kashmir

Kashmir: কাশ্মীর! এক বিভাজিত আখ্যান (দ্বিতীয় পর্ব)

Sanjucta Sarkar

সংযুক্তা

“আচ্ছা বাইরে সবাই কি বলছে কাশ্মীর (Kashmir) নিয়ে? কেউ আমাদের কথা ভাবছে?” প্রথম বিড়ম্বনায় ফেলল বন্ধুর ১৫ বছর বয়সী তুতো ভাই। কীভাবে বলি কি বলছে বাইরের সবাই! কীভাবে বলি কিছু মানুষ ৫ অগাস্ট কতোটা পৈশাচিক উন্মাদনায় মেতে উঠেছিল। কাশ্মীরের জমির সঙ্গে কাশ্মীরি মহিলাদেরও নিলামে তুলে দিয়েছিল। আবার কিছু মানুষ কেবল দেশদ্রোহী তকমা থেকে বাঁচতে আজও মুখ খোলেনি। কেউ কেউ নিজেদের মতো করে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন সুরাহা চেয়ে। এই তিন শ্রেণীর মানুষের কথাই ওকে জানিয়েছি।



কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে বারবার উদাস চোখে জানলার বাইরে তাকাতে দেখেছি ওকে। একটা ছটফটে কিশোর মন আড়াই মাস ধরে ঘরবন্দি। বাইরে বেরতে পারে না। বেরলেও ঘড়ি ধরে মিনিট ১৫-র মধ্যে ঘরে ঢুকে যেতে হয়৷ স্কুল নেই, বন্ধু নেই, মাঠে খেলতে যাওয়া বা স্কুটি নিয়ে এ গলি সে গলি যাওয়া নেই। এমনিতে কাশ্মীরিদের (Kashmir) ‘সোশ্যাল লাইফ’ বলে কিছুই নেই। কারণ, বাড়ি থেকে বেরিয়ে তার ফিরে আসার নিশ্চয়তাও যে নেই। “সে তো ঠিকই। কিছু মানুষ থাকবেই যারা এই পরিস্থিতিকে সমর্থন করবে, আমাদের বুঝবে না যে আমরা কি চাই৷” এক ১৫ বছরের মন অক্লেশে মেনে নিল। আমার মনে হয় আমি ওর জায়গায় থাকলে কি ওদের এভাবেই মেনে নিতে পারতাম! পরিস্থিতি কি সব মানুষকেই ওর মতোই সময়ের অনেক আগে পরিণত হতে শেখায়! হয়তো না। আরও পড়ুন-Kashmir: কাশ্মীর! এক বিভাজিত আখ্যান

এরপর ওর দিদি, মেডিক্যালের প্রথম বর্ষের ছাত্রীটি জানাল, “আসলে আমাদের অনেক বন্ধুকেই সেনা তুলে নিয়ে গেছে, সরকার বিরোধী কার্যকলাপে যুক্ত ‘হতে পারে ভেবে’৷” তার মানে ১৪-১৫ বছরের ছেলে-মেয়েরা কোনও এক অন্ধকার কুঠুরিতে আটক আছে৷ তারা কোথায়, ফিরবে কিনা কারোর জানা নেই। এদের অনেকেই পাথরবাজ নয়। কেউ কেউ শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ মিছিলে যোগদান করার অপরাধে গ্রেপ্তার হয়েছে৷ কেউ আবার ভারতীয় সেনার নিছক সন্দেহের কোপে পড়ে জেলে গেছে। বরফের রাজ্য কাশ্মীরে (Kashmir) এমনিতে স্কুল-কলেজ বছরে আট মাস খোলা থাকে, তার উপরে নিত্য ঝামেলা, হরতাল, সেনা-জঙ্গির লড়াই তো লেগেই আছে। এদের লেখাপড়ার কী হবে!



“বাড়িতেই করি। অসুবিধা হয়। অর্ধেক সিলেবাস তো স্রেফ ছুঁয়ে বেড়িয়ে যেতে হয়। টিচার তো সিলেবাস ঝড়ের গতিতে শেষ করে দেয়, চাপ পড়ে আমাদের উপর। মেডিক্যাল এরকম বাড়ি বসে একা পড়া যায় না কি! তাও যদি ইন্টারনেটটা থাকত। অসুবিধা হলে ওখান থেকে বুঝে নিতাম৷” এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে কথাগুলো বলে গেল আঠারো-উনিশের তরুণী। “আমার ইচ্ছে ছিল বাইরে পড়তে যাওয়ার, এই দিল্লিতে। কিন্তু বাড়ি থেকে ছাড়ল না। বাইরে কাশ্মীরিদের উপরে কথায় কথায় হামলা হয়। তাছাড়া এখন বাইরে থাকলে পরিবারের সঙ্গে কী করে যোগাযোগ করতাম, কবে ঠিক হবে সবকিছু জানো?” আবারও অপ্রস্তুত আমি, “খুব তাড়াতাড়ি” ছাড়া আর কিছুই বলতে পারিনি। আরও পড়ুন-ঘুঙরু বাঈ

এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানোর সময় আপেলের খেত চোখে পড়েছিল। এই সময় কাশ্মীর (Kashmir) পর্যটন থেকে শুরু করে আপেল রপ্তানি-সহ নানা ব্যবসায় ব্যস্ত থাকে। এক কথায় এই সময়কে বলা হয় কাশ্মীরের “পিক আওয়ার৷” কতো আপেল জমিতে পড়ে আছে! “এবার সব বাগানে আর বাড়িতেই পচবে”, আপেল ব্যবসায়ীর আক্ষেপ। “কি করব বুঝতে পারছি না। সব শেষ করে দিল সরকার”, আরেক ব্যবসায়ী আপেল নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে গিয়ে বললেন। সেই সঙ্গে আমার দু’হাত ভরে দিলেন আপেলে৷ এমন অযাচিত উপহারে আনন্দের চেয়ে সংকোচই বেশি হয়েছিল৷ একটার বেশি দাঁতে কাটতে পারিনি। মন্দার বাজারে বিনামূল্যে পাওয়া আপেলের যে কোনও স্বাদ হয় না। আরও পড়ুন-Shankha Ghosh:“আমার বলে রইল শুধু, বুকের ভিতর মস্ত ধু ধু”

মনে পড়ে গিয়েছিল সংসদে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর ধরা গলার ভাষণ। কাশ্মীরের (Kashmir) দারিদ্র্য দেখে তাঁর নাকি চোখে জল চলে আসে। এখন কি তিনি কাঁদছেন? উত্তরটা আমার জানা নেই। “কাশ্মীর কোথায় গিয়েছিল? কোথাও কি গিয়েছিল? এটা তো ভারতেই ছিল। তাহলে এসব কেন? জনগণকে কেন বোঝানো হচ্ছে যে কাশ্মীরকে ভারত পাকিস্তানের থেকে ছিনিয়ে এনেছে?” ষাট ছুঁই ছুঁই প্রৌঢ়ের প্রশ্ন আমাকে দ্বিধায় ফেলে দেয়। কীভাবে বলব, আমাদের দেশের মানুষ এখন এত বাধ্য হয়ে গেছে যে সরকার দিনকে রাত বললেও তারা বিনা প্রশ্নে মেনে নেয়। তাইতো পেশিশক্তির পরিচয় দিতে এক রাতেই সংবিধানের ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি ঘটানো হল৷ দেশবাসী প্রশ্ন করেনি, “তারপর?” তারা প্রশ্ন করেনি ‘স্পেশ্যাল স্টেটাসে’-র আওয়তায় পড়ে এরকম বাকি রাজ্যগুলোর কী হবে?



কেন শুধু কাশ্মীর?  শান্ত রাজ্য হিমাচলও তো সেই ‘স্টেটাস’ দীর্ঘদিন ধরে বহন করছে। সেই কবে থেকে অরুণাচলের দিকে পাখির চোখ করে বসে আছে চিন৷ অরুণাচল কবে ‘চিনের আওতার বাইরে আসবে?’ জঙ্গি দমনের কি এটাই একমাত্র উপায় ছিল? যদি তাই-ই হয় তবে পণ্ডিতদের ক্ষেত্রে সরকার যা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেটাও ঠিক। আর তো তর্কের জায়গাই থাকল না। বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী সেনাদল যে রাজ্যে ছেয়ে আছে সেখানে এত অনুপ্রবেশ কী করে সম্ভব! সেখানে এত জঙ্গি হামলা কীভাবে?

দেশের মধ্যে কাশ্মীর (Kashmir) শুধুমাত্র সীমান্ত রাজ্য নয়৷ যদিও ফেসবুকীয় বুদ্ধিজীবিদের মতে, ‘পাকিস্তান এক রাতেই ভারতের হাতে শেষ হয়ে যেতে পারে৷’ সেই ক্ষমতাশালী দেশ কিসের ভয়ে একটা জনপদকে পঙ্গু, গৃহবন্দি করে রেখেছে? ২০১৯-এর ৫ অগাস্টের সিদ্ধান্ত সাহসিকতার না কি ভীতির পরিচয় ছিল সরকারের! আরও পড়ুন-ক্যানভাসে বৃষ্টির রাত, প্রহর জাগে ১৪ ফেব্রুয়ারি

পুলওয়ামার সেই কুখ্যাত হাইওয়ে দিয়ে আসতে গিয়ে তিনটে সেনা ছাউনি চোখে পড়েছিল। কনভয় দেখার সৌভাগ্যও হয়েছিল। যেখানে দূর দূর পর্যন্ত কোনও মাছি গলতে দেওয়া হয় না। চারঘন্টা পর্যন্তও কখনও কখনও ট্র্যাফিক আটকে রাখা হয়, সামান্য পুলিশের গাড়ি গেলেও নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে সাধারণ গাড়ি আটকে রাখা হয়, সেখানে ডিভাইডার ডিঙিয়ে বিস্ফোরক বোঝাই গাড়ি এসে মাঝের গাড়িকে (না সামনের গাড়ি না পিছনের গাড়ি) কীভাবে উড়িয়ে দিয়ে চলে গেল সেটা একটা ভাববার বিষয়।



কেউ ভেবে দেখছে না সেটা আলাদা বিষয়। আরও হতভম্ব করে দেওয়া ঘটনা হল, পুলওয়ামা হামলার পর এক কাশ্মীরি উগ্রপন্থীর ভারতবিদ্বেষী ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল যে কিনা দেড়-দু’মাস আগেই সেনা এনকাউন্টারে নিকেশ হয়েছে, কান পাতলে এরকমটাই শোনা যায়৷ কাশ্মীরিরাও বাকি ভারতীয়দের মতো জানতে চায়, তবে পুলওয়ামা হামলার নেপথ্যে কারা? উরি অ্যাটাকের মতো এ তদন্তও বিশবাঁও জলে৷  আরও পড়ুন-একটা বৃষ্টি দিন ও ভাল-বাসার নবনীতা

কাশ্মীর (Kashmir) ভারতের এমন একটি অঞ্চল যেখানে যুব সম্প্রদায় সবচেয়ে বেশি। যুব সম্প্রদায় যে দেশের ভবিষ্যৎ, এ কথা প্রতিটি রাজনীতিবিদ বিশ্বাস করেন। তবে যে রাজ্যে ৪৫% যুব সম্প্রদায় মানসিকভাবে বিধ্বস্ত, সেখানে স্থানীয় প্রশাসন ও কেন্দ্রের কী পরিকল্পনা? বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মোকাবিলা করা কতটা কঠিন? কেন একজন অধ্যাপক হাতে বন্দুক তুলে নিতে বাধ্য হন? কেন আঠারো উনিশ বছর বয়সীরা ঘর ছেড়ে এক অন্ধকার অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়ায়? স্রেফ পাকিস্তানের প্ররোচনায়? ইসলামিক মতাদর্শের টানে? ব্যাপারটা কি এতই সোজা? (যদিও ইসলামে এরকম হত্যালীলায় মেতে ওঠার স্বপক্ষে কিছুই লেখা বা বলা নেই। যা আছে আর যা আমাদের বোঝানো হয় তার মধ্যে স্বার্থাণ্বেষীদের আকঙ্ক্ষা জড়িয়ে আছে)৷



যদি এতই সোজা মনে হয় তাহলে বুঝতে হবে একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে নিজেদেরই এক অঞ্চলের বাসিন্দাদের মনোভাব জানতে, বুঝতে আমরা যুগ যুগ ধরে ভুল করে আসছি।

ক্রমশ…

 

Facebook Comments Box

Post Author: bongmag

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।