসে গিয়েছে, সে এক বিচিত্র অনুভূতি। দিনের বেলাটা সাঙ্ঘাতিক ছিল, বেরোতাম না। ওরাই বাড়িতে আসত, আবীর দিত, আমরা তাদের মিষ্টি খাওয়াতাম, টাকা দিতাম। আবার সন্ধে বেলায় হত হোলি মিলন উৎসব।
আমার ১২ বছর বয়সে প্রথম শান্তিনিকেতনে আসি দোলের দিনে। কোথাও যে এমন নান্দনিক ভাবে বসন্ত উৎসব হতে পারে তা প্রথম দেখি। দোলের দিন আসাটা আমার দারুণ লেগেছিল। তখন দোল হত আম্রকুঞ্জে। গাছের চারপাশে ঘুরে ঘুরে হত নাচ। আর সন্ধের অনুষ্ঠান হয়েছিল চিত্রাঙ্গদা, সেটা গৌর প্রাঙ্গণে। তারপর আমি এখানে পড়তে এলাম তখনও আম্রকুঞ্জেই দোল দেখেছি। দোলে এখানে আকাশে বাতাসে বসন্তের গন্ধ থাকে। শিমুল ফুটেছে, পলাশ ফুটেছে রঙে রঙে রঙীন শান্তিনিকেতন। সেই বসন্তের ভাবটা নিয়ে আসত। অসাধারণ লাগত। আমরাও প্রসেশনে থাকতাম, সন্ধেবেলায় অনুষ্ঠান দেখতাম। এটা একটা আলাদা আনন্দের জগৎ ছিল। তখন ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাও খুম কম। সবটাই তখন আমাদের অনুষ্ঠান হচ্ছে বলে মনে হত। আরও পড়ুন- ফেলে আসা মেয়েবেলা ও মন কেমনের বসন্ত উৎসব
একটা অদ্ভুত ঘটনা প্রতিবার দোলে সে সময় ঘটত। দোলের দিন ডাকে একটা খাম পেতাম। তাতে আবীর থাকত। সঙ্গে লেখা থাকত, সহসা সবুজে আবীরের আভা লাগে। কে যে সেই ডাকে আবীর পাঠাতো আজও জানতে পারিনি। তবে ঘটনাটি বেশ মজা লাগত। একবার খুব গন্ডগোল হয়েছিল দোলের সময়। সেকারণে পরের বছর দোলটা অন্যদিন হয়। সেসময়ের দোলের নিজস্ব সত্ত্বা ছিল, এখনকার দোলে তা দেখতে পাই না। সেটা বদলে গিয়েছে। এখন ফাংশন ভবন ভবন আলাদা হয়েছে। আমাদের বেলায় এমন ভবন ভবন ছিল না। সংগীতভবন একটা গান, একটা গান বিনয়ভবন, একটা গান শিক্ষাভবন, তখন এমন ছিল না। তখন গানের দল একটাই। যারা গান গাইতে পারে, তাদেরকে নির্বাচন করা হত। তারাই গান গাইত। নাচও তাই, পরীক্ষা করে নেওয়া হত। শান্তিদা একদম লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে থাকতেন। আমরা তাই দোলের দিন দশেক আগে থেকে রিহার্সাল করতাম। দোলের দিন সকালবেলা এসে নাচের দলে ঢুকে গেলাম ওটা একেবারেই ছিল না। শান্তিনিকেতন ছিল একটাই জায়গা, যা হবে শান্তিনিকেতনের ছেলেমেয়েরা করবে। সেই সময় ভবন ভবন অনুভূতিটা ছিল না। এখন আমি মনে করি ওই জিনিসটা চলে গিয়েছে। যারফলে ব্যাপারটা প্রাণহীন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেটা আমাকে ব্যথা দেয়।
যখন ছাত্রী ছিলাম তখন তো বসন্ত উৎসব অন্যরকম ছিল। তারপর শিক্ষিকা হলাম, তখন বসন্ত উৎসব বদলে গিয়েছে। বন্ধুবান্ধবরা নেই, কেউ নেই। আমি মনে করি প্রত্যেককে জায়গা ছেড়ে দিতে হয়। আমার ওই জায়গাটা এখন আমার ছাত্রছাত্রীদের উপভোগ করার। আর সত্যি কথা বলতে কি, গত ২০ বছর ধরে এত লোক আসতে শুরু করার পর থেকে আমি দোলের মাঠে বিশেষ যাই না। পাঁচ বছর ডিরেক্টর থাকায় দোলের মাঠে গিয়েছি। এক জায়গায় বসে থাকতাম, শেষ হলেই ফিরে আসতাম। আমার বাড়ি থেকে শান্তিনিকেতনে যেতে আট থেকে নয় মিনিট সময় লাগে। দোলের দিনে সেটাই দেড়ঘণ্টার দূরত্ব হয়ে দাঁড়ায়। এখন দোলের দিনে আমার ছাত্রছাত্রীরা বাড়িতে আসে। তাদের জন্য মিষ্টি তৈরি করে রাখি। তাদের জন্য অপেক্ষা করি। আরও পড়ুন- দোল এলেই ভয় হয়, উন্মত্ত জনতার ভিড়ে একলাটি শান্তিনিকেতন
মূলত আটের দশক থেকেই শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসবে ভিড় হতে শুরু করে। তখন শিক্ষিকা জীবন শুরু হয়ে গিয়েছে। ধীরে ধীরে সেটা বাড়তে বাড়তে অভদ্রতার পর্যায়ে পৌঁছেছে। আমার একটা জিনিস মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন শান্তিনিকেতনের সভ্যতাকে ছড়িয়ে দিতে। পাড়ায় পাড়ায় বসন্ত উৎসবের মাধ্যমে শান্তিনিকেতন তৈরি করো। তাহলেই এই ভিড়টা কমবে। এখন তো কত জায়গায় বসন্ত উৎসব হয়, দেখতে বেশ ভাল লাগে। এটা একটা সাংস্কৃতিক উৎসব। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের নিজস্ব উৎসব, অন্যদের মনোরঞ্জন করা ছাত্রছাত্রীদের কাজ নয়। শান্তিনিকেতন ফূর্তি করার জায়গা নয়, এটা কিন্তু মনে রাখতে হবে।