গৌরব চৌধুরী
শান্তিনিকেতন যেন একটা আত্মা যার মধ্যে আমি মিশে গিয়েছি। জীবনের ১৮টা বছর আসনাসোলে কাটিয়েছি। আর বাকি ১৭টা বছর শান্তিনিকেতনে। সমানই তো প্রায়, তাই না! মাঝে মাঝে যখন আশ্রমের মধ্যে হাঁটতে থাকি তখন মনে হয় আমি এখানকারই। তখন মন একটা দোটানার মাঝে থাকে। বোধহয় কোনও এক সময় ছিলাম, হয়তো বা ছিলাম না। সে স্মৃতি আর নেই। কিন্তু আজ শান্তিনিকেতনের একজন হয়ে গেছি।
এখানকার কোনও উৎসব সম্পর্কে বলতে গেলে তিনভাবে ব্যাখ্যা করব। প্রথমেই আসছে, নিজের চোখে দেখা। ১৭ বছর ধরে যা দেখলাম। এরপর আছেন এখানকার পুরনো আশ্রমিকরা। যাঁরা আছেন তাঁদের অভিজ্ঞতা অমূল্য স্মৃতির অংশ বিশেষ। যেসব শোনার সৌভাগ্য হয়েছে। অনেকেই চলে গিয়েছেন, তাঁদের আনন্দঘন দিনগুলিও স্মৃতিতে বাসা বেঁধেছে। আর তিন নম্বরে আসে বই। সেসব দিনের শান্তিনিকেতনের উৎসব সমূহের খবর পাই গুণীজনের লেখা বই পড়ে। আমার মতো অনেকেই আছেন, যাঁরা বই পড়ে তখনকার দিনের শান্তিনিকেতনের উৎসবের ইতিহাস জেনেছেন। আরও পড়ুন- ফেলে আসা মেয়েবেলা ও মন কেমনের বসন্ত উৎসব
প্রতিটা মুহূর্ত আমাকে কিছু না কিছু শিখিয়েছে। শান্তিনিকেতনের প্রকৃতি যেন কথা বলে। গুরুদেবের লেখার সঙ্গে প্রকৃতির যে এক বন্ধনহীন যোগাযোগ রয়েছে তা ভাল করে লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে। রবীন্দ্রনাথের গানে শান্তিনিকেতন কথা বলে। “মধুর তোমার শেষ যে না পাই” গানে। “সায়ন্তনের ক্লান্ত ফুলের গন্ধ হাওয়ার পরে অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনে সকল অঙ্গ ভরে।” অঙ্গবিহীন আলিঙ্গন হয়? এই দর্শন কোথায় আছে? একমাত্র রবীন্দ্রনাথেই আছে। গানের ব্যাখ্যায় গেলে দেখা যায়, হাওয়া অঙ্গবিহীন। গন্ধও তাই। অঙ্গবিহীন সেই গন্ধ হাওয়া বয়ে এনে তোমার কাছে পৌঁছে দেয়। তখন কি তোমার সকল অঙ্গ ভরে না? আশ্রমের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে আনমনা নাক যেমন বকুল ফুলের গন্ধ পায়।
ছাতিম ফুলের গন্ধই ধরা যাক। পুজো যখন আসছে আসছে করছে, তখন আশ্রমের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে সুমিষ্ট গন্ধ। আবেশে মনটা ভরে যায়। প্রথম যখন আমের মুকুল ফোটে, একটা হালকা মিষ্টি গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। সে শান্তিনিকেতনই এনে দেয়। সারা পৃথিবী ঘুরলেও এমনটা কোথাও পাব না। একমাত্র আনন্দ পাঠশালার বাচ্চারাই বলতে পারে জন্ম দিনে, মৃত্যুদিনে, ঋতু অনুযায়ী কোন গান কখন গাইতে হয়। এমন প্রকৃতির পাঠশালা কোথায় পাবে, শান্তিনিকেতন ছাড়া? আরও পড়ুন-দোল এলেই ভয় হয়, উন্মত্ত জনতার ভিড়ে একলাটি শান্তিনিকেতন
রবীন্দ্রনাথ তো কোথাও যাননি, তিনি শান্তিনিকেতনের আকাশে বাতাসে মিশে আছেন। সব দেখছেন। সময়সুযোগ মতো উপস্থিতিও অনুভব করতে পারি। সংগীতভবনের ছাত্র হিসেবে কত কী যে শেখার সুযোগ পেয়েছি। অমর্ত্যদার তত্ত্বাবধানে একবার ফাল্গুনী নাটক মঞ্চস্থ হল অভিনবভাবে। চারটে দৃশ্যের জন্য চারটে মঞ্চ। নাট্যঘরে তখন সংস্কার চলছে। সামনের মোরামের প্রাঙ্গণেই হল মঞ্চ। রবীন্দ্রভবনের দিকে মূল মঞ্চ প্রথম দৃশ্যের মঞ্চায়ন সেখানে হবে। দ্বিতীয় মঞ্চটি হল রামকিংকরে পেইন্টিং ডিপার্টমেন্টের মুখোমুখি নাট্যঘরের তারের বেড়ার যে চৌহদ্দি রয়েছে তার মধ্যে। সেখানে মাঝিদের সঙ্গে কথাটথা বলে হেঁটে চলে গেলাম তৃতীয় মঞ্চে। এটি তৈরি হয়েছিল এখন নাট্যঘরের যে কোণাকুণি গেট রয়েছে, ঠিক সেখানটায়। মঞ্চে সেখানে পাতা ঝরে যাওয়ার বিষন্নতা সংক্রান্ত ডায়ালগ ছিল। হঠাৎ করে দমকা হাওয়া এল। আমাদের মাথার উপরে সোনাঝুরি গাছ। সেই হাওয়াতে ঝর ঝর করে সোনাঝুরির পাতা পড়তে শুরু করল। মঞ্চের পিছনে রাস্তার আলো এমনভাবে এসে পড়েছে যেন চাঁদ সবে তার পূর্ণরূপ ধারণ করতে চলেছে। সেই কমলা ঘেঁষা আলো। এমন প্রাকৃতিক আবহসংগীত কোথায় মঞ্চস্থ হয়? সেখান থেকে চতুর্থ মঞ্চে আমাদের আগমন। তখন চন্দ্রহাসের হারিয়ে যাওয়ার গল্প। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। চারদিকে গাছের মাঝখান দিয়ে আমরা এগিয়ে আসছি “ওরে আয়রে সবে মাত্রে” গাইতে গাইতে মঞ্চে উঠে নাটক শেষ করলাম। মজার বিষয় হল চারদিকে যখন মঞ্চ তখন দর্শককে তো মাঝখানেই বসতে হবে। সেটাই হয়েছে, দর্শকদের ঘিরেই আমরা ঘুরে ঘুরে অভিনয় করে গেছি। আমরাও ঘুরছি মঞ্চও পরিবর্তন হচ্ছে। আরও পড়ুন- স্বস্তিকাদি গাইছেন “নিবিড় অমা তিমির হতে বাহির হল”, গৌর প্রাঙ্গণের আকাশে তখন মেঘ সরে চাঁদ উঠছে__ এভাবেই আমার বসন্তকে দেখা
এমন সুযোগ আর কোথায় পাব? “যে রজনী স্বপনও লাগে আজ নূতনের হাসিতে। আমরাও খেলা খেলেছিলেম, আমরাও গান গেয়েছিলেম।” এ জীবনে কী আর ফিরে পাব? আমাদের গান শুনে যদি স্রোতা বলেন, কী ভাল গাইল। ওইটুকুতে আমাদের মন ভরে না। আমরা শান্তিনিকেতনিরা শ্রুতিমধুরে বিশ্বাস করি না। আসলে শান্তিনিকেতন যা তৈরি করে দেয় তাহল স্মৃতিমধুর। এখানে ঘুরতে এলে শান্তিনিকেতনকে পাওয়া যায় না। এই মাটিকে অনুভব করতে হয়। এখন মনে হয় কেন ছোটবেলা থেকে শান্তিনিকেতনে থাকিনি। কেন ওই বাচ্চাদের মতো গান গাইতে গাইতে সন্ধেবেলায় খেতে যাইনি। যার কাছে শান্তিনিকেতন আছে তার সব আছে। শান্তিনিকেতনের মতো বড় বন্ধু আর কে আছে। যদি শান্তিনিকেতনকে অনুভব করতে চাও, দুঃখটাকে ছুঁতে চাও, তাহলে এর ভিতরেই আনন্দকে পাবে।
এবার তো বসন্তোৎসব হল না। কিন্তু দেড়মাস ধরে তো রিহার্সাল চলেছে। দোলের দিন দুয়েক আগেও এক সন্ধ্যাবেলা ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। তখন রিহার্সাল চলছে, “গুরু গুরু গুরু গুরু ঘন মেঘ গরজে” গানটির সঙ্গে সঙ্গেই বজ্রপাত হল। এই যে মিলিয়ে দেওয়া, এ কে দেবে? শান্তিনিকেতনই দেবে। বসন্ত এভাবেই আমি শান্তিনিকেতনে পেয়েছি, বর্ষামঙ্গল পেয়েছি। শারদোৎসবে শিউলি ফুলের গন্ধ এভাবেই পেয়েছি। হেমন্তে কুয়াশাও তাই। “হায় হেমন্ত লক্ষ্মী তোমার নয়ন কেন ঢাকা?” হেমন্তে আশ্রম মাঠের উপরে কুয়াশারা ছেয়ে থাকে। স্বর্গ এখানেই আছে। “আমরা যেথায় মরি ঘুরে সে যে যায় না কভু দূরে, মোদের মনের মাঝে প্রাণের সেতার বাঁধা যে তার সুরে।” তার মতো আর কে বা আছে! সে যে আমাদের সব হতে আপন, আমাদের শান্তিনিকেতন।