Valentines Day

ক্যানভাসে বৃষ্টির রাত, প্রহর জাগে ১৪ ফেব্রুয়ারি

একটা আদা চা, রঘু দা। মাথাটা খাটো করে ঝুপড়ির দোকানে মুখটা দেখিয়েই চটপট বাড়ির দিকে এগোতে থাকে নীলু। ঠান্ডা একেবারে পাঁজরের হাড় কটাকেও কাঁপিয়ে দিল। ছাতাটা সঙ্গে ছিল তাই মাথাটুকু বেঁচেছে। সে যাইহোক এখন গায়ে একটু গরম জল ঢেলে যতক্ষণ না বসছে ততক্ষণ শান্তি নেই। অন্ধকারেই কোনওরকমে হাঁচরপাঁচর করে চাবিখানা খুঁজে পেল। মান্ধাতার আমলের বাংলো, কত যে তার তালা। সবকটা খুলতে গেলে হাত ব্যথা হয়ে যাবে। ভাগ্যে রঘুদা ছিল, তাই নিয়ম করে বাড়ির যত্ন আত্তি হয়। স্নানে যাওয়ার আগে মোমবাতিটা জ্বালল নীলু। ঘড়ির কাঁটা সাতটা ছুঁই ছুঁই, এই পাহাড় জঙ্গলের দেশে মনে হচ্ছে গভীর রাত।

দিন দুয়েক ধরে যা বৃষ্টি শুরু হয়েছে তাতে বন্যা না হয়ে যায়। পৌষের শীতে এমন বৃষ্টি নীলু আগে দেখেনি, মাথাটা মুছতে মুছতে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মুখে কি দুএকটা বলিরেখা পড়েছে? আলো আঁধারিতে ভাল করে দেখতে পায় না। বৃষ্টি শুরু হতেই তিনপুলের গায়ে যে জারুল গাছটা ছিল সেটা ভেঙেছে। হড়পা বানে শিকড় থেকে আগেই মাটি ধুয়েছে। বয়সের ভারে এমনিতে কাহিল, তায় এমন অকাল বর্ষণে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। একেবারে ভাসিয়েই নিয়ে গেল। এবার নীলুর ঠোঁটে খেলা করে যায় চিলতে হাসি, বাহারি মোমবাতির আলোয় চোখ হাসল নাকি চিবুক নড়ল, বোঝা গেল না। আর ঠোঁটের উপরের ওই তিলটা, যার জন্য এই অজগাঁয়েও___


ভাবনাটা সম্পূর্ণ হল না। হরি ডাকছে দিদি-গোও, এই ছেলেটাকে নিয়ে আর পারা যায় না। হরি, বছর বারো তেরোর কিশোর। দেখলে আরও বাচ্চা মনে হয়। অপুষ্টি ওর কৈশোরকে শৈশবেই আটকে রেখেছে। খালি গায়ে যখন স্নান করতে যায়, তখন কণ্ঠার হাড় দেখলে মনে হবে ৭০ বছরের স্বাধীনতা একটা বিদ্রূপ ছাড়া আর কিছু নয়। রঘুদা গড়চৌলির হাটে গিয়েছিল মাসের বাজার করতে। সেখানেই কেঁদে কেঁদে ঘুরছিল হরি। সিলারি গাঁও থেকে যে ভুটিয়া পরিবার সওদা করতে আসে, তারাই জানাল হরির কেউ নেই। বাবা-মা আছে কি না তা-ও জানে না। হাটে এক বুড়ি পানমশলা বিক্রি করত, হরি তার সঙ্গেই থাকতো। পৌষের শীতে বুড়ি চোখ বুজেছে, হরির আর দেখার কেউ নেই। হাটের দুদিন খাওয়া জোটে, বাকিটা সময় কী করে কে জানে। রঘুদা ছাইপাঁশ চিন্তা করে হরিকে সঙ্গে নিয়ে এল।

প্রথমটায় নীলুর ভাল লাগেনি। কার না কার ছেলে, কোনদিন কে এসে দাবি করবে। যদি রঘুদাকে কেউ ছেলেধরা ঠাওরায়! তাছাড়া নীলুও তো সবসময় এখানে থাকে না। রঘুদার বয়স হয়েছে, পরে ভেবে দেখল এই ভাল হয়েছে। তিনকুলে তো কেউ নেই। এখানেই থাকুক। অন্তত খেতে তো পাবে। রঘুদার কাছে কাজ শিখলে পরে নিজের মতো কিছু করে খাবে। মিশনারির ডাক্তারবাবুরা এলে একবার হরিকে নিয়ে যেতে হবে। খেতে না পেয়ে ছেলেটার টিবি হল কি না দেখার দরকার। ‘এ কি, চা কই রে? দাদু বললে এখন মোমো খাও। নতুন করে চা বসালে দে যাব। ফুটোনো চা খেয়ে তোমার কাজ নেই’। সেই বারোটা নাগাদ লাঞ্চ সেরেছে তারপর থেকে পেটে কিছু পড়েনি। ধোঁয়া ওঠা মোমোর প্লেট দেখে খিদেটা চাগাড় দিল।



ইনভার্টারটা খারাপ হয়ে পড়ে আছে। শীতকাল বলে রঘুদা তেমন গা করেনি। নীলুও বেশি বলেনি। কারেন্ট চলে গেলে রঘুদার চায়ের দোকানেও অন্ধকার নামে। তাই নিজের গরজেই সারাবে। কিন্তু নীলু কি ছাই জানত, ভরা পৌষে এমন বৃষ্টি হবে। একেবারে গাছ পড়ে তার ছিঁড়ে অন্ধকার। কাল সকালে ঝুম বাংলোতে একবার খবর পাঠাতে হবে, অবিনাশ থাকলে সারিয়ে দেবে। না থাকলে লাটাগুড়ি পর্যন্ত দৌড়, সে বড় ঝামেলার কাজ। দোকান বন্ধ রেখে রঘুদাকে যেতে হবে। দূরে একটা বাজ পড়ল, আচমকা কেঁপে গেল নীলুর ভেতরটা। কী এক অজানা ভয়ে বিছানায় উঠে বসে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখতে যায়, ১৪ ফেব্রুয়ারি। একটা বছর কেটে গেল? টেবিল ক্যালেন্ডারটা এখনও ২০১৯, তারিখ ১৪ ফেব্রুয়ারি। বসন্ত যেন সেখানেই থমকে আছে। পাতা ওল্টায়নি নীলু, পাছে দিনটা অতীত হয়ে যায়।

তারিখটায় আঙুল বোলাতেই ধুলো টের পায়। নীলুর ডাস্ট অ্যালার্জি, তাই কোটির মা নিয়ম করে ঝাড়পোঁছ করে। শুধু ওই টেবিলটা ছাড়া, নীলুর কড়া নিষেধ। তারিখটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে, লাল নীল হলুদ কত রঙ যেন উঁকি দিয়ে যাচ্ছে তারিখটাকে ঘিরে। হলুদ নীলুর প্রিয় রঙ, কিন্তু ও কেন রঙগুলোকে ছুঁতে পারছে না? আরও একবার তারিখটাকে ছুঁয়ে দেখে নীলু, এক বছরে এনিয়ে দ্বিতীয়বার, এই হাড় কাঁপানো ঠান্ডাতেও নাকের ডগায় বিজবিজে ঘাম, তিরতির করে কাঁপছে পাতলা ঠোঁট। চোখের কোণ বেয়ে কী জল গড়িয়ে পড়ল? নীলু কাঁদছে, পুরো নাম নীলাঞ্জনা সেন। পাঁচ ফুট আট ইঞ্চির ডাকসাইটে সুন্দরী নীলাঞ্জনা একজন নামী চিত্রশিল্পী। কনভেন্টের শিক্ষার সঙ্গে যতটা শহুরে আদবকায়দা থাকা উচিত সবটাই তার রয়েছে। শুধু বুকের মধ্যে থাকা খেয়ালি নীলাঞ্জনা যে একটা জংলী তা বাস্তবের নীলু প্রথমটায় টের পায়নি। দেহরাদুনে থাকার সুবাদে সেখানেই পড়াশোনা, হিমালয়ের রূপ এমন বশ করল যে রং তুলি ছেড়ে আর ওঠাই হল না। পাহাড়ের প্রেমে পড়ল নীলাঞ্জনা, প্রথম প্রেম। আরও পড়ুন-দোল এলেই ভয় হয়, উন্মত্ত জনতার ভিড়ে একলাটি শান্তিনিকেতন

ক্রিসমাসের ছুটিতে পরিবারের সঙ্গে এল উত্তরবঙ্গ দেখতে। প্রবাসী বাঙালি নিরঞ্জন সেনের বাবা ছিলেন কর্ণেল। সেনানায়ক হিসেবে কাশ্মীরেই কাটিয়েছেন, তাই অবসরের পরে চলে এলেন উত্তরবঙ্গে। লাটাগুড়ির কাছে এক বনবাংলোতে থাকতেন সেনসাহেব, পুরো নাম নীলাঞ্জন সেন। কাছেই একটি চাবাগানে মালিক তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে। বাগানের সীমানার বাইরে একটা বাংলোও ছিল, পরিত্যক্ত। খোঁজাখুঁজি করতেই মালিকের সন্ধান মিলল। চাবাগানে তালা পড়তেই শ্রমিকরা কাজ হারিয়েছে, এবার পেটের দায়ে স্বভাব খারাপ হবে। চুরি চামারি হলে বাংলোর একটা দরজাও আস্ত থাকবে না। মালিক বিক্রিবাট্টার জন্য লোক খুঁজছিলেন। আর সেনসাহেবের আস্তানার দরকার ছিল। তাই বাংলোর হাতবদল হয়ে গেল। মনের মতো করে সাজিয়েছিলেন, তারপর আমৃত্যু এখানেই থেকেছেন।



ছেলে নিরঞ্জন বা বউমা স্বপ্নার বাংলোর প্রতি কোনও টান নেই। শুধু ছোট্ট তিতি, মানে নীলু ছুটিতে এলে সে ভারী খুশি হত। ক্রিসমাসের ছুটিতে একবার মৌবন এলে আর ফিরতে চাইত না। নাতনির আনন্দেই বাংলোর হাতায় দোলনা ঝুলিয়েছিলেন সেনসাহেব। তারপর কালের নিয়মে তিতি একদিন বড় হল, সেনসাহেবও চলে গেলেন। বাংলোর ভার রেখে গেলেন তিতির কাঁধে, দেহরাদুন থেকে বিফাইন ও আমেদাবাদ আর্ট কলেজ থেকে এমফাইন করে সেই যে নীলু মৌবনে এল, আর ফেরেনি। ছুটিছাটা, প্রদর্শনীর জন্য বহুবার কলকাতা, দিল্লি, বেঙ্গালুরু, বিদেশেও যেতে হয়েছে। কিন্তু কাজের শেষে ফিরেছে এই মৌবনে। সেনসাহেব বাংলোর নাম রেখেছিলেন মৌবন, আর নাতনি জুড়েছিল তাঁর নামের সঙ্গে, নীলাঞ্জনা।

দাদু চলে যাওয়ার পর নীলু এখানেই থেকে গেল। রঘুদা আছেন তাই বাবা-মা বেশি ভাবেননি। দাদুর আমলের লোক, বয়স কত হয়েছে কে জানে, গ্রাম গাঁয়ের মানুষ তো, তাই চেহারায় বার্ধক্য তেমন বোঝা যায় না। একদিন ক্যানভাসে এমনিই আঁকিবুকি কাটছিল সে, মনটা অস্থির, হঠাৎ কীযেন মনে পড়ল। তারপর ঝড়ের গতিতে সাদা ক্যানভাসে তুলির আঁচরে ফুটে উঠল তার স্কুল। বাকিটা নীলু দেখতে পাচ্ছে, হায়ার সেকেন্ডারির রেজাল্ট নিয়ে খুশিতে উড়তে উড়তে আসছিল সে। বাবা বলেছে ভাল রেজাল্ট করলেই তাকে আর্ট কলেজে ভর্তি করে দেবে। গেটের মুখে বন্ধুরা একে একে বাই করে চলে গেল। রোহিত এসেছিল দরজা পর্যন্ত, রোহিত রাই, ওরা হিমাচলী। না, সে ছবি আঁকে না, যোদ্ধা হওয়ার স্বপ্ন দেখে। সেনা স্কুলের পরীক্ষায় দারুণ রেজাল্ট করেছে। দুদিন বাদেই দিল্লিতে চলে যাবে ট্রেনিংয়ে। তার আগে নীলুর সঙ্গে দেখা করতে এল, শেষ দেখা। আরও পড়ুন-ফেলে আসা মেয়েবেলা ও মন কেমনের বসন্ত উৎসব

গাড়িতে উঠে বসে নীলাঞ্জনা, জানলা থেকে বাড়িয়ে দেওয়া লাল গোলাপটা হাতে নেয়। রোহিতদের বাগানের। রবিবার বিকেলে খেলতে এলে একটা করে গোলাপ সঙ্গে আনত।  গাড়ি ছেড়ে দেয়, নীলুর বুকের মধ্যে চিনচিনে একটা কষ্ট জেগে ওঠে। রোহিতের মুখটা জানলার কাচে ঝাপসা হয়ে আসে। স্কুলটা দেখা যাচ্ছে, রাস্তাটা বাঁক নিতেই ছোট্ট হয়ে আসা রোহিত অদৃশ্য হয়ে যায়। তখনও জেগে স্কুলবাড়ির ছাদ। না, নীলু আর পিছনে ফিরে তাকায়নি। তাকে তো আঁকতে হবে, আর রোহিতকে যেতে হবে যুদ্ধে। যেখানে বুলেট আর বারুদের গন্ধে স্বপ্ন বোনা হয়। সেদিন গোলাপটা ডায়রির পাতায় আটকে দিয়েছিল নীলু। পাছে পাপড়ি খসে যায় তাই টেবিলে রাখার সাহস হয়নি। এরপর আর দেখা হয়নি।



নীলুর শিল্পীমন যখন জলছবিতে স্বপ্ন বুনছে, রোহিত তখন বারুদের গন্ধ নাকে নিয়েই রাত জাগছে। দিল্লিতে প্রদর্শনী ছিল সেবার। কলিগের সঙ্গে প্রদর্শনীতে এসেছিল রোহিত, হঠাৎ দেখা। দীর্ঘাঙ্গী সুন্দরী নীলাঞ্জনাকে চিনতে রোহিতের একটুও সময় লাগেনি। চোখের সামনে সুঠাম রোহিতকে দেখে শৈশব উঁকি মেরে যায় নীলুর মনে। সেই চোখ, সময় যেন থমকে গিয়েছে স্কুলের গেটে। আজও হাতে গোলাপ, তিতি ভাষা হারায়। চিনচিনে ব্যথাটা ফিরে এসেছে। নতুন করে প্রেম হয়নি, শুধু ব্যথাটা জানান দিলে নীলু বোঝে সে নয়, প্রেমে পড়েছিল তিতি। এরপর ঝড়ের বেগে তিনটে বছর কেটেছে, ফোনে মাঝেমধ্যে কথা হলেও দেখার ফুরসৎ দুজনেরই মেলেনি। শুধু ১৪ ফেব্রুয়ারিতে লালকালি দিতে বলেছিল রোহিত। বিকেলে ফোনও করবে। ফোনে রিমাইন্ডার দিতে বলতে পারত, নিজের মনেই হেসে উঠল নীলু। কী করে আর বলবে, তাদের হাসিখুশির দিনগুলিতে তো মোবাইলের নামগন্ধ ছিল না। ক্যালেন্ডারই সই, চেকপোস্টে একে ফর্টিসেভন জড়িয়ে ছিল রোহিত, নীলুর কানে আসছিল মর্টারের শব্দ। ফের গুলিগোলা শুরু হয়েছে।

বেশিক্ষণ কথা হয়নি, বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলে, ফোন কেটেছিল রোহিত। সেই ফোনটা আর আসেনি, ২০১৯-এ পুলওয়ামায় সিআরপিএফ কনভয়ে ভয়াবহ হামলা হল। রঘুদা পাশের গাঁয়ে বিয়েবাড়ির ভোজ খেতে গিয়েছে। প্রথমটায় যেতে চায়নি। রোহিত কী বলবে তা শুনতে ভারী উদগ্রীব ছিল নীলু, তাই একপ্রকার জোর করেই রঘুদাকে পাঠিয়ে দিল। এদিকে নেট ব্যালেন্স ফুরিয়েছে। কাছেপিঠে কোনও দোকানও নেই। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামল রোহিতের ফোন এল না। অভিমানে ভরে উঠল বুক। একবার ক্যালেন্ডারের পাতাটা ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করলেও কী ভেবে নিজেকে শান্ত করল। জানতেও পারল না বাইরের পৃথিবীতে কী ঘটছে।



মোমবাতিটা ফুরিয়ে এসেছে, পায়ে পায়ে বইয়ের তাকের দিকে এগিয়ে যায় নীলু। হাত বাড়িয়ে ডায়রিটা টেনে নেয়। হলদে হয়ে যাওয়া পাতায় কাঁচা হাতের লেখা ছুঁয়ে হেসে ফেলে সে। শুকনো গোলাপটা এখনও লেপটে আছে। পাশ থেকে গুঁড়ো গুঁড়ো কিছু পড়ল। পাপড়িতে হাত পড়তেই ফের কাঁপল নীলু। অত্যন্ত সাবধানে ডায়রির আদর থেকে হাতের তালুতে তুলে নিল গোলাপটা। বিছানায় উঠে বসেছে, গরম মোম গলে পড়ছে টেবিলে, তিরতিরিয়ে কাঁপছে অগ্নিশিখা, গালে গোলাপ ছুঁইয়ে ওম নেওয়ার চেষ্টা করে, ফিসফিসিয়ে কী যেন বলে। এত্ত বড় পৃথিবীতে একমাত্র স্মৃতি আঁকড়ে ধরে নীলু। ক্যালেন্ডারে ধুলো জমলেও জেগে থাকে প্রেম।

Facebook Comments Box

Post Author: bongmag

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।