Attar

কস্তুরী আতর

সুণীপা

“যাঃ! কি যে করো না তুমি,”  বলেই লজ্জায় রাঙা সালমা ফিরদৌসের থেকে আর একটু দূরে সরে গেল। তখনও ফিরদৌসের হাতে সালমার ওড়নার একপ্রান্ত ধরা আছে। নববধূর সাজে সালমাকে আজ কোনও সাম্রাজ্যের বেগমের মতোই লাগছে। ফিরদৌসের নিকাহ করা বেগম। সারা ঘরটা মিষ্টি ফুলের সুবাসে ছেয়ে আছে। তার চোখের সুরমায় সালমার যৌবনের আঁচ লাগতে শুরু করেছে।



হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টানে সালমাকে নিজের বুকের উপর এনে ফেললো ফিরদৌস। আর সেই মুহূর্তেই সালমার আতরের গন্ধটা ওর নাক থেকে ফুসফুসে আছড়ে পড়ল। কিছুটা সময়ের জন্য ফিরদৌসের মনে হল, কেউ যেন ওর শ্বাস বন্ধ করে দিচ্ছে। এক ঝটকায় সালমাকে দূরে সরিয়ে হাঁফাতে লাগল। নতুন দুলহান সালমা তখন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল বেশ খানিকক্ষণ। ফিরদৌস গলা ধরে এখনও হাফাচ্ছে, যেন ওর চোখ দুটো লাল হয়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সালমা তাড়াতাড়ি জলের গ্লাস এগিয়ে দিল। আরও পড়ুন-ক্যানভাসে বৃষ্টির রাত, প্রহর জাগে ১৪ ফেব্রুয়ারি

একহাতে জলটা নিয়ে, অন্য হাতের ইশারায় সালমাকে সামনে থেকে সরে যেতে বললো ফিরদৌস। ততক্ষণে প্রাথমিক বিহবলতা কেটে গিয়ে একরাশ ভয় আর অভিমান এসে জড়ো হয়েছে নববধূর দু’চোখে। ছলছল চোখে সে বিছানা থেকে নেমে দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ফিরদৌস একটু ধাতস্থ হতেই লাল চোখ নিয়ে তাকায় সালমার দিকে। এক মুহূর্ত আগের ফিরদৌস ,আর এখনকার ফিরদৌসের মধ্যে যেন আসমান জমিন ফারাক! সালমার ভয়টা জাঁকিয়ে ধরে, চোখের টলটলে জল এখন গাল ভাসিয়ে দিচ্ছে। ফিরদৌস হাঁফাতে হাঁফাতে প্রশ্ন করে, “এটা কি মেখেছ তুমি!”



সালমা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে দেখে ফিরদৌস আবার প্রশ্ন করে, “এ আতর তুমি কোথায় পেয়েছ! এ যেন জাহান্নামের…!” সালমা এই বিশেষ দিনের জন্য আতরটা তুলে রেখেছিল। এই আতর তাকে দিয়েছিলেন সৌদি প্রবাসী মামা। বলেছিলেন, “এ হল আসল কস্তুরী আতর! এখন আর সহজে পাওয়া যায়না৷” প্রাণে ধরে সালমা কখনও আতরটা ব্যবহার করেনি৷ তুলে রেখেছিল বিশেষ মানুষটার জন্য। সালমা শুনেছিল, এই গন্ধ শুধু মানুষকে নয়, যার নাভিমূল থেকে আসে সেই কস্তুরী হরিণীকেও পাগল করে দেয়।

এক ঝলকে সব মনে পরে গেল তার। ধীরে ধীরে মাথা তুলে বলল, “কস্তুরী”। ফিরদৌস তখনও হাফাঁচ্ছে। এরকম নয় যে এই প্রথম আতরের গন্ধ পেল ও৷ অথবা অন্য কোনও আতরেও এরকম অনুভূতি হয়নি তার৷ তবে আজ কেন! কিছুটা সময়ের জন্য ফিরোদৌসের মনে হয়েছিল কেয়ামত নেমে এসেছে পৃথিবীতে। একটু চুপ করে থেকে সে বলে, “আমি নিচে শুয়ে পড়ছি, তুমি খাটে ঘুমাও। আর হ্যাঁ, কখনও এই কস্তুরী না কি বললে, এ আতর ব্যবহার কোরো না৷”



সালমার মনে হল, এতক্ষণের মধু যামিনী, এই শরম হায়া, এতো স্বপ্ন সব ওকে পরিহাস করতে শুরু করেছে। সারাটা রাত কেঁদে বালিশ ভিজিয়ে কেটে গেল। পরদিন সকালে উঠে, আপা, ভাবীদের মশকরায় ছলছলে চোখে মাথা নিচু করে থাকল। সারাদিনের কাজকর্ম মিটলে, একটু নিজের জন্য সময় পেয়েই বাপের বাড়ি থেকে আনা সুটকেস খুলে আতরের শিশিটা বের করল৷  পৃথিবীর সমস্ত ঘৃণা এখন ওর এই শিশিটার উপরে। “কে জানে,উনি আর কখনো আমাকে কাছে ডাকবেন কিনা!” ভাবনাটা মনে আসতেই শিউরে উঠলো সালমা। তারপর অসম্ভব রাগে জানলা থেকে শিশিটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।



এই পুরো বিষয়টা একজন অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে দেখছিল৷ সে আর কেউ নয়, ফিরদৌসের বড় আপা রুকসানা। স্বামীর থেকে তালাক পেয়ে এখন ভাইয়ের সংসারে মায়ের সঙ্গে থাকে সে। সন্তান না হওয়ায় আজ তার এই দুর্দশা। ধীর পায়ে বাইরে বেরিয়ে এল, অপার কৌতূহলে জানলার পিছনে শিশিটা আবিষ্কার করল সে। হাতে নিয়েই তার মনে হল, এ নিশ্চয় কোনও পীরবাবার জাদুটোনা৷ ভাইয়ের বিবি ভাইকে বশ করবে বলে বাপের বাড়ি থেকে এনেছে। ব্যবহার হয়ে গেছে, তাই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে! প্রচণ্ড উত্তেজনায় সে আম্মুর ঘরের দিকে দৌড়তে গিয়েও দাঁড়িয়ে গেল। আরও পড়ুন-অন্য ‘বিন্যাস’-এর লেখক বুদ্ধদেব গুহ



হঠাৎই তার মনে হল,কাশেমের কথা। পাশের দুটো বাড়ির পরে ওদের ঘর। কাশেম আর রুকসানার একটা বাল্য প্রেম ছিল বটে৷ কিন্তু টাকা ও বংশ মর্যাদায় সমকক্ষ না হওয়ায় বিয়েটা হয়নি। রুকসানা ফিরে আসার পর ওদের সেই পুরনো প্রেম আবার মাথাচাড়া দিয়েছে। শুধু বাদ সেধেছে কাশেমের বউ আঞ্জুয়ারা!কাশেমের ও বিবির প্রতি বেশ দরদ আছে!তালাক দেওয়ার কথা বললেই বিভিন্ন ভাবে এড়িয়ে যেতে থাকে! শিশিটার ভিতরের তরলটার দিকে তাকিয়ে থাকে রুকসানা৷ আজ অনেক রাতে কাশেম আসবে বলেছে ওদের পিছনের গোয়াল ঘরে। বেশ কয়েকদিন বাড়িতে লোকজন থাকায় দেখা হয়নি ওদের!আম্মুকে শিশিটা দিয়ে ভাইবৌয়ের কীর্তি ফাঁস করার আগে আজ রাতে সে এটাকে কাশেমের উপরে ব্যবহার করতে চায়! শিশিটা খুলে নাকের সামনে নিয়ে আসে রুকসানা। গন্ধটা ওকে আবিষ্ট করে ফেলছে ক্রমশ৷

Facebook Comments Box

Post Author: bongmag

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।