সংযুক্তা
একটা দুটো উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা বুঝতে সুবিধে হবে। কাশ্মীরে (Kashmir) বুরহান ওয়ানি যতটা সমর্থন পেয়েছিল, যে জনপ্রিয়তা ছিল, তার আংশিকও মুসার কেন নেই? কারণ বুরহান স্বপ্ন দেখিয়েছিল ‘স্বাধীন কাশ্মীরের,’ আর জাকির মুসা পাকিস্তান অন্তর্ভুক্তি এবং শরিয়ত আইন কাশ্মীরে লাগু করার।
জাকির মুসার এনকাউন্টারের পর কাশ্মীরিরা শোক পালন করেনি, যেরকম আমরা বুরহান ওয়ানির এনকাউন্টারের পর দেখেছিলাম। এবার পার্থক্যটা বুঝতে পারছেন? আমরাও যেমন কাশ্মীর নিয়ে তিনভাগে বিভক্ত, কাশ্মীরও( Kashmir) নিজের অবস্থান নিয়ে তিনভাগে বিভক্ত, ১) ধারা ৩৭০ অনুযায়ী কাশ্মীরিরা সিদ্ধান্ত নেবে তারা কি চায়। তারা চায় একটি দেশের মর্যাদা অর্থাৎ ‘না হিন্দুস্তান, না পাকিস্তান’, ২) যারা ভারতেই থাকতে চায় (কিন্তু বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে), ৩) পাকিস্তান অন্তর্ভুক্তি।
এদের কে কত শতাংশ তার সুক্ষ্ম হিসেবের প্রয়োজন পড়বে না, যদি সত্যিই একটু উদার মনে তাদের কথা শোনেন তাহলেই বুঝে যাবেন পাকিস্তান অন্তর্ভুক্তি মানসিকতার শতাংশ নগণ্য। যাদের পাথর ছুঁড়তে দেখা যায় তারা সকলেই যে পাকিস্তান অন্তর্ভুক্তি চায় এটাও ভুল ধারণা। আসলে আমাদের যা বলা হয়, সোশ্যাল মিডিয়ায় যা চাউড় হয়, আমরা সেগুলিকেই বিনা যাচাই করে চিরন্তন সত্য হিসেবে মেনে নিই। আরও পড়ুন-অন্য ‘বিন্যাস’-এর লেখক বুদ্ধদেব গুহ
৫ অগাস্টের আগে ঠিক কতজন ধারা ৩৭০ , ৩৫-এর এ ধারা জানতেন বলা মুশকিল। কেননা এমন হাজার পোস্ট চোখে পড়েছে যেখানে ৩৭০-এর জায়গায় ৩৭৭ লেখা আছে, তর্কও চলেছে তার ভিত্তিতেই। তবুও কেউ বোঝেনি যে, তারা ৩৭৭-কে ৩৭০-এর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছে। আচ্ছা মনে করা যাক আপনি শুনেছেন ধারা ৩৭০ বলে কিছু আছে৷ কিন্তু এর ভিতরে কি আছে কি নেই সেটা নিজে কখনও যাচাই করে দেখেছেন, সরকার বা মিডিয়ার প্ররোচনাকে অগ্রাহ্য করে?
অনেকেই আপনারা কাশ্মীর (Kashmir) গিয়ে থাকবেন। কখনও মনে হয়েছে, এত দলাদলির মধ্যে সেখানকার ছেলে মেয়েদের মানসিক পরিস্থিতি ঠিক কিরকম হতে পারে! ভাবেননি। কারণ সারা মন জুড়ে ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে একটিই বদ্ধমূল ধারণা, কাশ্মীর জঙ্গি তৈরির কারখানা।
তাহলে সরকারকে প্রশ্ন করুন যে এমন কেন? তাহলে নিজেকে প্রশ্ন করুন, একই ছাদের তলায় থেকে পাশের ঘরে জঙ্গি নিয়ে বাস করে আপনি আজও খোলা মনে কিভাবে কাশ্মীর (Kashmir) ঘুরতে গিয়ে অক্ষত অবস্থায় ফিরে আসছেন? বা নিজের রাজ্যেই শান্তিতে বাস করছেন? ভাবুন তো একটি দেশে ১০ লাখ জঙ্গি থাকলে আমি আপনি আজ এত শান্তিতে কফির কাপে চুমুক দিতে পারতাম! আরও পড়ুন-Kashmir: কাশ্মীর! এক বিভাজিত আখ্যান (দ্বিতীয় পর্ব)
চোখের সামনে নিজের মা, বোনকে ধর্ষিত হতে দেখার পর, দোকানে রেশন কিনতে গিয়ে নিজের ভাই বা বাবাকে আর ফিরে আসতে না দেখার পর, বাবার হাত ধরে হাঁটতে বেরনো মেয়েটা হঠাৎ বাবাকে পিঠে বুলেট নিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আর উঠে দাঁড়াতে না দেখার পর, ঠিক কি আচরণ করবে বলে মনে হয়! তার বাবা কখনও পাথর ছুঁড়তে যায়নি, শামিল হয়নি কোনও মিছিলেও। তবে কেন তাঁকে একটা গোটা পরিবার পিছনে রেখে অসময়ে চলে যেতে হল!
ক্যাজুয়ালটি! ওরকম এক-আধটা হয়েই থাকে, তাই তো? কাশ্মীরে ( Kashmir) এই ক্যাজুয়ালটির সংখ্যা জানেন? গুনেও শেষ করতে পারবেন না। আমার বন্ধুর বৃদ্ধা ঠাকুমা থেকে শুরু করে দু’বছরের শিশু, কত মানুষ যে এই ক্যাজুয়ালটির শিকার তা নিয়ে লিখতে বসলে অনন্তকাল কেটে যাবে। হ্যাঁ, ঠিক জানেন, আমাদের সেনা জওয়ানদের মরদেহও গুনে শেষ করা যাবে না। কিন্তু কিসের জন্য এত রক্ত? এই প্রশ্ন কখন, কবে করবেন?
সেটা ২০১০, যখন আমি প্রথম কাশ্মীরে পা রাখি। কাশ্মীর ( Kashmir) তখন অচলাবস্থায়। কাগজে লেখালেখি শুরু হয়ে গেছে যে এবার হয়ত কাশ্মীর হাতছাড়া হল বলে। কার্ফু চলছে। রাস্তায় সাধারণ মানুষ কম, ভারতীয় সৈন্য থিকথিক করছে। আমার হোটেলের গেটের সামনেই চারজন প্রহরী। পুরো গলিটাতে তো আরও জনা আষ্টেক হবে। এক দুপুরে উঁকিঝুঁকি মারতে মারতে কথাটা পেড়েই ফেললাম। “কত বছর হল কাশ্মীরে?” ভয়ে ভয়ে ছিলাম, হয়ত জবাব পাবো না, উল্টে তাড়িয়ে দেবে। মুচকি হেসে জবাব এল, “প্রায় আট বছর তো হতে চলল৷”
একটু সাহস পেলাম। ইতস্তত করে বললাম, “একটা কথা জিজ্ঞেস করব?” মুখে হাসি। উনিও বুঝে গেছেন কি প্রশ্ন আসতে চলেছে। “এখানে কি সবাই জঙ্গি? মানে এত যে মানুষকে ‘প্রয়োজনে’ মারতে হয়, এত মৃত্যু দেখতে হয় রোজ, মানসিক অবস্থা…” প্রশ্ন শেষের আগেই উত্তর এল, “ঠিক থাকে না তো। মানসিক অবস্থা ঠিক থাকে না। সবাই তো এখানে খারাপ নয়। আমার কাশ্মীরি ( Kashmir) বন্ধু আছে, যারা আমায় দেখে হাসে, এগিয়ে এসে কথা বলে, ডিউটির সময় কাওয়া (লবন চা) দিয়ে যায়। অনেক নিরীহ মানুষ মারা যায়। ক্যাজুয়ালটি। কিন্তু আমাদের ওসব দেখলে তো চলবে না। ওপর থেকে যা অর্ডার আসবে তাই-ই আমাদের করতে হবে। সামনে আমার বন্ধু থাকলেও তাকেও মারতে হবে। আমাদের ডিউটি এটাই৷” হ্যাঁ, ভারতীয় সৈন্য ডিউটিই করছে। কিন্তু এই উপরওয়ালাদের নির্দেশও বড়ো গোলমেলে।
সাল ১৯৯০, মিলিট্যান্সি হু হু করে বাড়তে শুরু করেছে। কাশ্মীরে ( Kashmir) নতুন সেনাপ্রধান নিয়োগ করা হল। জিজ্ঞেস করা হল, তাঁর কাশ্মীরে শান্তি ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা। সোজা জবাব এল, জানা নেই। নির্দেশ এসেছে, জঙ্গি দমন অথবা জঙ্গিদের আত্মসমর্পণ করানো। সরকার রিহ্যাবিলিটেশন পলিসি তৈরি করেছেন, আত্মসমর্পণকারী জঙ্গিদের জন্য, তাতে আত্মসমর্পণকারিদের কিছু অনুদান দেওয়া হয়(আত্মসমর্পণকারী জঙ্গি কোন অস্ত্র সমর্পণ করছে এবং তার সংখ্যার ওপর সরকারি অনুদান নির্ভর করে)।
১৯৯৩-৯৫ এ যখন জঙ্গি দাপট তুঙ্গে তখন সৈন্যদের দমননীতি নিয়েও মানবাধিকার দপ্তরকে নড়েচড়ে বসতে হয়েছিল। এদের মধ্যে অন্যতম ছিল ২০০০ সালের অনন্তনাগের চিট্টিসিংপোরার ঘটনা। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের ভারত ভ্রমণের মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে ভারতীয় সেনার উর্দিধারী কয়েকজন এলোপাথাড়ি গুলিতে ৩৫ জন শিখের প্রাণ যায়৷ বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হতে পারে, বুঝেই ভারতীয় সেনা এই ঘটনায় নিজেদের ভূমিকাকে অস্বীকার করে হত্যালীলার সম্পূর্ণ দায় পাক জঙ্গিগোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈবার উপরে চাপিয়ে দেয়। আরও পড়ুন-Kazi Nazrul Islam: ‘শত কবিতায় নজরুল’, বিদ্রোহী কবিকে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রদ্ধার্ঘ্য
বলা হয়, ভারতীয় সেনাকে এবং বিশ্বের কাছে ভারতকে বদনাম করতেই এই ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। কিন্তু মৃতদের পরিবাররা তো বিচার চায়। আনুমানিক ছ’টি মৃতদেহ আগ্নেয়াস্ত্র সমেত মিডিয়ার সামনে তুলে ধরা হয়েছিল। চিফ কম্যান্ডারের দাবি ছিল, তারা প্রত্যেকেই নাকি হাই ব়্যাঙ্কের জঙ্গি। চারিদিকে সেনার জয়জয়কার। ঘটনাটা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু হয়নি। কারণ, ততদিনে সিবিআই তদন্তটা নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। আমেরিকার সামনে মানবাধিকার সংকট, জল তো বহু দূর গড়াবেই।
২০০৬ সালে সিবিআই তাদের চার্জশিট পেশ করে৷ তাতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, সেই মৃত ৬ জনের কেউই জীবিতাবস্থায় হাই ব়্যাঙ্কের জঙ্গি বা বিদেশি ছিল না৷ গোটা ঘটনাটিকেই সিবিআই ‘ফেক এনকাউন্টার’ বলে চিহ্নিত করে। বিশাল ভরদ্বাজের “হায়দার” ছবিতেও এইরকমই এক দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। তবে অপরাধী কারা ছিল? আজও তার জবাব মেলেনি। এর কিছুদিন পরে জম্মুতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে আবারও হাই ব়্যাঙ্কের জঙ্গি নিধনের প্রসঙ্গ তুললেন সেনাপ্রধান। এবার আর মৃতদেহ না, ছবি দেখানো হল।
এর পরেই প্রকাশ্যে এল এক বিস্ফোরক তথ্য। ছবিতে দেখানো মৃত আচমকাই জীবন্ত হয়ে মিডিয়া ডেকে দাবি করলেন যে, তিনি একজন সাধারন নাগরিক এবং বেঁচে আছেন৷ তাঁর আরও দাবি, “সেনা পয়সার জন্য যখন তখন যাকে তাকে জঙ্গি তকমা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ক্র্যাকডাউনের সময় (একপ্রকার তল্লাশি যেখানে বাড়ির ছোট থেকে বড় সমস্ত পুরুষদের হাতে আইডেন্টিটি কার্ড তুলে ধরে লাইন দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে হয়। একজন জিপে মুখ ঢাকা সেনা বসে থাকেন। তাঁর জিপের সামনে এক এক করে এসে দাঁড়ালে, তিনি হর্নের দৈর্ঘ্যের মাধ্যমে বাকিদের বুঝিয়ে দেন কাকে ধরা হবে, আর কাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। যে সমস্ত বাড়ির সদস্যদের তল্লাশি করা হয়৷ তল্লাশি হয়ে যাওয়ার প্রমাণ স্বরূপ সেইসব বাড়ির বাইরে একটা ক্রস চিহ্ন এঁকে দিয়ে যায় সেনা৷ ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে এই প্রক্রিয়া)৷”
হ্যাঁ, কাশ্মীরীরা ( Kashmir) মনে করেন জঙ্গি নিধনের জন্য সেনাদের টাকা দেওয়া হয়। এর জন্য একটি গোপন রেট চার্টও আছে। জঙ্গিদের পদ অনুযায়ী টাকা। যত বড় জঙ্গি ততো টাকা। বলাবাহুল্য, তখনই এই রেট চার্ট নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে গুঞ্জনের সৃষ্টি হয়। এই গুঞ্জন প্রতিদিন কেবল জোরাল হতে থাকে। খুব সম্প্রতি ২০২০ এর আমশিপোরার ঘটনা আগুনে ঘিয়ের কাজ করে। যদিও ভারতীয় সেনা চলে আসা এই দাবিকে ভিত্তিহীন বলে নস্যাৎ করেছে। তবে গোটা বিষয়টি বিচারাধীন, তদন্তের জন্য SIT কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাই উপত্যকার সাধারণ জনগণের সঙ্গে সেনার বোঝাপড়ায় যে বিরাট ফাঁক থেকে গেছে, এই ঘটনা তারই ইঙ্গিত করে৷
ক্রমশ…