bongmag.com

স্রোতের গন্ধ

রাখী সরকার

মনসুর প্রতিদিনের মত আজও দুপুর থেকে ছিপটা ফেলে বসে আছে। আসার পর একটা ছোট সাইজের মহাশোল উঠেছিল। তারপর সব চুপচাপ। সূর্যের আলো আবছা হয়ে এসেছে। এক্ষুনি ঝুপ করে অন্ধকার নেমে পড়বে। পাহাড়ের এই এক রোগ। আলো আর অন্ধকারের মাঝে সূর্যদেব বেশি সময় থাকতে পারে না।
হঠাৎ মনসুরের নাকে ভেসে এলো এক মিষ্টি গন্ধ। অনেকটা সমতলের গন্ধরাজ ফুলের গন্ধের মতো। এই গারো পাহাড়ে অনেক রংবেরঙের ফুল আছে। কিন্তু এই আট-দশ বছরে কখনও গন্ধরাজফুল কোথাও দেখেনি। কোথা থেকে আসছে গন্ধটা? মুনসুর নিজের মনেই বলে উঠলো।

মনসুর ছিপ গুটিয়ে নদীর জলে হাত ভেজায়। দু হাতে জলের ঝাপটায় মুখটা ধুয়ে ফেলে। ঠিক তো, ওর দু হাতে লেগে আছে সেই মিষ্টি গন্ধটা। তবে কি জলের স্রোতের সাথে গন্ধটা ভেসে আসছে? মনসুর আবার দু’হাত ভরে জল তুলে নাকের কাছে নিয়ে বুক ভরে গন্ধটা টানে। আঃ কি যে মিষ্টি গন্ধ! যেন ডুবে যেতে মন চায়।
কোথা থেকে আসছে গন্ধটা। দেখার জন্য মনসুর নদীর পারের ছোট-বড় বোল্ডার পেরিয়ে স্রোতের উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করে। বেশ কিছুদূর হাঁটার পর মনসুর আবার দু’হাতে জল তোলে। না, এ জলে তো কোনও গন্ধ নেই। তবে কী কিছু ভেসে যাচ্ছিল জলে? সন্ধ্যা হয়ে গেছে প্রায়। নদীর আশপাশে আর তেমন কেউই নেই। ওপারে বড় বোল্ডার গুলোর কাছে দু’জন স্নান করছেন বোধহয়। আরও পড়ুন-Shankha Ghosh:“আমার বলে রইল শুধু, বুকের ভিতর মস্ত ধু ধু”

মনসুর প্রতিদিন নিজের ছিপটাকে এই বিরাটাকৃতির বোল্ডারের ফাটলের মধ্যে লুকিয়ে রেখে যায়। বাড়ি নিয়ে গেলেই বাবা ছিপটা ভেঙে দেবে। বাবা বলেন এতো বড়ো ছেলে দোকানে না বসে রাতদিন ছিপ নিয়ে পড়ে থাকে। কোনও দিন ওই নদীই খাবে তোকে। নদী আবার মানুষ খাবে! মনসুর মনে মনে হাসে। ছিপটা ফাটলের ভিতরে  ঢুকিয়ে মনসুর বোল্ডারটার উপরে উঠে বসে। এত হাওয়া এখানে। সে হাওয়ায় মনসুর বাবার সব খারাপ কথা ভুলে যায়।

হঠাৎ মনসুরের নাকে আবার সেই মিষ্টি গন্ধ ভেসে এল। এবার আগের থেকে আরও তীব্র আরও সুমিষ্ট। মনসুর আর বসে থাকতে পারল না। নেমে নদীর কিনারে এসে নদীর স্রোতে হাত ডোবাল। হাত দিয়ে জল তুলে নাকের কাছে ধরল। কি অদ্ভুত গন্ধটা! নিজেকে যেন কেমন মাতাল মাতাল মনে হতে লাগল।


মনসুর নদীর জলে পা ছোঁয়ালো। পাহাড়ি নদীর জল সন্ধ্যার সময় বেশ ঠাণ্ডা হয়। কিন্তু আজ জলটায় মনসুরের গায়ে যেন বেশ আরাম বোধ করালো। হঠাৎ মনসুরের  ইচ্ছে হল এই গন্ধটার মধ্যে ডুবে যায়। নদীর জল মনসুরের দু’গাল স্পর্শ করলে আচমকা খেয়াল হল, তার নিঃশ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। মনসুর খেয়াল করল, সে মাঝ নদীতে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রচন্ড স্রোত তাকে ডুবিয়ে দিতে চাইছে। সাঁতার কাটতে চেষ্টা করল। কিন্তু সে হাত-পা কিছু নাড়াতে পারলো না। যেন মনে হচ্ছে কেউ ওকে চেপে ধরে আছে। বুঝতে পারছিল পাহাড়ি ঠাণ্ডা জলের স্রোত ওর মাথার উপর দিয়ে বয়ে চলেছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল মনসুরের।

পাহাড়ে বেড়ানোর আবদার মেটাতে সমর এবার আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে এল। স্কুলের গরমের ছুটি কাটানোর জন্য মেঘালয়ের গারো পাহাড়ে ১৫ দিন থাকতে পারা, আমার মতো কলকাতার মেয়ের কাছে সৌভাগ্যের ব্যাপার। যদিও সমর বেশিরভাগ সময়ই ব্যবসার কারণে এই গারো পাহাড়ে থাকে। তবে চাকরির জন্য আমার তেমন আশা হয় না ।
নাঙ্গল গারো পাহাড়ের একটা ছোট্ট গ্রাম। চারিদিক ঘিরে রয়েছে বড়ো বড়ো ন্যাড়া পাহাড়গুলো।আর মাঝের সমতলটায় নাঙ্গল বাজার। সমরের হাতে আমাকে ঘোরানোর মতো সময় নেই। অগত্যা নিজেই নিজের সহায় হলাম। তিনটের দিকে বেড়িয়ে পড়তাম পাহাড়ের পথে। কখনও নদীর উপরকার সেতু পার করে ওপারে বড়ো বড়ো বোল্ডারে গিয়ে বসে থাকতাম। কখনও বা পাহাড়ের পিছনের দিকটায় চলে যেতাম।
কখনও বসে থাকতাম নদীর পাড়ের বড়ো পাথরে। যে নদীটার কথা বলছি, তা ঠিক সমরের এখানকার আস্তানার নিচেই। বিশাল এক খরস্রোতা পাহাড়ি নদী তার গর্জন-সহ অনবরত বয়ে চলেছে। সমরের মুখে শুনেছি নদীর নাম সিমসাঙ। এই নদীর পারটা আমার কিন্তু ভীষণ পছন্দের জায়গা। দু’পারেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ছোট-বড় বিভিন্ন মাপের বোল্ডার। তার সঙ্গে কাচের মতো স্বচ্ছ জল সাদা ফেনা তুলে ছুটে চলেছে। দেখলেই স্নান করতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু স্রোতের বেগ দেখে মনে একটু ভয় ভয়ও করে। আরও পড়ুন-ক্যানভাসে বৃষ্টির রাত, প্রহর জাগে ১৪ ফেব্রুয়ারি

সেদিন সমর গিয়েছিল ব্যাংকের কাজে। আমি মনে মনে ভাবলাম। নদীতে আজ স্নানটা সারাই যায়। সমর থাকলে কিছুতেই যেতে দেবে না। তাই তোয়ালে আর মগ নিয়ে পাহাড়ি পথ ধরে নেমে পড়লাম। বেলা প্রায় একটা দেড়টা হবে। এই দুপুরের সময় নদীতে প্রায় কেউ নেই বললেই চলে। আমি নদীর কিনারে একটা বড় পাথরের উপরে বসলাম।

এই দুপুরেও হাওয়াটা ভীষণ ঠাণ্ডা। নদীর জলে পায়ের পাতাটা ছোঁয়ালাম। বেশ ঠাণ্ডা জল। পাহাড়ি নদী বলে কথা। পায়ে পায়ে নদীর জলের সঙ্গে খেলা করছিলাম। হঠাৎ নাকে এল একটা মিষ্টি গন্ধ। কি ফুলের গন্ধ এটা? এত মিষ্টি গন্ধটা। আমি নদীর জলের দিকে তাকালাম। সূর্যের আলো পড়ে নদীর জল ঠিক যেন হীরের মতো চমকাচ্ছে। গন্ধটা ধীরে ধীরে বাড়ছিল। আমার মনে হচ্ছিল গন্ধটার মধ্যে ডুবে যাই। একটা অদ্ভুত মাদকতা গন্ধটায়। হাতে করে কিছুটা জল তুলে নাকের কাছে ধরলাম। আঃ কি মিষ্টি! কি অদ্ভুত গন্ধটা!

হঠাৎ সমরের ডাকে ঘোরটা ভাঙলো। পিছনে তাকিয়ে দেখি উপরের রাস্তা থেকে সমর চিৎকার করে আমার নাম ধরে ডাকছে। আমি হাত দেখালাম। মগে করে কয়েক মগ জল ঢেলে নিলাম গায়ে। ফিরে এলাম। নদীতে স্নানে যাওয়ায় সমর খুব বকাবকি করল। এরপর আর কোনওদিন স্নানে যায়নি ঠিকই তবে বিকেলে নদীর পারে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেছি৷


সেদিনের  ঘটনার পর থেকে নদীর ধারে কাছে যাওয়া বন্ধ হলো৷ সেদিন আমার সঙ্গে যা ঘটেছিল তা মনে হলেই হৃৎপিণ্ডটা যেন থমকে যায়। প্রতিদিনের মতো সেদিনও বিকেলে নদীর পারে বোল্ডারের উপরে বসেছিলাম। দুপুরে খাবার সময় সমরের সাথে কথা কাটাকাটি হওয়ায় মনটা একদম ভাল ছিল না৷   অন্যদিন হলে সন্ধের একটু আগেই ফিরে যাই। সেদিন আর গরে ফিরতে মন চাইল না।

পছন্দের বড়ো বোল্ডারের উপরে উঠে বসলাম। নদীর জলের শব্দ ছাড়া আশপাশে কোনও শব্দ নেই। জলের ঠাণ্ডা হাওয়াটা মন ভাল করে দেয়। হঠাৎ নাকে ভেসে এলো আগের দিনের সেই গন্ধ। আমি গন্ধটার কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। আজ গন্ধ আরো তীব্রতর। আমি বুক ভরে টেনে নিচ্ছিলাম। কি অদ্ভুত গন্ধ! কলকাতায় অনেক ফুলের গন্ধ শুঁকেছি। কিন্তু এই গন্ধ একেবারে আলাদা। হয়তো সবচেয়ে বেশি মিষ্টি।
মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত আনন্দ আর দুচোখে মায়া কাজল। মনে হচ্ছিল এ গন্ধে আমি ডুবে মরি। বোল্ডার থেকে নেমে নদীর কিনারে এলাম। হাত দিলাম স্রোতের মধ্যে, কিছুটা জল তুললাম। জল নাকের কাছে নিতেই গন্ধের আবেশে মনে হল পাগল হয়ে যাব। আমার ভীষণ নদীতে নামতে ইচ্ছে হচ্ছে। আবার স্রোতের মধ্যে হাত ডুবিয়ে জল তুললাম। দু’গালে চোখেমুখে জলটা বোলালাম। মন বলছিল, জলে নাম৷   গন্ধে ডুবে মর। আরও পড়ুন-“আজ প্রাতে আমার জন্মদিন উৎসব”

আমি আবারও হাতটা দিলাম স্রোতের মধ্যে। আচমকা জলের মধ্যে থেকে কিছু একটা আমার হাতটা টেনে ধরল৷ আমাকে সজোরে জলের মধ্যে টানতে থাকলো। আমি আরেক হাত দিয়ে পাশের পাথরটাকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে চিৎকার শুরু করলাম। ওদিকে স্রোতের ভিতর থেকে কেউ যেন তীব্র শক্তিতে  আমাকে টানতে শুরু করল।
চাঁদের আলোয় নদীর জল চকচক করছে। আমি চেষ্টা করেও জলের ভিতর কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। প্রচণ্ড টানে শরীর যেন ছিঁড়ে পড়ছে৷ মনে হচ্ছিল এবার নদীর স্রোতে ভেসে যাব। দেখতে পেলাম উপরের রাস্তা বেয়ে কয়েকজন টর্চ হাতে ছুটে আসছে। সমরের নাম ধরে চিৎকার করলাম। শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে পাথরটাকে আঁকড়ে ধরে রইলাম। ওদিকে স্রোতের বেগ যেন দ্বিগুণ হয়ে উঠল। স্রোতের অতলের জীবটা যেনতেন প্রকারেণ আমাকে জলে টেনে নামাবে।

দেখতে পেলাম টর্চের আলোটা আমার একদম কাছে এসে পড়েছে। আর ধরে রাখতে পারছি না, হাতটা আলগা করলাম। তারপর কিছু মনে নেই। পরের দিন ঘুম ভাঙলে দেখি বিছানায় শুয়ে। হাতের পাতায় ব্যান্ডেজ। কব্জির উপরটায় বেশকিছু আচরের দাগ। মাথাটা এখনও ঝিমঝিম করছে।


সন্ধ্যায় সমরের পরিচিত বেশ কয়েকজন গ্রামের বয়স্ক ভদ্রলোক এলেন। সমরের কাছে তাঁরা সব শুনেছেন৷ তাঁদের মধ্যে একজন আমায় বললেন, মাঈজি আপনিতো কলকাতার মেয়ে। আমাদের এসব কথা হয়তো বিশ্বাস করবেন না। তবে এ নদী অভিশাপের নদী। প্রতিবছর এ নদী একজনকে খাবেই। পাশের ভদ্রলোককে দেখিয়ে বললেন। এ রমজান আলি। গেল বছর নদীটা এর ছোট ছেলে মনসুরকে নিল। লাশ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। আপনার ভাগ্য ভাল মাঈজি, বেঁচে ফিরে এসেছেন।

শুনেছি এ নদী যাদের টানে তারা নাকি স্রোতের গন্ধ পায়। সে গন্ধে মানুষ পাগল হয়ে ছুটে যায় নদীর বুকে। মাঈজি আপনার এখানে আর না থাকাই ভাল। একটু সুস্থ হতেই সমর আমাকে কলকাতায় নিয়ে আসে৷ এরপর সময় বয়ে গেছে কিন্তু সেদিনের সন্ধ্যার সেই গন্ধ, আমার নাকে একটুও ফিকে হয়নি৷   তা কী সত্যিই স্রোতের গন্ধ! নাকি কোনও অশরীরী শক্তির মৃত্যুফাঁদ?

Facebook Comments Box

Post Author: bongmag

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।