রাখী সরকার
ও দেবেশ’দা কিছু শুনতে পাচ্ছেন? ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠল রমেন। দেবেশ একটু কান খাড়া করে শব্দটা শোনার চেষ্টা করে। ঠিক তো, কম্বলের মধ্যে থেকেও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। কেউ যেন নাচের তালে তালে ঘুঙুর পরা পা ফেলছে। দেবেশ বিছানা ছেড়ে উঠে মোমবাতিটা জ্বালায়। ব্যাস সব চুপচাপ কোনও শব্দ নেই। দেবেশ রমেনকে উদ্দেশ্য করে বলে, রমেনবাবু টর্চটা নিন, চলুন বাইরে গিয়ে দু’জনে দেখি।
রমেন এবার ভয়ে কাঁচুমাচু মুখ করে বলে, আপনার কি মাথা খারাপ দেবেশ দা! আমরা তো সব জেনেশুনেই এখানে এসেছি। এমন হওয়া তো অস্বাভাবিক কিছু না। কী দরকার ভূতের মুখোমুখি হতে যাওয়ার? দেবেশ এবার রমেনের উপরে রেগে ওঠে। বলে, আপনি তো মশাই প্রথমদিনই হার মেনে নিলেন। মণিসুর, কৌশিক নিজের নিজের জায়গায় ঠিক টিকে আছে। আপনার জন্য আমাকে না হারতে হয়! কাল সকালে এর একটা কিছু সমাধান চাই। এই বলে দেবেশ মোমবাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল।
এবার তো আপনাদের জানতে হবে যে এই দেবেশবাবু কিসের হারজিতের কথা বলছেন? এই যে এতক্ষণ ধরে যাঁদের নাম শুনলেন এঁরা হলেন আলিপুরদুয়ারের যোগেন্দ্রপুর উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। সহকর্মী হিসেবে পরস্পরের সঙ্গে বেশ ভালই সম্পর্ক। যাকে বন্ধুসুলভ বলা চলে। একদিন স্কুলের টিফিনের আড্ডায় কার কতো সাহস আছে তা নিয়ে বাঁধল এক তুমুল তর্ক। এঁদের কেউই দমবার পাত্র নয়। সবাই নিজের নিজের বুকের পাটা জাহির করে তবেই ছাড়বে। আরও পড়ুন-ক্যানভাসে বৃষ্টির রাত, প্রহর জাগে ১৪ ফেব্রুয়ারি
কিন্তু সেই বুকের পাটা কে কতক্ষণ ধরে রাখতে পারে? সেটা দেখার জন্যই ঠিক করা হলো চারজনেই যাবেন ঘুঘুডাঙা জমিদার বাড়ি। ভূতুড়ে জমিদারবাড়ি হিসেবে ঘুঘুডাঙার খুব নামডাক। এই চারজন সেকথা ভালই জানেন। তাই শর্ত রাখা হলো চারজনকে আলাদা আলাদা ঘরে ওই জমিদার বাড়িতে রাত কাটাতে হবে। যিনি সবচেয়ে বেশিদিন একা ওখানে রাত কাটাতে পারবেন, তিনি এই প্রতিযোগিতায় জয়ী হবেন। আর পুরস্কার হিসেবে পাবেন বাকি তিনজনের থেকে ছ’হাজার টাকা। সুতরাং ফ্রিতে ছ’হাজার টাকা আর স্কুলের অন্যসব সহকর্মীদের সামনে বীরপুরুষ সাজতে কেই বা না চায়। সেকারণে এই চারজন ২৫ ডিসেম্বরের পরের দিন চলে এলেন এই ঘুঘুডাঙা জমিদার বাড়িতে।
জমিদার বাড়ির কেয়ারটেকারকে টাকার লোভ দেখাতেই থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত হয়ে গেল। তবে একটা কথা সাফ জানিয়ে দিয়েছিল, রাত আটটার পর সে আর এখানে থাকবে না। তাতে চারজনের কেউই কোনও আপত্তি করেনি। কেয়ারটেকারের হাতে টাকা ধরিয়ে দেওয়ায় সে নিজে থেকে রান্নাবান্নার ব্যবস্থা করে ফেলল৷
প্রথম দিন রাতে সবার আলাদা থাকার ব্যবস্থা হল। রমেন চিরকালই একটু ভীতু গোছের লোক। হুজুগে পড়ে তিনিও চলে এসেছেন পাছে স্কুলের ম্যাডামদের সামনে তাঁর পুরুষত্বের সম্মানে কালিমা পড়ে যায়। রাত ন’টার দিকে যে যার ঘরে চলে গেলেন। সঙ্গে মোমবাতি, দেশলাই, টর্চ, আর মোবাইল তো আছেই। এ জমিদারবাড়ি ভূতের জন্য খুব বিখ্যাত, রমেন মনে মনে ভাবেন। কি জানি তার সামনে কি কি ভূত দেখা দেয়? এসব ভাবতে ভাবতে সে কম্বলে মাথা মুড়ে এক ক্লান্তির ঘুম দেয়। আরও পড়ুন-স্রোতের গন্ধ
তখন হয়তো গভীর রাত। অতিরিক্ত শীত করার কারণে রমেনের ঘুমটা গেল ভেঙে। দেখলেন উত্তরের খোলা জানালা থেকে হু হু করে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছে ঘরে। এমন সময় হঠাৎ রমেনের কানে আসে ঘুঙরুর শব্দ। মনে হচ্ছে কে যেন দরজার সামনে নেচে নেচে বেড়াচ্ছে। রমেন মনে মনে ভাবে, এখানে আর কে নাচবে? নির্ঘাত কোনও ভূত! শব্দটা ক্রমশ বাড়তে থাকে। রমেনের শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া গলা থেকে বেরোয়, কে ..…কে ওখানে…? ওপাশ থেকে ভেসে আসে ক্ষিণক্ষিণে নারীকণ্ঠের তীব্র হাসি।
রমেনের মুখে আর কথা সরল না৷ বাকি রাতটুকু বিছানায় বসে হনুমান চল্লিশা জপতে থাকেন। সকালে উঠেই তাঁর এক কথা, একা ঘরে আর থাকবে না। মনিসুর, কৌশিক ওদের ঘরে থাকতে না দেওয়ায় শেষ গতি হয় এই দেবেশদার ঘর। কিন্তু এ ঘরে এসেও শান্তি নেই। সেই ঘুঙুরের শব্দ এখানেও তাঁর পিছু নিয়েছে।
পরেরদিন দুপুরে তাসের আড্ডায় কথা ওঠে। দেবেশ জিজ্ঞেস করেন ,মনিসুর- কৌশিক তোমরা কিছু শুনেছ বা দেখেছ নাকি? মনিসুর বেশ গর্বের সঙ্গে বলেন, আমিতো এখনও পর্যন্ত কিছু দেখলামও না শুনলামও না। মানুষ শুধু শুধু জায়গাটার বদনাম করে। কৌশিক বলে ওঠেন, আমি কিন্তু শুনেছি। রমেন উৎসুক জিজ্ঞাসা, ঘুঙুরের আওয়াজ তো কৌশিক? হ্যাঁ রমেন’দা, শুনে কিন্তু ওরকমই মনে হয়েছে। উত্তর দেয় কৌশিক। দেবেশ বলে ওঠেন, কাল রাতে আমিও কিন্তু ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছি। আমার মনে হয় এখানে আর থাকাটা ঠিক হবে না! আরও পড়ুন-Kashmir: কাশ্মীর! এক বিভাজিত আখ্যান
মনিসুর এবার হো হো করে হেসে ওঠে। কি কৌশিক তুমিও ওদের দু’জনের মতো ভয় পেলে নাকি? তবে ছ’হাজার আমিই পাচ্ছি তাই তো?
কৌশিক আর দেবেশ এবার রৈ রৈ করে ওঠে। আমরা কিন্তু এখনও বলিনি মনিসুর, যে আমরা একা আর থাকতে পারবো না। সে রাতে মনিসুর বিছানায় শুয়েছিল। আজ কিছুতেই তার ঘুমটা আসছে না। কারণ দুপুরে ওরা যে ঘুঙুরের শব্দের কথা বলছিল, তা যে মনিসুর শোনেনি তা নয়। সবার সামনে ইচ্ছে করে স্বীকার করেনি। যদি এসব করে ফ্রিতে টাকাটা বাগানো যায়।
ঘরের মোমবাতিটা নেভালে যেন অন্ধকারটা আরও বেশি ঘন হয়ে ওঠে। সারা জমিদার বাড়িতেই একটা অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা। যেন মনে হয় কেউ বাড়িটার কথা কেড়ে নিয়েছে। দুপুরের দিকে একা ঘুরে বেড়ালেও গা টা কেমন ছমছম করে। কথায় আছে, যা রটে তার কিছুতো বটে। তবে এ বাড়িতে নির্ঘাত কিছু একটা আছে। হঠাৎ মনিসুরের কানে আসে ঘুঙুরের শব্দটা। আজ অন্যদিনের থেকে বেশ জোরাল আর স্পষ্ট। আচমকা ওর দরজায় কে যেন টোকা দিল।মনিসুর বেশ জোরে জিজ্ঞেস করে, কে বাইরে? আর ঠিক তখনই শুরু হয় দরজার মধ্যে জোরে জোরে ধাক্কা বাইরে থেকে।মনিসুর ভয়ে ঘরের এক কোনায় সিঁটিয়ে যায়। শুধুমাত্র কটা টাকার জন্য সে কিছুতেই ভূতের হাতে প্রাণ দিতে চায় না। ফোন করে দেবেশকে। আরও পড়ুন-বিমান দুর্ঘটনাতেই নেতাজির মৃ্ত্যু হয়েছে, বিশ্বাস করতেন কৃষ্ণা বসু
হ্যাঁ মনিসুর বলো। দেবেশ ঘুম চোখে উত্তর দেন৷ দেবেশ’দা আপনারা এখনই আসুন৷ আমার ঘরের দরজায় কে ধাক্কা দিচ্ছে। কথাগুলো বলতে বলতে মনিসুর কেঁদে ফেলল। দেবেশ রমেনকে সঙ্গে নিয়ে ছুটে গেলোন মনিসুরের ঘরের দিকে। দেখেন কৌশিক ও ছুটে এসেছে। তিনজনের ডাকে ভয় কাটিয়ে শেষমেশ মনিসুর ঘরের দরজা খোলে। ভয়ে মনিসুরের সারা গা ঘামে ভিজে গেছে৷ মুখ শুকিয়ে কাঠ। দেবেশ কৌশিককে উদ্দেশ্য করে বললেন, এরপরেও কি তুমি একা থাকতে চাও কৌশিক? কৌশিক বলে হ্যাঁ দেবেশদা আর একটা রাত। আপনারা একসঙ্গে থাকবেন আর আমি একা। তাহলেই টাকাটা নিতে আমার মনে কোনও দ্বিধা থাকবে না।
অগত্যা কৌশিকের কথামতো পরের দিন রাতে দেবেশ, রমেন ও মনিসুর এক ঘরে থাকলেন। কৌশিক রইল একা তার নিজের ঘরে। রাত তখন একটা। কৌশিক আয়েশ করে একটা সিগারেট ধরায়। নিজের মনে মনেই বলতে থাকে। আজ শেষবারের মতো সবগুলোকে আর একবার একটা জম্পেশ ভয় দেখিয়ে আসি। ইউটিউবের ঘুঙুরের শব্দ আর ভুতুড়ে হাসিতে খুব কাজ দিয়েছে। দরজায় ধাক্কা দিতে যে মনিসুর এতো ভয় পেয়ে যাবে, কৌশিক নিজেও তা বুঝতে পারেনি। তার সঙ্গে এ বাড়ির থমথমে পরিবেশটা কৌশিককে দারুণভাবে সাহায্য করেছে।
এমন পরিত্যক্ত জমিদারবাড়িতে মাঝ রাতে ঘুঙুরের শব্দ পাওয়াটা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। সঙ্গে এই ঘুঘুডাঙা জমিদার বাড়ির ভূতুড়ে বদনাম তো আছেই। তাতেই কৌশিকেরই বেশি লাভ হয়েছে। ফ্রিতে ছ’হাজার টাকা পকেটে আসলে কার না ভাল লাগে! নাহয় একটু ঘুমই কামাই হয়েছে। এমন জমিদারবাড়িতে বাঈজি থাকবে, জমিদারের সঙ্গে তার প্রেম থাকবে। তারপর সে আত্মহত্যা করে ভূত হবে। এসব ভূতের গল্পে আকছার থাকে৷ আর সেটাকেই থিম হিসাবে কাজে লাগিয়েছে সে।
মোবাইলে চার্জ হলেই দেবেশ’দাদের ঘরের সামনে যাবে, ঠিক করে ফেলে কৌশিক। আজ একটা ভূতুড়ে কান্নাও সে ডাউনলোড করে রেখেছে। এমন সময় কৌশিকের কানে এলো একটা শব্দ। ঠিক যেন ঘুঙুরের শব্দ। কৌশিক মনে মনে হাসে।আজ তিনজনে মিলে বাছাধন কৌশিককে ভয় দেখাতে চলে এসেছ? টাকাটা দিতে খুব ফাটছে তাই না? কৌশিক অন্ধকারের মধ্যে এসে ধীরে ধীরে দরজাটা খোলে। দেখে দূরে বারান্দার অন্ধকারে একটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে। কৌশিক কৌতুকের স্বরে বলে, কে কে তুমি? ঘুঙুরু বাঈ নাকি? আরও পড়ুন-“রোগ তো শরীরের হয়েছে, আমি আনন্দে আছি”
ছায়ামূর্তি ধীরপায়ে পিছু হটতে থাকে৷ সেই তালে তালে জমিদারবাড়ির রাতের নিস্তব্ধতাকে চুরমার করে বেজে ওঠে ঘুঙরু। কৌশিক পিছু নেয়। ছায়ামূর্তি এগিয়ে গিয়ে পশ্চিমের একটা ঘরে ঢোকে। কৌশিকও পিছনে পিছনে ঢুকে পড়ে সেখানে। মনে মনে ভাবে, কার এত দম দেখি কৌশিককে ভয় দেখায়? কৌশিক দেখে ঘরের এক কোণেয বসে কে যেন কাঁদছে। মোবাইলে ডাউনলোড করা কান্নার মতোই শুনতে লাগছে।
কৌশিকের এবার একটু ভয় হয়। তবুও সাহসে ভর করে প্রশ্নটা করেই ফেলে, কে ওখানে? ছায়ামূর্তি তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে ওঠে, কেন চিনতে পারছ না? ঘুঙরু বাঈ। এমন সময় কৌশিককে ঘিরে নাচতে শুরু করেছে ১০-১২ ছায়ামূর্তি৷ তাদের ঘুঙুরের শব্দে কান ফেটে যাবে মনে হচ্ছে। কৌশিক দু’কানে হাত চেপে বসে পড়ে।
পরের দিন অনেক খোঁজাখুঁজির পর সবাই দেখল কৌশিক পশ্চিমের ঘরে অচেতন হয়ে পড়ে আছে। চোখে মুখে জলের ছিটে দেওয়ায় ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায় কৌশিক। দেবেশ প্রশ্ন করেন, এখানে আসলে কী করে? রমেন বলে ওঠেন, কৌশিকভাই কি ভূত ছিল? কৌশিক কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে উত্তর দেয়, ঘুঙরু বাঈ। ফলে বুকের পাটা দেখিয়ে সেই ছ’হাজার টাকা আর কেউই পাননি৷ শুধু পৈতৃক প্রাণটা নিয়ে বাড়ি ফিরতে পেরেছিলেন৷