Mahasweta Devi

লাঞ্ছিত “অরণ্যের অধিকার”, লালগড়ের পথে মহাশ্বেতা

Sukumar Mitra

সুকুমার মিত্র

“বন্দুক আর বুলেট, সেপাই দলে দলে, অন্য দিকে বিরশা জাগেন জঙ্গলে জঙ্গলে৷” জঙ্গলমহলে মহাশ্বেতা দেবী প্রসঙ্গে আলোচনার শুরুতে কবীর সুমনের গানের এই লাইনটি মনে পড়ে গেল। এরকমই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল জঙ্গলমহলে। আগুনের স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল আন্দোলন। সালটা ২০০৮। হরিপুর, সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম-বেয়াড়া। তৎকালীন বাম সরকারের শিল্পনীতির আস্ফালনকে তারা উচিত শিক্ষা দিয়েছে। শুধুই শিল্পনীতির বিরুদ্ধে সেই আন্দোলন ছিল না। আন্দোলন ছিল পরমাণু চুল্লির বিরুদ্ধে, কেমিক্যাল হাবের বিরুদ্ধে, উর্বর কৃষিজমি জোরপূর্বক কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে। অধিকার আন্দোলন ও পাশাপাশি পরিবেশ আন্দোলনের কাজটি যারা করল তারা গ্রামীণ শ্রমজীবী শ্রেণী-বাংলার কৃষিজীবী মানুষেরা।



প্রসঙ্গত, মহানগরীর উপকণ্ঠে রাজারহাটে ধুপির বিল, যাত্রাগাছির বিল ও ঘুনির বিল ভরাট করে নিউটাউন গড়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার হননি শহুরে পরিবেশ আন্দোলনকারীরা। ১৯৯৫ সালের ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসের দিন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু নিউটাউন প্রকল্পের শিলান্যাস করেছিলেন। তখনও রাজারহাট জমি বাঁচাও কমিটির নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। সেই আন্দোলনের জন্য কবীর সুমন অনুষ্ঠান করে তহবিলে টাকা দান করেছিলেন। তিনি গান বেঁধেছিলেন জমি নিয়ে। নিষিদ্ধ ইস্তাহার অ্যালবামে সেই গানটি যথেষ্ট সাড়া ফেললেও বাম সরকারের অনমনীয়, আগ্রাসী মনোভাবের কাছে গরিব, অসহায় কৃষকদের আন্দোলনে বিরোধী সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলির তেমন সমর্থন ছিল না। আরও পড়ুন-Kashmir: কাশ্মীর! এক বিভাজিত আখ্যান (তৃতীয় পর্ব)

তেভাগার গ্রাম বালিগুড়িতে লালফেট্টি মাথায় বেঁধে পুলিশের সাহায্যে কৃষকের জমির দখল নিয়েছিল বাম সরকারের সশস্ত্র ক্যাডারকুল। মাথায় লালফেট্টি বাঁধা হয়েছিল যাতে পুলিশের সাধারণ গ্রামবাসীদের উপরে হামলা করতে সুবিধা হয়। এইসব অনাচারের বিরুদ্ধে পরে মহাশ্বেতা দেবীও লিখেছেন। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে…। ফলে যা সর্বনাশ হওয়ার তা হয়েইছে। ফের কবীর সুমনের গানের কথা মনে পড়ে যায়, “ তখন কিন্তু কেঁদেও পাবে না একটু সবুজ ফিরে,/ধানের বদলে দুলবে হাওয়ায় বিশ্রি নকল হিরে/ সে হাওয়ায় শুধু অভিশাপ আর হাহাকার হাহাকার/ ইউসুফ আর বনমালীদের চিৎকারে একাকার৷”



সেই চিৎকার এখন উন্নয়নের পে-লোডারের শব্দে চাপা পড়ে গেছে। শহুরে রোশনাইয়ে তথাকথিত বিনোদনের একটি নতুন কেন্দ্র নিউটাউন। প্রকৃতি পরিবেশ বাস্তুতন্ত্র, জীববৈচিত্র্য, কৃষি, জলাভূমি ধ্বংস করে পরিবেশের নয়াপাঠ- “ইকো পার্ক”। ১৯৯৭ সালে উত্তর ২৪ পরগনায় গঠিত হয়েছিল নদী ও পরিবেশ উন্নয়ন সমিতির একটি বৃহৎ মঞ্চ। রাজারহাট জমি বাঁচাও কমিটিও এই মঞ্চে শামিল ছিল। সমিতির আন্দোলনের ইস্তাহারে তখন রাজারহাটে নিউটাউন গড়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার শুধু নয়, জমি বাঁচানোর লড়াইয়ের সঙ্গেও সাধ্যমতো থাকার চেষ্টা করেছে। আরও পড়ুনঅন্য ‘বিন্যাস’-এর লেখক বুদ্ধদেব গুহ

তবে কিছুই ফেলা যায় না। অরণ্যের অধিকারের লেখিকা মহাশ্বেতা দেবী এই সময়ের মধ্যে “মহা অরণ্যের মা” হিসেবে পরিচিত শুধু নয়, তাঁর “পশ্চিমবঙ্গ খেড়িয়া শবর কল্যাণ সমিতি”র আন্দোলন, চুনি কোটালকে নিয়ে আইনি লড়াই; জনজাতি সমাজে অন্য সম্মানের স্থান করে দিয়েছে। মহাশ্বেতা দেবীর “অরণ্যের অধিকার” তো প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৭ সালে। “অপারেশন বসাই টুডু”,পুরুলিয়া বন-সন্নিহিত আদিবাসী মানুষদের জীবন ও সমকালীন রাজনৈতিক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে রচিত “দ্রৌপদী”র মতোই সেরা গল্প।



সেই লেখিকা যখন লালগড়ের পথে মিছিলে হাঁটছেন, সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন, তখন জঙ্গলমহল বিরসা-মুণ্ডার নামে শপথ নিয়ে আন্দোলনে নতুন উদ্যমে রাজ্যের শাসক গোষ্ঠীর ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। শাসকদল ও বাম সরকার এতটাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল যে পরবর্তীকালের ঘটনাক্রম দেখলে তার একটা সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে৷ আরও পড়ুন-Shankha Ghosh:“আমার বলে রইল শুধু, বুকের ভিতর মস্ত ধু ধু”

২০০৮ সালের ২ নভেম্বর, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে রাজ্যের বাম সরকারের তখন স্লোগান, “কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যত৷” শালবনির জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে চলেছে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কনভয়। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রামবিলাস পাসোয়ান, জিতিন প্রসাদ। ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ ঘটল। মাওবাদীরা হামলার দায় নিয়ে জানাল, আদিবাসী জমিতে ইস্পাত কারখানা নির্মাণের বিরুদ্ধে এই বিস্ফোরণ। কিন্তু সেই মাওবাদীরা তো অধরা, অদৃশ্য…।



তবে, লালগড়ের জনপ্রিয় স্কুল শিক্ষক ক্ষমানন্দ মাহাত, বৃদ্ধা ছিতামনি মুর্মু বা গর্ভবতী মহিলা লক্ষী মাহাত এঁদের উপর হামলা অনেক সহজ। ৫ নভেম্বর ২০০৮ লালগড়ে ছোট পেলিয়া গ্রামে মধ্যরাতে ঘুম থেকে তুলে মাওবাদীদের ধরার অজুহাতে বৃদ্ধা ছিতামনি মুর্মুর চোখ উপড়ে ফেলা হয়। লক্ষী মাহাতর পেটে লাথি মারায় তাঁর গর্ভস্থ সন্তান মারা যায়। আর শিক্ষক ক্ষমানন্দ মাহাতকে মারধর করার পর কান ধরে ওঠবোস করানো হয়। এসবই বাম আমলের উর্দিধারী পুলিশেরা করেছে। ঘটনা মুহূর্তের মধ্যে গোটা জঙ্গলমহলে কান থেকে কানে রটে গেল। আরও পড়ুন-ঘুঙরু বাঈ

রাস্তা কেটে, গাছ কেটে অবরোধ তৈরি করে জঙ্গলমহল মহাকরণের ক্ষমতার অলিন্দকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল। মনে হচ্ছিল যেন,  জঙ্গলের পথে ছুটছে বসাই টুডু … পিছনে তাড়া করে ধেয়ে আসছে সশস্ত্র পুলিশ। একটা মজা নদী পেরিয়ে জঙ্গলের পথে ছুটতে ছুটতে বসাই টুডুর চোখে পড়ল-গত রাতের ঝড়ে গাছ থেকে পাখির ছানাগুলো মাটিতে পড়ে গেছে। ক্ষিপ্র হাতে ছানাদের তুলে নেয়, তরতর করে গাছে উঠে তাদের বাসায় যত্ন করে রেখে দিয়ে আবার ছুটতে থাকে৷ পিছনে তাড়া করে ধেয়ে আসছে সশস্ত্র পুলিশ … বন্যপ্রাণীর মতো সে ছুটতে থাকে। লেখিকা অশীতিপর মহাশ্বেতা দেবী তিনিও ছুঁটছেন বসাই টুডুদের সঙ্গে। দিদিকে তখন দেখেছি অন্য মেজাজে। দিনে দু’বার ইনসুলিন নেওয়া মানুষটির যেন কোনও রোগ-বালাই নেই। আরও পড়ুন-Sonajharia Minz: ঝাড়খণ্ডের সোনাঝরিয়া মিনজ এখন স্বাধীন ভারতের প্রথম আদিবাসী মহিলা উপাচার্য



ওই হামলার পরেই লালগড়ে শুরু হল ব্যাপক পুলিশি অভিযান। সরকারের কাছে তখন আদিবাসীদের স্বতঃস্ফুর্ত এই বিক্ষোভ মাওবাদী আন্দোলনের তকমা পেল৷ বাম সরকারের মতে এই রাজ্যে মাওবাদীদের ভরকেন্দ্র ছিল লালগড়। অভিযোগ উঠল, পুলিশ আদিবাসীদের উপরে অত্যাচার করছে। পুলিশের বিরুদ্ধে জঙ্গলমহলের বাসিন্দারা গড়ে তুলল “পুলিশি সন্ত্রাস বিরোধী জনসাধারণের কমিটি৷” সেই কমিটির ডাকে মহাশ্বেতা দেবী, মেধা পাটকর ছুটে গেছেন জঙ্গলমহলে। “অরণ্যের অধিকার” প্রতিষ্ঠার এ যেন আর এক মহাকাব্যের সূচনা। অন্তত সেই সময় এমনটাই মনে হয়েছিল।

Facebook Comments Box

Post Author: bongmag

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।