সমীরণ নন্দী
শান্তিনিকেতনে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেন এক ভাগ্যবিড়ম্বিত নাম। যাকে গড়তে গিয়ে গোটা জীবনটা ব্যয় করলেন, জীবন সায়াহ্নে এসে সেখানে তাঁর ঠাঁই হল না। দূর থেকে খবর নিতেন, গুরুদেবের জন্মজয়ন্তী কেমনভাবে পালিত হচ্ছে। কেমন আছে সাধের বিশ্বভারতী। আজও বছর ঘুরে সেই মানুষটার জন্মদিন আসে। নীরবে চলে যায়, আশ্রমে রথীঠাকুরের জন্মদিন নিয়ে কোনও অনুষ্ঠান হতে দেখিনি। মন্দির থাকলেও তাঁর জন্য একটা বাক্য সেখানে খরচ হয় না। সেই রথীঠাকুরকে নিয়েই bongmag.com এর আলপাচারিতায় বিশ্বভারতীর অবসরপ্রাপ্ত চিত্রগ্রাহক সমীরণ নন্দী।
রবীন্দ্রনাথ, এই শব্দটি মনে এলেই আদ্যন্ত শান্তিনিকেতনি প্রাণের ঠাকুরকে দেখতে পায়। তা কোনও মানুষের প্রতিচ্ছবি নয়। কখনও কোণার্ক বাড়ির জানলা থেকে জেগে থাকা এক টুকরো আকাশ। কখনও বা উদয়ন বাড়ির লাল বারান্দা, যেখানে বসে সামনের পাথরে খেলে বেড়ানো রোদ্দুরকে বেশ উপভোগ করা যায়। বেলা গড়িয়ে কখন যে সন্ধে নামে খেয়ালই থাকে না। মন খারাপের বিকেল এসে ভর করে উদীচি বাড়ির মাথায়। ততক্ষণে আঁধার হতে বসেছে শ্যামলী। রক্ষীরা ফের একবার তাড়া দিয়ে গেল। আজকের মতো রবীন্দ্রভবন বন্ধ হবে, এবার বাড়ি যাও দেখি। চেনা পথ, চেনা স্মৃতি, এক সুগভীর টান যা চিনচিনে ব্যথার মতো জেগে থাকে। নিত্যদিনের ব্যস্ততায় ভুলে থাকলেও সুযোগ পেলে ফের ডানা ঝাপটিয়ে আকাশে উড়তে থাকে। আরও পড়ুন- “তিনিই মেলান, এমন প্রকৃতির পাঠশালা কোথায় পাবে শান্তিনিকেতন ছাড়া?”
এই সেই বাড়ি যেখানে গুরুদেব জ্যোষ্ঠপুত্র রথীন্দ্রনাথ ও পুত্রবধূ প্রতিমাদেবীর সঙ্গে বসবাস করতেন। তাঁর খেয়ালে একে একে গড়ে উঠল, কোণার্ক, মৃন্ময়ী, শ্যামলী, উদীচি, পুনশ্চ। তিনি ঋতুবিশেষে বাড়ি বদলে থাকতে লাগলেন। তবে উদয়নেই থেকে গেলেন কবিপুত্র ও পুত্রবধূ। গুরুদেবের প্রসঙ্গ এলেই কথা ফুরোয় না। আসলে না বলে থাকা যায় না যে। তবে আজ কিন্তু তিনি নন, আজ রথীঠাকুর। ছায়ার মতো কবির সঙ্গে জড়িয়েছিলেন, তাইতো তাঁকে আলাদাভাবে চেনা হয়নি। আসলে চেনার চেষ্টাই তো তেমন করে কেউ করেননি। বিশ্বপ্রতিভা যাঁর ঘর আলো করে রাখে সেই ঘরের কেয়ারটেকারকে আর কেই বা মনে রাখে।
কবিগুরু অতুলনীয়, অমূল্য ধন যা বাঙালি আজও বুঝে উঠতে পারেনি। তবে সেই ধনই একুশ শতকের বিজ্ঞাপনী দুনিয়ায় হাজারও ব্র্যান্ডকে বলে বলে গোল দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। এমন ঐশ্বর্যকে যিনি আগলে রাখলেন তিনিই যে কতবড় ত্যাগী তা বলার সময় এসেছে। নাহলে নিজের লেখনিও একসময় তিরস্কারে বিদ্ধ হবে। একে একে স্ত্রী, প্রিয় পুত্র শমী ও কন্যাদের চিরঘুমে ঘুমিয়ে পড়তে দেখেছেন।
প্রিয়জনের বিয়োগ ব্যথা তাঁকে আরও মর্মস্পর্শী সৃজনীতে ডুবিয়ে দিয়েছে। নিজে দেশবিদেশে কত মানুষের সান্নিধ্যে এসেছেন। পছন্দের মানুষ তাঁকে সর্বদা ঘিরে থাকত। এই বিরাট প্রতিভা তো মনে মনে একা হবেন বলাই বাহুল্য। আসলে যাঁরা সৃজনকে ধারণ করেন তাঁরা তো একাই। নাহলে কল্পনার জগৎ কী করে প্রাণ পাবে। ছোট্ট রথী ঠাকুর দেখছেন পিতা ছুটে বেড়াচ্ছেন। সারাদিন লিখছেন। কখনও কলকাতায়, কখনও বা বিদেশে। জাহাজে চড়ে কোথায় না কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন, একই সঙ্গে রথী ঠাকুরকে তৈরি করে চলেছেন। শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মবিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্র তিনি। পিতার আদর্শকে সেই শৈশবেই আঁকড়ে ধরেছিলেন।
যেমনভাবে গুরুদেব চেয়েছেন তেমনভাবেই নিজেকে ঢেলে সাজিয়েছেন রথীন্দ্রনাথ। পিতার নির্দেশে বার বার নিজেকে ভেঙেছেন। শান্তিনিকেতনকে বিশ্বসভায় প্রতিষ্ঠিত করতে তখন দারুণ ব্যস্ত গুরুদেব। ভাষা, সাহিত্য, সংগীত, নৃত্য, শিল্পকলা সবেতেই সাজিয়ে তুলছেন। কিন্তু তাঁর গ্রাম বাংলার অধিকাংশ মানুষই যে কৃষিজীবী, তাঁদের কাছে সেই সাহিত্যরস পৌঁছে দিতে হলে যে তাঁদের মতো করেই করতে হবে। এদিকে বয়স বাড়ছে এখন আর নতুন করে তো শুরু করা যায় না। পুত্র রথীন্দ্রনাথকেই তখন বাছলেন। কৃষিতে জোয়ার আনতে গেলে কৃষিবিজ্ঞান, কৃষিবিদ্যা জানতে হবে। বিশ শতকের গোড়ার দিকে রথীন্দ্রনাথ তখন সদ্য যুবক। তাঁকে পাঠিয়ে দিলেন মার্কিন মুলুকে। সেখানে কৃষিবিদ্যা নিয়ে পড়লেন রথীন্দ্রাথ। তবে ডক্টরেট শেষ করার আগেই পিতার নির্দেশে তাঁকে ফিরতে হল।
ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই কী করে চাষের পদ্ধতিকে আরও সুরক্ষিত করা যায় তা আয়ত্ত করেছিলেন রথীন্দ্রনাথ। ছেলের অর্জিত বিদ্যাকে কাজে লাগাতে পূর্ব বাংলার শিলাইদহের যে জমিদারি রয়েছে ঠাকুরবাড়ির, সেখানেই রথীন্দ্রনাথকে পাঠিয়ে দিলেন তিনি। পতিসরের কৃষকদের হাতেকলমে কাজ শেখালেন রথীঠাকুর। ডক্টরেটের স্বপ্নভঙ্গকে ভুলে তিনি যখন নতুন উদ্ভাবনে মেতে উঠেছেন, তখন ফের ডাক পড়ল জোড়াসাঁকো থেকে। আরও পড়ুন- ‘রবীন্দ্রনাথ চাইতেন শান্তিনিকেতনকে ছড়িয়ে দিতে, পাড়ায় পাড়ায় বসন্ত উৎসব গড়ে উঠুক’
প্রতিমাদেবীর সঙ্গে বিয়ে হবে তাঁর। এবারও পিতার নির্দেশ মেনে নিলেন। ঠাকুরবাড়িতে প্রথম বিধবা বিবাহ হল। প্রতিমাদেবীকে পুত্রবধূ করে আনলেন রবীন্দ্রনাথ। তারপর পুত্র ও পুত্রবধূকে নিয়ে চলে গেলেন শান্তিনিকেতনে। মাথায় তখন একটাই চিন্তা, এবার শ্রীনিকেতনকে গড়ে তুলতে হবে। পতিসরের সাজানো বাগান ভুলে বীরভূমের রুক্ষ মাটিতেই ফের ঘাম ঝরাতে নেমে পড়লেন রথীঠাকুর। এই পোড়ার দেশে তিনিই প্রথম চাষের কাজে লাঙলের বদলে ট্রাক্টরের ব্যবহার করেছিলেন। নিজেই বিদেশ থেকে আনিয়েছিলেন ট্রাক্টর।
দারুশিল্পে(কাঠের কাজ) তাঁর দক্ষতা প্রশ্নাতীত। উদয়নবাড়ির যাবতীয় আসবাবপত্রের নকশা তো তাঁরই হাতের তৈরি। উত্তরায়ন বাড়ির পাশের যে পম্পা সরোবর, তারই লাগোয়া স্টুডিও তৈরি হল, নাম গুহাঘর। সেই ঘরেই আপাত শান্ত অন্তর্মুখী রথী ঠাকুরের শিল্পকলা বিস্তার লাভ করতে শুরু করে। হয়তো বাবার মতো কবিতা লেখেননি, গানের সুরও ভাঁজেননি। তবে তাঁর অন্তরের অন্তঃস্থলের যাবতীয় সুর ফুটে উঠেছে কাঠের কাজে। রথীঠাকুরের শিল্পকলার সংরক্ষণ বড় জরুরি। দুঃখের বিষয় বিশ্বভারতীকে এনিয়ে বিশেষভাবে এগোতে দেখা যায়নি। দিনে দিনে কলেবরে বেড়েছে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বড় বড় ভবন তৈরি হয়েছে। তবে তাতে ঠাঁই পায়নি রথীঠাকুরের আসবাবের নকশা। সেই নকশাকে মূলধন করে বিশ্বভারতী শ্রীনিকেতনের শিল্পসদনকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারত। এমনিতেই রবীন্দ্রনাথের নাম, তায় বিশ্বভারতীর আসবাব। যার নকশা স্বয়ং কবিপুত্রের। কিন্তু এদিকটা এখনও অন্ধকারেই।
রথীন্দ্রনাথের হাত ধরে শান্তিনিকেতনের বাটিক শিল্প, চামড়ার ব্যাগ আজ বিশ্বের বাজারে অত্যন্ত আদরণীয়। কৃষিকাজে বিজ্ঞানকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি শ্রীনিকেতনে বাটিক চর্চা হয়েছে। শান্তিনিকেতনের নিজস্ব বুননের কাজও ছিল। তবে তার মান যে পড়েছে তা সমাবর্তনের উত্তরীয়র কাপড় দেখলেই বোঝা যায়। এখনও পুরনো আশ্রমিকদের বাড়িতে এই কাপড়ের দেখা মেলে। তবে শ্রীনিকেতনে এই শিল্পকর্মের ব্যাবসায়িক দিক নিয়ে তেমন ভাবনাচিন্তা যে করা হয়নি তা স্পষ্ট। নিত্যনতুন বিষয় ভাবনা আসছে। রবীন্দ্রনাথ সবসময়ই প্রাসঙ্গিক, রথীঠাকুরও আধুনিক মননকে লালন করছেন সর্বদা। তবে বর্তমানের বিশ্বভারতী পরকে আপন করতে গিয়ে আপনাকেই যেন কেমনভাবে দূরে সরিয়ে রাখছে। প্রবীণ আশ্রমিকরা এ চত্বরে এলে তাঁদের আলোচনায় তা বারবার ফিরে আসে।
শান্তিনিকেতনে রথীঠাকুর যেন দুয়োরানি। রবীন্দ্র পরবর্তী সময়ে পিতার লেখনিকে নথিবদ্ধ করে সমৃদ্ধশালী রবীন্দ্রভবন উপহার তো তাঁরই। আজ যে গবেষকদের মূল আকর্ষণ রবীন্দ্রভবন, তার জন্য নিরলস পরিশ্রম করেছেন রথীঠাকুর। মৃণালিনীদেবীর মৃত্যুর পর সদ্য মা হারা ছেলেকে ডেকেছিলেন গুরুদেব। রথীন্দ্রনাথের হাতে সেদিনই তুলে দিয়েছিলেন মৃণালীনিদেবীর চটিজোড়া ও তাঁর পাণ্ডুলিপি। রবীন্দ্রভবনকে সেসব দান করেছেন রথীন্দ্রনাথ। কত বইও সেই তালিকায় ছিল। আজ যেখানে সমৃদ্ধশালী বিশ্বভারতীকে আমরা আপনারা আগামীর ভবিষ্যৎ দেখবে তাঁর ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলেন রথীন্দ্রনাথ। যাঁকে বিশ্বভারতী সেভাবে মনেই রাখেনি, শুধুমাত্র ২৭ নভেম্বর শ্রীনিকেতনের রথীন্দ্র মেলাটুকু ছাড়া।