কৃষ্ণা বসুর চলে যাওয়া যেন স্বজন হারানোর মতো বিষয়। স্বাধীনতা সংগ্রামীরা তো আমাদের স্বজনই ছিলেন। আগামীর ভারতকে সুরক্ষিত রাখতে ইংরেজের বুলেটের সামনেও বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। হাতে অস্ত্র দূরে যাক বুকে তখন অসম সাহস যা অনুভব করা যায়। গায়ে হয়তো খাদির হাফ ফতুয়া বা পাঞ্জাবি। সেসব কেমন স্বপ্নের মতো মনে হয়। আসলে কৃষ্ণা বসু যদি আলোচ্য হন তাহলে এসব কথা এসেই পড়বে। চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠছে, সেই হাসি মুখ। অশীতিপর শরীরেও ফুটে বেরতো প্রবল ব্যক্তিত্ব। লেখিকা কৃষ্ণা বসু দারুণ বলিষ্ঠ। কাকা শ্বশুর প্রখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে নিয়েও লিখেছেন তিনি। সুভাষচন্দ্র ও তাঁর স্ত্রী এমিলিয়ে শেঙ্কেল দুজনকে নিয়েই লিখলেন বই। চারবছর আগে বাংলা ও ইংরেজি ভাষাতে প্রকাশিত হয়েছে, নাম ‘এমিলিয়ে ও সুভাষ’।
প্রবল পরাক্রান্ত ব্রিটিশ সরকারকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছেন যে স্বাধীনতা সংগ্রামী তাঁর প্রেমের গল্প লিখেছেন কৃষ্ণা বসু। স্বাধীনতা আন্দোলন, আত্মত্যাগ, আজাদ হিন্দ বাহিনী গড়ে তুলতে দেশ থেকে বহুদূরে দিনের পর দিন বসবাস। তার মাঝেও নেতাজির জীবনে এসেছিল প্রেম। সেই প্রেমের বর্ণনা করেছেন কৃষ্ণা বসু। পরাধীন ভারতের বঙ্গ সন্তানের প্রেমিকা অস্ট্রিয়ান মেম, ভাবা যায়! লিখলেন ‘লস্ট অ্যাড্রেসেস’, শুধু বসু পরিবারের বধূ নন, শিক্ষাবিদ, প্রাক্তন সাংসদ, লেখিকার বাইরেও কৃষ্ণা বসুর ভিতরে বসবাস করত এক বালিকা। একেবারে পূর্ব বাংলার ছটফটে কিশোরী। তাঁর বেড়ে ওঠা, শৈশব, কৈশোরকাল। যার সঙ্গে জড়িয়ে অবিভক্ত বাংলার কত স্মৃতি। ময়মনসিংহের চৌধুরীরা বর্ধিষ্ণু পরিবার।
একান্নবর্তী পরিবারে কেটেছে মেয়েবেলা। উচ্চশিক্ষার জন্যেই চলে এলেন কলকাতায়। তখনও দেশ স্বাধীন হয়নি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজস্ট্রিট ক্যাম্পাসে শুরু হল পড়াশোনা। পড়তেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। সেখান থেকেই ইংরেজি সাহিত্যে এমএ করলেন। এটি তাঁর জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়। এরমধ্যে ইংরেজরা লটবহর বেঁধে বিলেতের উদ্দেশে জাহাজে চড়ে বসেছে। ঢাকার তরুণী হয়ে গেলেন কলকাতার বসুবাড়ির পুত্রবধূ। জীবন কখন কাকে কোন খাতে বয়ে নিয়ে যাবে, ভাগ্য হয়তো আগেই ললাট লিখন করে দেয়। কিন্তু তা আগেভাগে দেখার সৌভাগ্য মানবজাতির নেই। জীবন সায়াহ্নে এসে দুই বাংলায় কাটানো স্মরণীয় মুহূর্তগুলিকে লিপিবদ্ধ করলেন কৃষ্ণা বসু। বাদ গেল না শিশির কুমার বসুর সঙ্গে তাঁর বিয়ের সময়কালও। ফেলে আসা দিনগুলিকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছেন, হারানো ঠিকানাকে তাই বইয়ের পাতায় বন্দি করলেন
নেতাজিকে নিয়ে বেশ কয়েকখানি বই লিখেছেন, ‘ইতিহাসের সন্ধানে’, ‘প্রসঙ্গ সুভাষচন্দ্র’, ‘চরণরেখা তব’। এই তিনটি বাংলাতে। ‘চরণরেখা তব’ দুটি পর্বে। ‘নেতাজি’ ইংরেজি ভাষাতে প্রকাশিত। স্বাধীনতা নিয়ে লিখলেন ‘স্মৃতি বিস্মৃতি’, স্বামী শিশির কুমার বসুকে নিয়ে লিখলেন ‘অ্যান আউটসাইডার ইন পলিটিক্স’। কবিগুরু তাঁর জীবনখানিও ঘিরে ছিলেন। তাইতো ২০১৫-তে লিখলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বড় হয়ে ওঠা’, ‘এক নম্বর বাড়ি’, ‘যে তরণী খানি’, ‘বুম্বিটোর অ্যাডভেঞ্চার’ । আরও পড়ুন- এলগিন রোডের বসুবাড়িতে বিষন্নতার সুর, প্রয়াত কৃষ্ণা বসু
যাঁর কলমে এমন মণি মুক্ত ঝরে তিনি তো প্রেমের পুজারীই হবেন। শৈল্পিক মন প্রেমের দিশারী। কলকাতায় ইংরেজি সাহিত্যে এম এ করতে এসে পরিচয় হয়ে গেল সুভাষচন্দ্র বসুর ভাইপো শিশির কুমার বসুর সঙ্গে। তিনি তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, আর শিশির বসু পড়ছেন মেডিক্যাল কলেজে। পরিচয় প্রেমে রূপান্তরিত হতে সময় লাগেনি। বসুবাড়িতে কৃষ্ণা চৌধুরীর আগমনের সময় দ্রুতই চলে এল। ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল তাঁদের। ঢাকার মেয়ে কলকাতার বধূ হয়ে গেলেন। বসুবাড়িতে থেকেই তাঁর কেরিয়ার একটু একটু করে সমৃদ্ধ হয়েছে। সিটি কলেজে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন। আটবছর অধ্যক্ষও ছিলেন। তিনবার লোকসভার সাংসদ হয়েছেন। বিদেশ মন্ত্রকের দায়িত্ব সামলেছেন দীর্ঘদিন। আরও পড়ুন- স্মৃতিটুকু থাক…
ভারত যেদিন স্বাধীনতা পেল সেদিন দিল্লির বুকে সাইকেল চালিয়ে ঘুরেছিলেন কৃষ্ণা বসু। কাকা ভাইপোর সম্পর্ককে অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন। তাই এমিলিয়ে শেঙ্কেল যতদিন বেঁচেছিলেন, নিয়ম করে জার্মানিতে গিয়েছেন। নেতাজির মেয়ে অনিতা পাফ কৃষ্ণা বসুর বড় আদরের। গুমনামি বাবা, থেকে শুরু করে আরও কত মিথ নেতাজিকে জড়িয়ে আছে যে তার ইয়ত্তা নেই। জাপানে বিমান দুর্ঘটনাতেই নেতাজির মৃত্যু হয়েছিল। জীবন সায়াহ্নে এসেও কৃষ্ণা বসু এই সত্য থেকে সরেননি। কাকা শ্বশুরের প্রেম নিয়ে লেখালিখি করে নেতাজি ভক্তদের বিরাগভাজন হয়েছেন, কিন্তু কখনওই সত্য থেকে গা বাঁচিয়ে চলেননি। বসুবাড়ির অন্দরমহলে তিনিই প্রথম দক্ষিণা বাতাস নিয়ে আসেন। ময়মনসিংহের চৌধুরীরা যে বসুবাড়ির থেকে কম যান না, তা বোঝাতে কখনওই দ্বিধা করেননি। তিনি তো বাঙালির সম্পদ, তাঁর চলে যাওয়া এক অপূরণীয় ক্ষতি।