Kalki

কালান্তরের পটভূমি

সুণীপা

আলো আঁধারিতে ছেয়ে আছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিশাল হলঘর৷ ঘরের একেবারে মাঝখানে রাখা বড় গোল টেবিল ঘিরে বসে আছেন আটজন। প্রত্যেকেই বয়েসের ভারে ন্যুব্জ। তারমধ্যে একজন আপাদমস্তক চাদরে ঢেকে বসে আছেন। দ্বিতীয় জনের উন্মুক্ত দেহে শুধুই উত্তরীয় সম্বল। তৃতীয় জনের পরণে সাফারি স্যুট। চতুর্থ জন পরে আছেন দক্ষিণ ভারতীয় ধাঁচে সাদা লুঙ্গি, ফতুয়া৷ বাম কাঁধে শোভা পাচ্ছে  উত্তরীয়৷ মৃদু আলোয় যেখানে সবাই ঠিকভাবে দৃশ্যমান নন, সেখানেই কিনা কালো চশমায় চোখ ঢেকেছেন পঞ্চম জন৷ পরণে ফুলহাতা কালো শার্টের সঙ্গে চাপা ট্রাউজারে অদ্ভুত লাগছে তাঁকে। আর একজন ধুতি চাদরের ঘরোয়া পোশাকে নিজেকে সাজিয়েছেন। সপ্তম এবং অষ্টম জনের পোশাক মোটামুটি এক, গেরুয়া ধুতি ও ফতুয়া৷

পোশাকের বৈচিত্র্যের সঙ্গে মানানসই ব্যাতিক্রমী চেহারা৷ বর্তমানে গড়পরতা মানুষের যা উচ্চতা তাঁর থেকে এঁরা তিনগুণ দীর্ঘদেহী৷ বয়সের ভারে সে উচ্চতা কতকটা নিম্নমুখী৷ তবে তাতে কী, ভিড়ের মধ্যে থেকে এই আটজন একেবারেই নজরকাড়া৷ জায়গাটি কেরালার আলুভা। ওনম উৎসব এসে পড়েছে৷  চারিদিকে সাজো সাজো রব। আলোর রোশনাই, ঘরে ঘরে তোড়জোড়। কিন্তু এই হলঘরটি যে বাড়িতে, সেখানে উৎসবের লেশ মাত্র নেই৷ বাড়ি না বলে ছোটোখাটো প্রাসাদ বলাই ভাল। তবে আলো যতটুকু রয়েছে তা এই হলঘরেই৷ প্রাসাদোপম বাড়িটিকে ঘিরে রেখেছে নারকেল গাছ৷ সুরক্ষাবলয় হিসেবে সামনে সুবিশাল গেট৷ আলুভাতে এমন কোনও লোক নেই যে এই বাড়িটাকে চেনে না৷


আলুভা মহাদেব মন্দিরের ঘণ্টায় এ বাড়ির কর্তা ঘুম থেকে ওঠেন। ওহ হো এখনও তো পরিচয়টাই দেওয়া হয়নি, এ বাড়ির কর্তা হলেন আলুভা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারের প্রধান মাধবন মেনন। সময়ের প্রয়োজনে এই নামেই তিনি পরিচিত। পারমাণবিক, জৈবিক বা যেকোনও আগ্নেয়াস্ত্রের খুঁটিনাটি এঁর নখদর্পণে। শুধু তাই নয়, এমন অনেক অস্ত্র সম্পর্কে তিনি অবগত যার খবর অন্যরা জানে না। এই বিশাল হলঘরটা তাঁর বাড়ির আন্ডার গ্রাউন্ডে। মাধবন মেনন ও উপস্থিত বাকি সাতজন ছাড়া কেউই এই ঘরের অস্তিত্ব জানেন না। হলঘরের পাশেই রয়েছে ওঁর নিজস্ব অস্ত্রের সংগ্রহশালা। আজ এক বিশেষ উদ্দেশ্যে আটজন সেই গোপন কক্ষে একত্র হয়েছেন৷ আরও পড়ুন-স্রোতের গন্ধ

খালি গায়ে উত্তরীয় সম্বল করে যে ভদ্রলোক বসে আছেন, তাঁর চোখে মুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি ছড়িয়ে আছে। তিনি এসেছেন অযোধ্যা থেকে৷ নির্জনে নিতান্ত সাদামাটা জীবন যাপনে অভ্যস্ত মানুষটির মুখের গঠন কিছুটা অদ্ভুত। বয়সের ভারে ন্যুব্জ। বিশেষ উদ্দ্যেশ্যে হলঘরে উপস্থিত হওয়া এই বৃদ্ধের নাম মারুতি রাম্ভক্ত। সাফারি স্যুটের ভদ্রলোকই হলেন গৃহকর্তা মাধবন মেনন। আপাদমস্তক ঢাকা ভদ্রলোকের মুখে যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট৷ খুব কষ্ট করেই বসে আছেন তিনি। চাদরটা কপাল ঢেকে, ভ্রু পর্যন্ত টানা। আলো আঁধারিতে দৃশ্যমান মুখটুকু দেখলে শিউরে উঠতে হয়। ইনি এসেছেন মধ্যপ্রদেশের আসিরগড় থেকে। আত্মগোপন করে এখানে আসাটা তাঁর কাছে বেশ কষ্টকরই ছিল। ইদানিং ইনি নিজেই নিজের নাম ভুলতে বসেছেন৷ আসলে নাম ধরে ডাকার কেউ থাকলে হয়ত বা মনে থাকত!


কালো চশমা পরা ভদ্রলোক এসেছেন সুদূর তুরস্কের ক্যাপাজেশিয়া শহর থেকে। সর্বদা অন্ধকার স্থানে থেকে তাঁর আলো সহ্য করার ক্ষমতা লোপ পেয়েছে। মহাবালী, ওনম উৎসব উপলক্ষে প্রতি বছর অনুগামীদের সঙ্গে মিলিত হতে তিনি একবার কেরালায় আসেন৷ ঘরোয়া ধুতি, ফতুয়া পরা ভদ্রলোক এসেছেন শ্রীলঙ্কা থেকে। এখানে এসে পোশাক বদলেছেন। শ্রীরঙ্গনাথনের উপাসক হিসেবেই নিজের পরিচয় দিয়ে থাকেন তিনি। দক্ষিণ ভারতীয় ধাঁচে লুঙ্গি ফতুয়া পরা ভদ্রলোকটি আবার অস্ত্রবিদ্যায় সুপারদর্শী। তবে তাঁর সবচেয়ে মহৎ গুণ হল নিরেপেক্ষ বিচার ক্ষমতা। দেশের শীর্ষ আদালতে বিচারপতি হিসেবে সুনাম অর্জনকারী এই ব্যক্তির নাম কৃপা।

অন্যদিকে গেরুয়া ধুতি ও ফতুয়া পরিহিত দু’জনের চোখে মুখে জ্ঞানের চিহ্ন স্পষ্ট। একজন প্রজ্ঞাবান লেখক, এসেছেন উত্তরাখণ্ড থেকে। নাম মার্কেন্ডেও। দ্বিতীয় জনের মতো সুলেখক ও জ্ঞানী এই ধরাধামে কমই আছেন বলতে পারেন। তিনি বেদব্যাস। হলঘরে উপস্থিত প্রত্যেকেরই বিশেষ গুণ হল নিজেদের লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখা। মৃত্যু এঁদের ছুঁতে পারে না, এঁরা চিরঞ্জীবী৷ বিশেষত এই মিলই আজ তাঁদের একত্রিত করেছে৷ কত যুগ, কত সাম্রাজ্যের সূর্য উদয় আর অস্ত দেখেছেন। মাঝে মাঝে এই মৃত্যুভয় হীন জীবনকে অভিশাপ মনে হয় তাঁদের। আরও পড়ুন-মা কাঁদছেন, বিসর্জনের সুর ছুঁয়ে যায় অভাগী মেয়ের আত্মকথন…

তবে এও সত্যি যে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে তাঁদের এই উপস্থিতিও এক বিশেষ উদ্দেশ্যবাহী। সেই উদ্দেশ্য পূরণের জন্যই তাঁরা একত্রিত হয়েছেন। জ্যোতিষের ভবিষ্যৎ বাণী অনুযায়ী সূর্য, চন্দ্র আর নক্ষত্রেরা সেই অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে, যেদিন ‘তাঁর’ আসার কথা। এই আটজনকে হতে হবে, ‘তাঁর’ কর্মের সাথী। এর আগে অনেকেই নিজেদের ‘তিনি’ বলে দাবি করেছেন৷ কিন্তু এই আটজনই একমাত্র জানেন, আসল সত্যটা কী! এখন থেকেই তাঁদের তৈরি হতে হবে৷ ‘তাঁকে’ রক্ষার দায়িত্ব ও যে তাঁদেরই। শুধু তাই নয়, যেটুকু সময় পাওয়া যায়, যতদিন পর্যন্ত না ‘তিনি’ নিজের উদ্দ্যেশ্য সম্বন্ধে অবগত হচ্ছেন, যতদিন পর্যন্ত না নিজেকে চিনছেন, ততদিন নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে সবদিক থেকে। সেই রূপরেখা তৈরি করতে আজকের এই সভা। ‘তাঁকে’ দেখতে পাওয়ার অনন্ত প্রতীক্ষায় প্রত্যেকেই আজ উত্তেজিত!


একমাত্র চাদর ঢাকা মানুষটি নির্বিকার৷ এই যুদ্ধের তিনিও এক সৈনিক, কিন্তু সায় নেই তাঁর। কিসের অপেক্ষা! যাঁর জন্য তাঁর আজ এই দুর্দশা৷ চিরঞ্জীবী হওয়াকে নিত্যদিন অভিশাপ ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না৷ তাঁর জন্য কিসের অপেক্ষা? প্রত্যেকদিন মহাদেবের অর্চনার শেষে, তিনি শুধু এই শাপ মোচনের আশীর্বাদ চান। উফ কি ভয়ংকর জীবন! অথচ ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ‘তাঁকে’ই সাহায্য করতে হবে তাঁকে৷ না করেই বা কি করবেন, উপায় নেই। তাছাড়া ‘তাঁর’ বিরুদ্ধে যাওয়া মানে শাপমুক্তির যেটুকু আশা ছিল তাও বিসর্জন দিতে হবে। মহাবালীও কী তাঁর এই অন্ধকারময় জীবনের জন্য ‘তাঁকে’ই দায়ী করেন না! তিনিও কী এই কর্মযজ্ঞে নিজেকে পূর্ণ হৃদয়ে সঁপে দিচ্ছেন! এত ভাবনার মাঝেও অশ্বত্থামা নিশ্চল, শান্ত। মনে মনে বাকি সাতজনের মতোই আগামীর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকেন।

শ্লোক, উত্তরপ্রদেশের মোরাদাবাদের একটা ছোট্ট সুরম্য স্থান। সুমান্থ, প্রজ্ঞা ও কাভি এই তিন জনের অত্যন্ত প্রিয় ও একই সঙ্গে মাথাব্যথার কারণ তাদেরই ছোট ভাই। সে যে শুধু এদের মাথাব্যথার কারণ তাই নয়৷ তাদের বাবা মা বিষ্ণু যশ এবং মাতা সুমতিরও চিন্তার উদ্রেককারী। অসম্ভব মেধাবী এই ছেলেটির গায়ের রং ঘোর কৃষ্ণবর্ণ৷ কিন্তু তার বুদ্ধিদীপ্ত দুষ্টুমিতে সে সবাইকে পাগল করে রাখে। রীতিমতো হাসি, মজায় বেড়ে উঠছে সে। তবে বাবা মা শিশুপুত্রকে নিয়ে গোপন উদ্বেগে থাকেন সর্বদা।


কুষ্ঠিবিচার করে জ্যোতিষী বলেছিলেন, ২৮ বছর বয়স পর্যন্ত এ ছেলেকে যথেষ্ট যত্নে রাখতে হবে। ১৮-র আগে প্রচুর বিপদ আসবে৷ যদিও সবকিছু থেকেই নাকি উদ্ধার পাবে ছেলেটি। আর ২৮ বছর বয়সের পরে ছেলেটির জীবনে ভীষণ বড় পরিবর্তন আসবে। সব কিছুই ওলটপালট হয়ে যাবে। তারপর আর কিছুই বলেননি৷ তবে এটুকুই, এরপর আর কিছুই বুঝছেন না। জানিয়েছিলেন, এরকম ছক আগে কখনও দেখেননি। তবে ছেলের কপালে বিশেষ চিহ্ন দেখে বলেছিলেন, “এটুকু বলতে পারি, এ খুব সহজ মানুষ নয়৷”

এমনিতে এখন সরকারের কাছে প্রতিটা মানুষের ডিএনএ স্যাম্পল রাখা থাকে। প্রতিটা মানুষ বাড়িতে যে নামেই পরিচিত হোক না কেন রাষ্ট্রের খাতায় সে একটা নম্বর বইতো নয়। এই ডিএনএ স্যাম্পল নিয়ে রাখার সময় যে গ্রাফ করানো হয়, তাই দেখে ছেলেটির বাবা মাকে ডেকে পাঠিয়েছিল সেন্ট্রাল ডেটা রিসার্চ কমিটি। এরকম অদ্ভুত ডিএনএ গ্রাফ তাঁরা নাকি কখনও দেখেননি। পরবর্তী পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন৷ তবে শিশু অধিকার আইনের সাহায্যে ছেলেটির বাবা মা তখন পর্যন্ত এই উদ্যোগকে রুখে দিয়েছিলেন। কিন্তু কতদিন যে পারবেন নিজেরাও জানেন না৷ তাই চিন্তায় থাকেন।


সর্বত্র এ ছেলে সবার আগে থাকে৷ অসম্ভব বুদ্ধিমত্তা। আইকিউ লেভল ১৬০৷ এটা জানাজানি হওয়ার পর নতুন বিপদ এসে উপস্থিত। আমেরিকান রিসার্চ সেন্টার ছেলেটিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল সেদেশে৷  এবারেও সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে বহু কষ্টে তাদের নিরস্ত করা গেছে। তাছাড়াও, বহু শিক্ষাবিদ, প্রাজ্ঞ, লেখক, এমনকী প্রধান বিচারপতি পর্যন্ত এ যাত্রায় তাঁদের পাশে ছিলেন৷

মাত্র সাত বছর বয়সে একবার অপহৃতও হয়েছিল ছেলেটি৷ সেদিন কীভাবে সে বাড়িতে ফেরে তা কেউই জানে না। শুধু ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে জানিয়েছিল, এক অতিবৃদ্ধ মানুষ ওকে বাঁচিয়েছে৷ তার নাকি একটা লেজও ছিল। যদিও তখন শিশুর কল্পনা ভেবে কেউ বিশ্বাস করেনি। এরপর ছোট বড়, নানা ঘটনার সম্মুখীন হয়ে চলেছে ছেলেটি৷ প্রতিবারেই কোনও না কোনও অদৃশ্য শক্তি তাকে রক্ষা করে চলেছে। এদিকে মা সুমতি গৃহদেবতা শালগ্রাম শিলার কাছে রোজ এই ছেলের বিপদ মুক্তির প্রাথর্না করেন। আরও পড়ুন-কাশের বনে লাগল দোলা, উমা আসে বাপের বাড়ি…

ছেলেটি স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে মেধার জোরে স্থান করে নিয়েছে বিজ্ঞানের গবেষণার কাজে। এখন সে পড়তে গেছে কেরালায়। সেখানে সে মাধবন মেননের ছাত্র ও সহকারী। ছেলেটিকে অস্ত্র গবেষণার পাশাপাশি, যুদ্ধবিমান, কারিগরি ও অস্ত্রশস্ত্রের উপরে নিরন্তর শিক্ষা দেন গুরু মাধবন মেনন। সেই সঙ্গে তিনি নিজের তত্বাবধানে তাকে সব ধরনের পারমাণবিক,জৈবিক,শারীরিক ও গোপন অস্ত্রের পাঠ পড়াতে থাকেন। বাকি সকলেই আলুভার সেই বাড়িতে শাস্ত্র, জ্ঞান-সহ বিভিন্ন বিষয়ে ছেলেটিকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শক্তিশালী করে তুলতে থাকেন।


ছেলেটির অসম্ভব মেধা, যেকোনও জিনিসকেই করায়ত্ব করে নিতে পারে খুব সহজে। পাশাপাশি যে কোনও বিষয়ে তার অসম্ভব আগ্রহ। মাঝে মাঝে ফোনে দাদা, দিদি, বাবা মায়ের সঙ্গে নতুন শিক্ষা নিয়ে আলোচনাও করে সেই ছেলে৷ তবে বাবা, মায়ের দুশ্চিন্তা একটুও কমে না। ছেলেটির আরও এক বিশেষ গুণ হল কারিগরি বিষয়ে অপরিসীম আগ্রহ৷ বিশেষত বিমান, যুদ্ধবিমান সব কিছু চালনাতেও সিদ্ধহস্ত সে। শিক্ষা সম্পূর্ণ হলে তাকে নিজস্ব সাদা যুদ্ধবিমানটি উপহার দেবেন বলেছেন গুরু মেনন। বিমানের ডানা গুলো সাদা, সম্মুখভাগ অশ্ব মুখাকৃতি। বিমানটির নাম দেবদত্ত। মাঝে মধ্যেই ছেলেটি গুরুর অনুমতি নিয়ে দেবদত্তকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। এ এক অনন্য অনুভূতি।

এখন ছেলেটির বয়স ২২। তার প্রথম পর্বের শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছে। এক বিশেষ কাজের দায়িত্ব দিয়ে গুরু মেনন তাকে শ্রীলঙ্কা পাঠাতে চান৷ সেখানে তার অভিভাবক হিসাবে থাকবেন সেই শ্রিরঙ্গনাথনের উপাসক বিভীষণ। এটা একটা ভীষণই গোপন ও গুরুত্বপূর্ণ মিশন। গোপনে ছেলেটিকে যেতে হবে শ্রীলঙ্কার এক বিখ্যাত ধনী পরিবারে। যাদের গোপন ব্যবসা হল অস্ত্রের চোরাচালান। সেখান থেকে এক বিশেষ অস্ত্র নিয়ে আসতে হবে ছেলেটিকে। এই প্রথম ছেলেটিকে এরকম কোনও দায়িত্ব দিলেন তার গুরু। স্বভাবতই ছেলেটি ভীষণ উত্তেজিত। মিশনে যাওয়ার জন্য নিজেকে সম্পূর্ণভাবে তৈরি করে নিয়েছে। ওই বাড়িতে অতিথি হিসেবে ওঠার সমস্ত বন্দোবস্ত বিভীষণ করবেন। আর গোপনে তাকে সাহায্য করবেন মারুতি। ছেলেটির সঙ্গী দুটি জিনিস। প্রথমটি তার প্রিয় বিমান দেবদত্ত৷ যাকে প্রাইভেট জেট বা প্রাইভেট যুদ্ধবিমান বললে অত্যুক্তি হয় না। সমস্ত অত্যাধুনিক সুবিধাযুক্ত, কিন্তু বাইরে থেকে এর আকৃতির জন্য যুদ্ধবিমান মনে হওয়ার কোনও কারণ নেই। দ্বিতীয়টি হল নিজের তৈরি রোবট পাখি ‘শুক’৷ যাকে দেখলে পোষা তোতা ছাড়া অন্যকিছু ভাবতেই পারবেন না। আদপে সে অত্যাধুনিক জিপিএস সম্বলিত রোবট৷ ছেলেটির এক ইশারাই ‘শুক’-এর জন্য যথেষ্ট৷ যে কোনও তথ্য মুহূর্তে দিতে পারে এবং আত্মরক্ষার সঙ্গী ও বটে। এ এক অনন্য আবিষ্কার। এই দুটো মাত্র জিনিস নিয়ে ছেলেটি রওয়ানা হলো শ্রীলঙ্কার উদ্দেশে।

আজ ভেল উৎসবে সমস্ত শ্রীলঙ্কা সেজে উঠেছে। ছেলেটির গন্তব্য সেই বিখ্যাত রয়্যাল ধনী পরিবারটিও আজ খুশিতে শামিল। তাদের বাড়িতে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ছেলেটি সেখানে প্রবেশাধিকার পেয়েছে একজন ঐন্দ্রজালিকের ছদ্মবেশে। ইন্দ্রজাল প্রদর্শনের সময় তার চোখ আটকে গেল রয়্যাল ফ্যামিলির পারিবারিক চেয়ার গুলোর দিকে। এক অসম্ভব সুন্দরী যুবতী সেখানে বসে আছে। প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ল ছেলেটি। কিন্তু কাজ শেষ করতে হবে৷ যে দায়িত্ব নিয়ে সে এসেছে, তাকে পূরণ করতেই হবে। একটা বিষয় সেও জানলো না যে মেয়েটিও সমান ভাবে লক্ষ্য করছে তাকে।


অনুষ্ঠান শেষে অতিথিদের জন্য নির্দিষ্ট ঘরে ছেলেটি বিশ্রামের জন্য গেল। সারাদিন প্রচুর ধকল গেছে৷  এবার একটু বিশ্রাম দরকার। তার সর্বক্ষণের অতন্দ্র প্রহরী ‘শুক’ থাকল পাহারায়। ঠিক সেই সময় ভুবন জোড়া রূপ নিয়ে মেয়েটি ঘরে ঢুকল। এই পরিবারের ছোট মেয়ে, পদ্মা। পদ্মার ঠাকুমা ছিলেন ভারতীয়৷  তিনি লক্ষ্মীর নামানুসারে নাতনির নাম পদ্মা রেখেছিলেন। পদ্মাকে আসতে দেখেই ‘শুক’ তার মনিবকে জাগাতে উদ্যত হল। পদ্মা বাধা দিল৷ তার চোখ তখন আটকে আছে বিছানায় শায়িত ছেলেটির দিকে। অনুষ্ঠানের শেষে এতটাই ক্লান্ত ছিল যে বেশভূষাও খুলতে ইচ্ছা হয়নি তার। কানে বড় দুল, গা ভর্তি অলঙ্কারের দ্যুতি। মেয়েটা তাকিয়েই থাকল।

যেন এই মানুষটার জন্যই তার এত অপেক্ষা! কিন্ত ভয় পেয়ে গেল পরমুহূর্তে৷ ইতিপূর্বে তার দিকে নজর দেওয়ায় বাবা ও দাদারা মিলে তিন তিনটে ছেলেকে নপুংসক হতে বাধ্য করেছে। এতটাই ভয়াবহ তাদের পরিবারের লোকেরা। সে ভয় পেল, এই ছেলেটিও যদি……!না না এ সে হতে দিতে পারে না। চোখে জল ভরে এলে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল সেই সুন্দরী। ঘুম ভাঙলে ছেলেটিকে সব বলল ‘শুক’। ছেলেটি বুঝল মেয়েটি তাকে চায়। ‘শুক’-কে আদেশ করল তার যোগাযোগের একটি নম্বর মেয়েটিকে দিয়ে আসতে। চাইলে সে অনায়াসেই হ্যাক করতে পারত মেয়েটির প্রোফাইল বা ডেটাবেস। যোগাযোগ রাখা ছেলেটির কাছে ছেলেখেলা মাত্র।

কিন্তু এই মুহূর্তে কাজ শেষের আগে কোনওভাবেই নিজের পরিচয় বা উদ্দ্যেশ্য প্রকাশ্যে এলে মুশকিল। তাছাড়া উল্টো দিকের মানুষগুলোকে বোকা ভাবার মতো ভুল সে করতে পারে না। ‘শুক’ ঠিকই খুঁজে নিল পদ্মার ঘর৷ তারপর তাকে গিয়ে ছেলেটির নম্বর দিয়ে আসা তো সময়ের অপেক্ষা। এরপর দুটি হৃদয়ের মিলন আর কথায় কথায় তাদের কাছে আসা। একান্ত সংগোপনে এই প্রেমের মধ্যেই অত্যন্ত সতর্কতায় ছেলেটি তার কাজটিও সম্পন্ন করল। আর মাত্র একবেলা সময়৷ এবার তাকে ফিরতে হবে৷  কিন্তু এ কদিনেই মেয়েটি যেন তার সবকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে৷ ফিরতেই যদি হয় ওকে নিয়েই ফিরবে। বাঁচবে না ওকে ছাড়া।


মেয়েটিও এই ডাক অগ্রাহ্য করতে পারে না। মাত্র তিনদিনের চেনায় কারো সঙ্গে এভাবে দেশান্তরী হওয়া যায়, একথা বোধহয় সে স্বপ্নেও ভাবেনি। অবশেষে ছেলেটির দেবদত্ত, ‘শুক’ ও পদ্মা পারি দিল আলুভার উদ্দেশে। এখানে তার কাজ শেষ হয়েছে। দেবদত্ত উড়ান দিলে, বিভীষণ আর মারুতি কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন।

সবটা শুনে হাসছেন মাধবন মেনন৷ এটাই তো হবার ছিল। এই অভিযান তো নিছক একটা ছুতো মাত্র। ছেলেটির পরিবারের সমস্ত দ্বিধাকে নস্যাৎ করে দিল পদ্মার রূপ, তাঁরা তাকে আপন করে নিলেন৷ বিয়ে করল দু’জনে। আজকাল বিয়ে কেউ করে না৷ সাধারণত লিভ ইনেই থাকে৷ আর সন্তান, সম্পত্তির ক্ষেত্রে আইনি ব্যবস্থা। সেখানে এতো কম বয়সে এই ছেলেটির বিয়ে হওয়ায় বিষয়টি চর্চার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়াল। এমনকী, সংবাদ মাধ্যমে সে খবর প্রকাশ পেলে পদ্মার বাড়িতে জানাজানি হতে বাকি থাকল না৷  এদিকে পদ্মার ভারতীয় ভিসা, আর তারপর যাবতীয় কাগজপত্র রাতারাতি তৈরি হয়ে গেল, অষ্ট চিরঞ্জীবীর মিলিত চেষ্টায়।


একদিকে গুরু মেননের তত্ত্বাবধানে অস্ত্র, যুদ্ধ প্রশিক্ষণ, গবেষণার পাশাপাশি চলল পদ্মার সঙ্গে সুখের ঘরকন্না৷ তিন বছরের বৈবাহিক জীবনে চার সন্তান, দু’জোড়া যমজ৷ চার সন্তানের নামকরণ হল যথাক্রমে জয় ও বিজয় এবং মেঘমাল ও বালহাক। সময় যেন পাখির ডানায় ভর করে উড়ে যায়৷   আজ ছেলেটির ২৮-তম জন্মদিন। এই বয়সেই সে চার সন্তানের দায়িত্বশীল পিতা। একই সঙ্গে কুশলী যোদ্ধা, তুখোড় বুদ্ধি ও ভাবনার অদ্ভুত মিশেল। গতকালই গুরু মেনন নিজ মুখে ছেলেটিকে শিক্ষা সম্পূর্ণ হওয়ার কথা জানিয়েছেন৷

জন্মদিন উপলক্ষে আজ সুন্দরভাবে সেজেছে তার বাসস্থান। সবাই খুশি, কিন্তু নিঃশব্দে অগোচরে ভাগ্যদেবী অন্য উপাচার সাজিয়ে উপস্থিত৷ যা ছেলেটিকে পরিচয় করাবে তার উদ্দেশ্যের সঙ্গে৷ তার নিজের সঙ্গে। আজকের পর থেকে কল্কি জানবে, কি তার কাজ। এদিকে আগামীর যুদ্ধে কল্কির সাথী হওয়ার জন্য তৈরি অষ্ট চিরঞ্জীব। সেই মাহেন্দ্রক্ষণ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে আকাশের নক্ষত্রেরা নিজেদের অবস্থান বদলাচ্ছে৷   জন্মদিনের উৎসব, হইচই, স্ত্রী, পুত্র, নিশ্চিন্ত সংসার জীবন ছেড়ে এবার কল্কিকে বেরিয়ে পড়তে হবে সত্য স্থাপনার এক অনন্ত যুদ্ধে।

Facebook Comments Box

Post Author: bongmag

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।