তৃণাঞ্জয় ভট্টাচাৰ্য্য
সাদার্ন অ্যাভিনিউ রাস্তাটা বরাবর ভীষণ প্রিয় কাবেরীর| এমনি দিনের থেকে মেঘলা দিনে এই রাস্তার রূপটা যেন আলাদাই হয়ে ওঠে কিছুটা| অনেকটা দার্জিলিঙের ঘুমের মতো| এমনি দিনে সাধারণ একটা পাহাড়ি স্টেশন| কিন্তু মেঘলা দিনে যেন মেঘের বাড়ি হয়ে যায় পাহাড় কন্যা ঘুম| আদরের সাদার্ন অ্যাভিনিউ যেন ঠিক তেমন| একদম বালিশ ভেজা কান্নার মতো| চিৎকার করে লোক জানানো নয়| বাথরুমে জলের ট্যাপ খুলে দিয়ে আছাড় খেয়ে ভেঙে পড়াও নয়| সেই কান্না অভিমানের| সেই কান্না একান্ত নিজের| সে শুধু মুখ চেপে ধরা বালিশটাই জানে| আজ যখন অর্চনাদি চর্যাপদের ক্লাস নিচ্ছিলেন, আর ডানপিটেরা নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করতে ব্যস্ত ছিল, কাবেরী একদৃষ্টে চেয়েছিল ওর দিকে|
ঘাড়ের কাছে চুলগুলো শক্ত বিনুনি বাঁধার কারণে কেমন অবাধ্যের মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সকালের শিশির ধোয়া দূর্বার মতো| কানের সামনে ঠিক ময়ূরপঙ্খী কল্কার মতো জুলফি| চেরা সিঁথি| ঘামে ভিজে গায়ের রঙের সঙ্গে মিশে যাওয়া সাদা ব্লাউজ ছাড়িয়ে পিঠের মাঝখান অবধি বিনুনি| সাদা পাড় নীল শাড়িটা এত যত্ন করে বোধহয় স্কুলের আর কোনও মেয়ে পরে না| মুখটা করবী ফুলের মত গোলাপি| দিনের শুরুতে সেটা থাকে হালকা গোলাপি ডালিয়ার মতো| তারপর দিনের তাপ বাড়তে বাড়তে আর মাথার ওপরে থাকা মান্ধাতার আমলের পাখাটার জ্বালাতনে সারা মুখটা কেমন শুকিয়ে আসে| একইসঙ্গে আরও গাঢ় হয়ে যায় গোলাপি রংটা|
গাঢ় হয় বুকের সামনে লেপটে থাকা হালকা নীল শাড়িটাও| বুকের খাঁজ থেকে প্রথমে ভিজে যেতে থাকে| ভিজে যায় তরুণী সিংহীর মতো সরু কোমর আর পিঠ, হালকা মেদবহুল পেট| সারা মুখে ফুটে ওঠে আষাঢ়ের নতুন বৃষ্টির মতো বিন্দু বিন্দু জল সবকিছু একদৃষ্টে দেখতে থাকে কাবেরী| ওর নাম দেবাদৃতা| ইলেভেনে আসার আগে ভাবতেই পারেনি কারোর সৌন্দর্য ওকে এভাবে আকর্ষণ করতে পারে। ঋতুমতী হওয়ার পর থেকে নাকি নারীদেহ পুরুষ সঙ্গী পাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে| এটাই পৃথিবীর আদিমতম সত্য| ঋতুর নিয়মই ধারণ করা| আর সেই ধারণ করবে প্রকৃতি| অথচ, কাবেরী ক্রমশ জড়িয়ে পড়ছে দেবাদৃতার মতো সুন্দরীর অঙ্গে অঙ্গে৷ তাহলে কী ও ঋতুর বিপরীতে? প্রকৃতির বিপরীতে? আচ্ছা, ও নারী তো? কাকে করবে এই প্রশ্নটা?
চর্যাপদের কিছুই কানে ঢুকছিল না| মাথায় ঢোকা তো দুরের কথা| অর্চনাদির অস্তিত্ব বলতে, সামনের বেঞ্চে ভেসে আসা সুগন্ধি জর্দার গন্ধ| মিঠে পাতার জর্দা পান চিবোতে চিবোতে ক্লাসে পড়াতে গিয়ে ঠোঁটের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানের লাল রস| ইচ্ছে করে হাত পেতে একটু ছাচি নেবে| যেমন ছোটেট বয়সে নিত ঠাকুমার থেকে| পান চিবিয়ে মিষ্টি ছাচিটা মুখের মধ্যে দিয়ে দিত আম্মা| আম্মা চলে গেছে আট বছর হল| কিন্তু ঢাকুরিয়ার বাড়িতে এখনও আছে আম্মার পানের বাটাটা| ঐদিকে তাকালেই মনটা ডুকরে ওঠে কাবেরীর| লেক কালীবাড়ির পাশের পানের দোকানটা আম্মার চেনা ছিল| রবীন্দ্র সরোবরে আম্মার সাথে ঘুরতে এলে, ঐ পানের দোকানে যাওয়াটা যেন অলিখিত নিয়ম ছিল| অর্চনাদিকে দেখলেই যেন আম্মার মুখটাই ভেসে ওঠে কাবেরীর চোখে|
হঠাৎ, দেবাদৃতা ওর দিকে তাকালো| সারা শরীর যেন কাঁটা দিয়ে উঠল কাবেরীর| সবকিছু ধরা পড়ে গেল ওর কাছে? মুচকি হেসে ওর দিকে একটা কাগজের টুকরো ছুঁড়ে দিল দেবাদৃতা| মুখের মধ্যে এসে টুকরোটা লাগতেই ঘোর থেকে ছিটকে উঠল কাবেরী| ছোট্ট চিরকুটটায় লেখা,
“পাগলী!”
সেলিমপুরের মোড়ে ছেলেগুলো যখন ওর দিকে উপাোষী কুকুরের মতো তাকায়, তখন কোনওদিন এরকম অনুভূতি হয়নি কাবেরীর| ওদের মধ্যে কী একটাও এমন ছেলে ছিল না, যাদের কোনও মেয়েরও ভাল লাগতে পারে? নিশ্চই ছিল না৷ বা কে জানে, থাকলেও থাকতে পারে| কিন্তু, ওরা কোনওদিনও বুকের ভিতরে জায়গা করতে পারেনি কাবেরীর| কেয়াতলা রোডের প্রথম গলিটার সামনে থামল স্কুলবাসটা| অণ্বেষা নামবে| ওইতো ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে আছেন ওদের বাড়ির কৃষ্ণাদি।
ফুটপাথের সামনে এমনিতেই আবছায়া অন্ধকার| আর বিপরীতে লেকের জলে সাদা আল্পনা দিচ্ছে অঝোরে বৃষ্টি| বাস থেকে এখনই নেমে যেতে ইচ্ছে করছিল৷ যাতে বৃষ্টির জলের সঙ্গে মিশে যায় গাল বেয়ে নেমে আসা জলের ধারা| কেউ যেন না জানতে পারে, পদ্মপুকুরের জলের মতোইতোলপাড় চলছে ওর নিজের মনের মধ্যে।
“ঐ মন, চলনা আজকে বৃষ্টির মত কাঁদি, অপরাধী সব নিঃশ্বাস যেন – বাষ্প হয়ে ছোটে। আকাশের গায়ে মেঘ হয়ে তারা – মাথার চাঁদর হোক; অঝোর ধারায় ভেজাবে আমায়, বন্ধ থাকবে চোখ| ভয়ঙ্কর এই বিকেলের পরে, রাত হবে আহ্লাদি; ঐ মন, চল না,আজকে রাস্তায় নেমে কাঁদি৷”
পুজোর ছুটির আগে স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটা বরাবরের অন্যতম আকর্ষণ হাইস্কুলের সকলের কাছে। ক্লাস এইট থেকে কাবেরীই নৃত্যনাট্যের দায়িত্ব সামলে এসেছে। কিন্তু, এবারটায় আর সেভাবে মন বসাতে পারছে না রিহার্সালে। “শাপমোচন” কাবেরীর কাছে খুব কঠিন কিছু নয়। কিন্তু কমলিকার অঙ্গভঙ্গীতে দেবাদৃতাকে দেখে নিজেকে সামলে রাখতে পারছে না। ও নিজে অরুণেশ্বর করছে। “বড় বিস্ময় লাগি” গানটার সময় যখন দেবাদৃতা ওকে পূর্ণ আলিঙ্গন করছে, নিজেকে তখন সামলে রাখতে পারছে না কাবেরী। সেদিন রিহার্সাল শেষ করতে সাড়ে পাঁচটা বেজে গেল। কাবেরী গেল ওয়াশরুম। যেন স্বর্গ থেকে যে বিরহবেদনা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে অরুণেশ্বর, যৌবনে তার তাপ উঠল প্রবল হয়ে উঠেছে৷
মুখে চোথে উন্মাদের মতো জল দিচ্ছে কাবেরী। কারোর কাছে ও কিছু ধরা পড়তে দেবে না। হাত আর পায়ের তালু জ্বালা করছে উত্তেজনায়। মনে হচ্ছে এখনই উন্মত্ত বাঘিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে দেবাদৃতার উপরে। নিজের মুখটা দেখতেও যেন ভয় পাচ্ছে ও। ক্রমশ কোনদিকে চলে যাচ্ছে? কী করে মুখ দেখাবে সব জানাজানি হলে? পৃথিবীর কেউ নেই যে ওর মনের অবস্থা বুঝতে পারবে। হঠাৎ ওয়াশ রুমের দরজাটা খুলে গেল। দরজাটা ধরে কী অদ্ভুতভাবে দাঁড়িয়ে আছে দেবাদৃতা। নিজের স্নায়ুর উপরো যত কর্তৃত্ব আছে সবকিছু দিয়ে নিজেকে লুকোনোর চেষ্টা করছে কাবেরী। কিন্তু একী! নিজের ঠোঁটটাকে তিনটে দাঁতে কামড়ে ওর দিকে এগিয়ে আসছে দেবাদৃতা। কী যেন অদ্ভুত একটা ইঙ্গিত আছে ওর চোখদুটোতে। আর কী করে সম্ভব নিজেকে ধরে রাখা?
ওর দিকে এগোতে এগোতেই শাড়ির প্লিটে আটকে থাকা কাঁটাটা খুলে দিল দেবাদৃতা। কী অসম্ভব লাস্যময়ী দেখাচ্ছে ওকে এই মুহূর্তে! বুকের থেকে শাড়িটা নেমে এসেছে বেশ খানিকটা। কাবেরীর পক্ষে আর নিজেকে সামলে রাখা খুব কঠিন হয়ে পড়ছে। নিজের অসহ্যতা লুকোনোর জন্য দেবাদৃতার থেকে মুখ সরিয়ে নিল বেসিনের দিকে। আর ঠিক তখনই দেবাদৃতা পিছন থেকে জাপটে জড়িয়ে ধরল ওকে। দেবাদৃতার নরম শরীরটা ওকে মৃদু ধাক্কা দিচ্ছে পিছন থেকে। ওর পরিমিত স্তন নিঃশ্বাসের সাথে সাথে ওঠানামা করছে। ওর কোমরে এখন দেবাদৃতার হাত। আর নরম ঠোঁটদুটো ঠিক ঘাড়ের কাছে যেন কোন অনির্দেশের কাহিনী লিখে চলেছে। -এটা তুই কী করছিস দেবী? কাবেরীর চোখ দুটো বন্ধ। উত্তেজনায় তিরতির করে কাঁপছে দুটো ঠোঁট। বারবার ইচ্ছে করছে সামনের দিকে ঘুরে দেবীকেও একইরকম আদরে ভরিয়ে দিতে। তবুও জোর করে নিজেকে ধরে রেখেছে কাবেরী আরও পড়ুন-কালান্তরের পটভূমি
আমাকে ছেড়ে দে না দেবী| ওর গলায় যেন অনিচ্ছার আকুতি। এই শালা লেবু। তুই কী চাস আমি জানিনা, তাই না? কী খুঁজে বেড়াস আমার মধ্যে আমি দেখতে পাই না? এত ভয় কীসের তোর? জোর করে কাবেরীকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল দেবাদৃতা। মিশে গেল দুটো ঠোঁট দুটো ঠোঁটের মাঝে।
“ফল্গু যখন নিজের মতো বালির নিচে প্লাবন চেপে – সাগরে গড়িয়ে চলে; বৃষ্টি তখন পিঠের ওপর – টাপুর টুপুর আদর করে প্রেমের গল্প বলে। আজ ফল্গুর জলের ধারা, ছুটছে কোনও কারণ ছাড়া, প্রকৃতিও যেন ছন্নছাড়া – নিজের আগুনে জ্বলে। অলকানন্দা মিশে গেছে আজ, মন্দাকিনীর জলে৷”
হঠাৎ, দরজায় জোরে জোরে শব্দ হল। নিজেকে সামলে নিয়ে ছিটকে উঠল দেবাদৃতা। শাড়িটা আগের মতো টানটান করে ঠিক করে কাবেরীর কপালে একটা হালকা চুমু খেয়ে সেখান থেকে চলে গেল দেবাদৃতা। একা ওয়াশরুমে বেসিনের কলটা খুলে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল কাবেরী। হাউসকিপিংযের ভদ্রমহিলা এসেছেন বাথরুম পরিষ্কার করত। “তাড়াতাড়ি করো দিদি। তোমাদের সাউথের বাসটা তো হর্ন দিচ্ছে কথন দিয়ে।” আরও পড়ুন-স্রোতের গন্ধ
একছুটে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ক্লাসে গেল কাবেরী। ব্যাগটা নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে খুব ধীরে ধীরে নামল। আজ যা হল, তার পুরোটা যেন ওর এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। একদম পিছনের সিটের জানলার ধারে বসেছে কাবেরী। শাপমোচনের বিভিন্ন স্টেপ নিয়ে বাসের মধ্যে আলোচনা করছে সকলে। কেউ গান গাইছে, কেউ নিজের মতো স্টেপও অভ্যাস করছে। কোনও কিছুতেই যোগ দিতে ইচ্ছে করছে না ওর। হেডফোনটা কানে দিয়ে মোবাইলে গান চালাল। “আনমনা আনমনা, তোমার কাছে আমার গানের মাল্যখানি আনবো না…”
অপরাজিতা রঙের বেনারসীতে শ্রাবণের মেঘের মতো লাগছে দেবাদৃতাকে। “তুমি কি কেবলই ছবি৷” গানটাতে তিনবার স্টেপ ভুল হয়েছে। যদিও কেউ কিচ্ছু বুঝতে পারেনি। কিন্তু কাবেরী জানে, ও রবীন্দ্রনাথের নৃত্যের তালে পা মেলাচ্ছে না। ওর ভিতরে চলছে অনাদিকালের বিরহবেদনা। দেহটাকে শীতের ঝরা পাতার মতো লুটিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। কখন, কখন একটু আলিঙ্গনের সুযোগ পাবে দেবীকে। যেন অরুণেশ্বরের আঁধারবাস আজ তাকেই ভর করেছে। সুজাতা সদন হল, সকলের বাড়ির লোক, অন্ধকারের উপর থেকে ঠিকরে বেরোনো স্পট লাইটের আলো, সবকিছু ছেড়ে কাবেরী এখন ওই নীলবসনার দিকে মনপ্রাণ ঢেলে বসে আছে। আরও পড়ুন-Bansberia: চলুন যাই দেখে আসি, বাঁশবেড়িয়ার ৩৪১ বছরের অনন্ত বাসুদেব মন্দির
ওই যে জায়গাটা, যেখানে কাজী সব্যসাচী উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠেন, “জ্বলে উঠল আলো, আবরণ গেল ঘুচে, দেখা হল। টলে উঠল দু’জনের সংসার। কমলিকা ঘর থেকে ছুটে বাইরে বেরিয়ে গেল৷” কিন্তু, রাজার জগৎ থেকে তাকে ডাক দেওযার সময় ঘটে গেল এক ভয়ঙ্কর ঘটনা। মাথা ঘুরে মঞ্চের মাঝখানে লুটিয়ে পড়ল কাবেরী। দর্শকদের মধ্যে হইচই পড়ে গেল। মঞ্চের মধ্যে চলে এসেছে ব্যাকস্টেজের অনেকেই। কিন্তু এখনও কারোর অডিওটা বন্ধ করার কথা মনে হয়নি। সেখানে এখনও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে বাজছে, “আজও বকুল আপন হারা, হায়রে….৷”
আর কেউ জানেনা। সবাই যখন মুখের মধ্যে জলের ছিটে দিচ্ছে। সামান্য খোলা কাবেরীর চোখ৷ ও তাকিয়ে আছে নীল বসনা দেবীর দিকে। সেকেন্ড উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে বিরক্তিতে চোখ বুজে আছে দেবাদৃতা। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে কাবেরীর। কেউ বুঝবে না। কারণ এমনিই এখন সারা মুথে জল। আইলাইনার, চন্দন, রঙ সব মিলেমিশে একাকার। একবার, একবার যদি দেবী ঠোঁটটা চেপে ধরে ওর ঠোঁটের মাঝে! যদি ওর জিভের ক্লোরমিন্টের ঐ গন্ধটা একবারও পেত, আবার উঠে দাঁড়াতে পারত কাবেরী। ব্যাকগ্রাউন্ডের অডিওটা এখনও বাজছে, “মিলন পিয়াসী মোর কথা রাখো কথা রাখো…”
-“আর বলবেন না। কী নাটক শুরু করেছে। খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বিপি ১১০/৫৫, ভাবতে পারেন?” “নানা, আপনারা চিন্তা করবেন না। আমরা দেখছি, কী করা যায়৷” স্কুল থেকে শুভ্রাদি ফোন করেছিলেন বাবাকে। বাবা চিরদিনই ভীষণ কড়া। কোনওদিনও বোঝেনি কাবেরীকে। একজন মেযে কোন সময় খাওয়া বন্ধ করে দেয়, কী করে বুঝবে বাবা? আজকের দিনেও মেয়েদের একমাত্র বন্ধু কান্না।
প্রোগ্রামটা ভেস্তে যাওয়ার পর থেকে ফোনটা সুইচ অফ করে রেখেছে দেবাদৃতা। উন্মাদের মতো ফোন করছে কাবেরী। কিছুতেই পাচ্ছে না। আসলে ও যে সবাইকে এইভাবে বিপাকে ফেলবে তা কি ও নিজে জানতো? দেবী কেন রাগ করছে ওর উপরে? “একবার ফোনটা অন কর দেবী, একবার অন কর”। হঠাৎ, ফেসবুকে একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এল। শুভ্রনীল অধিকারী। সেলিমপুরে বাড়ি। হ্যাঁ, ছেলেটাকে চেনে কাবেরী। হিস্ট্রির টিউশনে একসঙ্গে পড়ত। ভীষণ মেধাবী ছেলে। সেই সময় অনেক কথা হতো ছেলেটার সঙ্গে। আরে, ফেসবুকটা ফ্রিজ হয়ে গেল কেন? কল আসছে? কে ফোন করছে? দেবী?….. উত্তেজনায় চিৎকার করতে ইচ্ছে করছিল কাবেরীর। তার বদলে ঝরঝর করে কাঁদতে শুরু করল। আওয়াজ করে কোনওদিনও কাঁদেনি। কিন্তু আজ কোনও বাধা নেই ওর আর দেবীর মধ্যে। “আজ আকাশের বাধ ভেঙেছে, কীসের লজ্জা ভয়? মেঘেরা যদি আমাদের হয় -ভাবনা কীসের তবে? এই রবিবার ভাতঘুম আর জংলী ভ্রমণ হবে। ভয় করিনা আর; বোতাম খোলা বারান্দাতে -আমাদের অধিকার। লালার রসে ভরিয়ে দেব বিকেলের স্কুলবাস। যদি না বৃষ্টি হয়; আজ সহবাস আগল ভেঙেছে কীসের লজ্জা ভয?” আরও পড়ুন-Shankha Ghosh:“আমার বলে রইল শুধু, বুকের ভিতর মস্ত ধু ধু”
রবিবার সকাল থেকে ভীষণ ব্যস্ত কাবেরী। আজ দেবী আসবে। এমনিতে কখনওই রান্নাঘরে ঢোকে না ও। কিন্তু, আজকের ব্যাপার সম্পূর্ণ আলাদা। আজ নিজের হাতে দেবীর ফেভারিট চিলি চিকেন রান্না করছে কাবেরী। ফ্রাইড রাইসটা অবশ্য মা করবে। কারণ, ওটা এখনও খুব ভাল করে পারে না। আজ দেবীকে চমকে দিতে হবে পুরো। এমন কিছু করতে হবে, যা দেবী ভাবতেই পারে না। কী করবে? ফুল দিয়ে সাজাবে পুরো বাড়িটা? ওর নিজের প্রিয় ফুল জুঁই, আর দেবীর রজনীগন্ধা। দুটো ফুল দিযেই ঢেকে দেবে তিনটে ঘর? বাবা, মা বকবে না তো? বলবে না তো, এত বাড়াবাড়ির কী দরকার?
যদিও বাবা আজকে থাকবে না। যাবে মনোহর আঙ্কলদের বাড়ি। মা তো দুপুরে টিভি নিযে পড়বে। কাবেরীর বেডরুমে উঁকি দেওয়ার কোনও চান্সই নেই। আজ নিজেকে সমর্পন করার দিন। আজ যেন কোনও কুণ্ঠা মনে না থাকে। মনপ্রাণ দিযে যাকে চায়, আজ তার কাছে ঢেলে দিতে হবে নিজেকে। প্রথমদিন দেবীই এগিয়ে এসেছিল। সেই দিনটা আজও যেন কাবেরীর অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। আর প্রোগ্রামের দিন। সমস্ত, খুঁটিনাটি তন্ন তন্ন করে নিজের হাতে গুছিয়ে রেখেও, কীভাবে ভেঙে পড়ল সকলের সামনে। একটা কথা কাবেরী পরিষ্কার বুঝে গেছে, এই পৃথিবীতে দেবী ছাড়া আর কেউ নেই, যে ওর ভিতরের প্রেমিকটাকে চিনতে পারে। ওকে বুঝতে পারে।
আজও ও নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে। সকলের কাছে। কিন্তু কেন? কেন ওর নিজের লিঙ্গ বেছে নেওয়ায় স্বাধীনতা থাকবে না? ও মেয়ে হয়ে জন্মেছে, এতে ওর কোনও হাত ছিল না। কিন্তু, মনে মনে ও পুরুষ হতে চায়। কেন কেউ সেই ইচ্ছেতে বাধা দেবে? দেবীকে দেখলেই ওর মনে আদি পুরুষ জেগে ওঠে। দেবীই সেই পুরুষের প্রকৃতি। আর একটু হলেই পাঁচটা পকৌড়া একদম পুড়ে যেত। এক ঝটকায় যেন সম্বিত ফিরল কাবেরীর। পকৌড়া গুলো দুই তিনবার উল্টে তুলে নিলো, যাক পোড়েনি। পকৌড়া ভাজা শেষ। এবার গ্রেভি বানানো দু’মিনিটের ব্যাপার। চিলি চিকেনটা নামিয়ে স্কুটি বের করতে নিচে নামছে কাবেরী। লেক মার্কেট যাবে, ফুল আনতে।
-মা কিচেন খালি। তুমি রাইসটা বসিয়ে দাও। হরিণীর মতa লাফাতে লাফাতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে স্কুটি বের করল। লেক মার্কেট গিযে, মোটা গোড়ের জুঁইয়ের মালা আর রজনীগন্ধার এক ডজন স্টিক কিনে স্কুটি স্ট্যান্ড করে আবার ঘরে ফিরে এল। সবমিলিযে সময় লাগল মোট ৫০ মিনিট। মা চিৎকার করে উঠল, “তুই কী লম্ফঝম্প শুরু করেছিস বলত? এখনও প্রেসারটা এত লো৷” ও তুমি বুঝবে না মা। তৃপ্তির হাসি কাবেরীর মুখে। আজ একটুও ক্লান্তি নেই ওর। নাহ, এখনও অনেকটা সময় হাতে আছ। দেড়টায় আসবে দেবী। এখন মোটে সাড়ে এগারোটা। তাড়াতাড়ি তিনটে ঘর সাজিয়ে ফেলতে হবে। নিজেই উঠছে চেয়ারের ওপরে। কাঁটা পেরেকগলো লাগানোই আছে দরজায়। জুঁইযের মালাগুলো টাঙাতে কোনও অসুবিধাই হল না। বেডরুমের বেডসাইড টেবিলটাতে রজনীগন্ধার স্টিকগুলো রেখে স্নানে ঢুকল কাবেরী। যাওয়ার আগে একবার ফোনটা চেক করল। দেবীর হোয়াটসঅ্যাপ, “কী করছিস ক্ষেপি?”- অপেক্ষা…
লেখার পরেই কেমন একটা ঢেউ খেলে গেল কাবেরীর বুকে। আজ খুব ভাল করে স্নান করতে হবে। গুনগুন করতে শুরু করল। “কী জানি সে আসবে কবে, যদি আমায় পড়ে তাহার মনে…” বাথরুম থেকে বেরিযেই ফোনটা দেখল আবার। নিশ্চই ঢাকুরিয়ায় এসে বাড়ি গোলাবে দেবী। যদিও ও আসতে এখনও বেশ কিছুটা দেরি আছে। উফফ, সময়টা কিছুতেই কাটছে না কেন? হঠাৎ কলিং বেলটা বেজে উঠল। তখনও চুলগুলো ভিজে। কী করবে? মাকে দরজা খুলতে বলবে না নিজেই যাবে? দরজা খুলেই চমকে উঠল কাবেরী, সৌরনীল! আরও পড়ুন-একটা বৃষ্টি দিন ও ভাল-বাসার নবনীতা
যাক। একেবারেই চিনতে পেরেছ। গত তিনদিন ধরে মেসেঞ্জারে মেসেজ করছি। সিন করছ না কেন? প্রয়োজন মনে করিনি৷ নিজেকে কী মনে করো তুমি? আমার সঙ্গে সম্পূর্ণ অচেনার মতো ব্যবহার করছ? কী পরিচয় তোমার সঙ্গে আমার? টিউশন ক্লাসে একসঙ্গে পড়তাম। আর কিছু? আর কিছু নয় কাবেরী? তুমি বোঝোনি, প্রথমদিন থেকে আমি…৷ সেটা সম্ভব নয় সৌরনীল। কোনওভাবেই সম্ভব নয়। কেন সম্ভব নয়? এত ভ্যানিটি কেন তোমার? আমি৷ বেরিয়ে যাও। এই মুহূর্তে বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে। একটাও কথা না বলে মাথা নিচু করে পিছনে ফিরল সৌরনীল। এগিয়ে গেল দরজার দিকে।
শোনো, ঘাড় ঘোরালো সৌরনীল। যাওয়ার আগে, উত্তর না দেওয়ার কারণটা জেনে যাও। এখনও একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সৌরনীল। আমি আর পাঁচজন মেয়ের মতো নর্মাল নই। আমি একজন ট্রিবেড, একজন লেসবিয়ান। সেই মুহূর্তে ঘরের মধ্যে যদি বজ্রপাত হতো, অনেক স্বাভাবিক লাগত সৌরনীলের৷ কিন্তু এটা কী শুনল ও? আর একটাও কথা না বলে, দরজার দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। এর ঠিক ১৫ মিনিটের মধ্যে ঘরে ঢুকল দেবী। দেবীকে দেখে ঠিক যতটা হাসি ফুটে ওঠা উচিত ছিল কাবেরীর মুখে, ততটা যেন ফুটে উঠল না। আর সেটা দেখেই দেবী ঘরে ঢুকেই জাপটে জড়িয়ে ধরল কাবেরীকে।
একটু আগে কে এসেছিল রে মামন? দেবীকে দেখেই আনন্দে চমকে উঠলেন কাবেরীর মা। আরে দেবী রানি, চলে এসেছ? যাক এবার আমি একটু শান্তি পেলাম। কতবার যে আমাকে দুটো আঙুল নেড়ে নেড়ে একটা আঙুল বেছে নিতে বলেছে, তার ঠিক নেই। মা বলো আসবে কী আসবে না। উফফফ! তবে, একটু আগে কে বেল বাজাল মামন? যাক, মা তাহলে কিছুই শোনেনি। একটু যেন স্বাভাবিক হয়ে কাবেরী বলল, কাগজওয়ালা। সারা ঘর দেখে তো দেবাদৃতার চক্ষুস্থির। সারা ঘর জুঁইফুলে সাজানা। অদ্ভুত লাগছিল ওর। খাওয়ার পরে বিছানায় মিলিয়ে যাওয়ার আগে কাবেরীকে শুধু বলল, প্রতিটা কাজে প্রমাণ করিস, তুই একটা পাগল! সত্যিই পাগল। কতটা পাগল, আজ দেবীকে বুঝিয়ে দেবে ও। ওকে ছুঁড়ে ফেলল বিছানার মধ্যে। এতোই তাড়া, যে দরজা বন্ধ করতেই ভুলে গেল। দেবীকে উপুড় করে পিছন থেকে নরম আদরে হাতটা মুচড়ে ধরল। বুকের থেকে ওড়না সরে গেছে দেবীর। পিঠে বাঁধা লেসটা খুলে দিল কাবেরী। মুখ ঘষতে শুরু করল দুধে আলতা পিঠে। ততক্ষনে চিৎ হয়ে গেছে দেবাদৃতা। আদরে গলা থেকে বুকের সবটা ভরিয়ে দিচ্ছে কাবেরী। হঠাৎ, দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন কাবেরীর মা। আকস্মিক বুকে ছুরি বেঁধার মতো চমকে উঠলেন তিনি৷ তোরা এটা কী করছিস? মার গলা শুনে প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে ছিটকে উঠল কাবেরী। মুখ ঢেকে দূরে সরে গেল দেবাদৃতা। মা!
ছি! আমার ভাবতেই সারা শরীর রি রি করছে। মেয়ে হযে একটা মেয়ের সঙ্গে……। তুই কী আমার পেটে জন্মেছিস রে? তুই একটা পাপ। এই বংশের পাপ৷ হে ভগবান! পেটে থাকতে তুই মরে গেলি না কেন? নিজের মুখ ঢেকে বলতে থাকেন কাবেরীর মা। যেন এখনই পাড়া প্রতিবেশিরা উঁকি মারা শুরু করে দিয়েছে। মা তুমি প্লিজ বাবাকে কিছু বোলো না। বাবা আমাকে মেরেই ফেলবে। বালিশে মুখ ঢেকে কেঁদে চলেছে কাবেরী। দেবাদৃতা বেশ কিছুক্ষণ হল চলে গেছে। কাবেরীর বাবা এখনও ফেরেননি বন্ধুর বাড়ি থেকে। জুঁইযের মালাগুলো এখনও তীব্র গন্ধ ছড়াচ্ছে সারা ঘরে। আরও পড়ুন-বিমান দুর্ঘটনাতেই নেতাজির মৃ্ত্যু হয়েছে, বিশ্বাস করতেন কৃষ্ণা বসু
তোর মতো মেযের বেঁচে থেকে কী লাভ? কেন বাঁচবি তুই বল? আমাদের মারার জন্য? তোর জন্য আত্মহত্যা করব আমরা দু’জন?” চুলের মুঠি ধরে মেয়েক বিছানা থেকে তোলেন। ওঠ, ওঠ নচ্ছার মেয়ে কোথাকার। ফিল্মি কায়দা হচ্ছে না? ফায়ার ফায়ার খেলা হচ্ছে? টান মেরে ছিঁড়তে থাকেন ঘরের জুঁইযের মালাগুলো। যত রাজ্যের নাটক। সব শেষ করে দেব আজকে। বুকের মধ্যে হাতদুটোকে চেপে কাঁদতে থাকে কাবেরী। ঘরের দরজাটা আওয়াজ করে বন্ধ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন কাবেরীর মা।
হোয়াটস্যাপে একটা মেসেজ এসেছে, দেবী পাঠিয়েছে, বাই! চোখের সামনে পৃথিবীটা অন্ধকার লাগতে থাকে কাবেরীর। কেন? দেবী কেন এমন মেসেজ করল? ওকে ভুল বুঝল দেবী? অস্বাভাবিক এই সম্পর্ক চোখের সামনে দেখলে, যেকোনও বাড়ির লোক তো এমনই আচরণ করত। দেবী কি সেটা বুঝবে না? দেবী ওকে ছেড়ে চলে যাবে না তো? সবকিছু ছেড়ে এই একটা ভাবনাই বর্ষার মেঘের মতো কাবেরীর সমস্ত মনটাকে ছেঁকে ধরল।
এতটা ভেঙে পড়লে চলবে না। সত্যিটা যখন মায়ের সামনে এসেছে, তখন পুরোপুরি আসাই ভাল। ঘরের বাইরে এল কাবেরী। তখনও মাথায় হাত দিযে ডায়নিংযের চেয়ারে বসে আছেন কাবেরীর মা। – তোমাকে একটা কথা পরিষ্কার জানাই মা৷ তোমার মেয়ে অন্য মেয়েদের মতো স্বাভাবিক নয়। আমি একজন লেসবিয়ান, সমকামী। আর কোনওভাবেই তোমরা আমার সম্পর্কে বাধা দিতে পারো না। কারণ, ৩৭৭ আইনটা আর নেই। উঠে গেছে। এখন চাইলেই দু’জন সমকামী মানুষ সম্পর্ক গড়তে পারে। এমনকি বিয়েও করতে পারে। নিজের শরীরের মনের সমস্ত শক্তি এক করে মুখস্থ আবৃত্তির মতো বলে গেল কাবেরী। কথাগুলো বলে ফেলে যেন শরীর থেকে কোনও একটা ভার নেমে গেল। আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। টলে পড়ে গেল মেঝের উপরে। মেয়ের মাথায় সমস্যা হয়েছে। নাহলে একটা সুস্থ সবল মেযে কখনও এমন আচরণ করতে পারে? ডাক্তার সতীনাথ বসুকে দেখাতে হবে। এর আগেও নিজের ডিপ্রেশনের জন্য তাঁর ওষুধ খেয়েছেন শর্মিলা। অব্যর্থ। এক পাতা ওষুধেই ডিপ্রেশন উধাও। ওঁকে একবার দেখালেই মেয়ের এসব অল্প বয়সের রোগ কেটে যাবে। আর ঐ ডাইনি দেবাদৃতার থেকে মেযেকে আলাদা করতে হবে। কাবেরী জানেই না, কখন অলোকেশ, মানে ওর বাবা ফিরেছেন বন্ধুর বাড়ি থেকে। আরও পড়ুন-মধ্যরাতের সেলফি নয়, স্বপ্ন দেখি ভোরবেলার একুশে ফেব্রুয়ারি; ফিরছে বাংলাদেশ
পুরো ঘটনা শুনে আগুনের মতো জ্বলে উঠেছিলেন অলোকেশ। এই বছরই তাঁর সোসাইটির সেক্রেটারি হওয়ার কথা। আর এই মেয়ের জন্য কিনা। ওদের সঙ্গে তো সম্পর্ক ছেদ করে দেবে সোসাইটির সবাই। ভেবেছিলেন পিটিয়ে মেরেই ফেলবেন মেয়েকে। কিন্তু, সেখানে বাদ সাধেন শর্মিলা। উঠতি বয়সের মেয়ে, কী করতে কী করে ফেলবে। এমন তো এখন হামেশাই শোনা যায় চারদিকে। তার থেকে সতীনাথ বসুকে দিয়ে কাউন্সেলিং করিয়ে ওষুধ খাওয়ালেই সব পাগলামো উধাও হয়ে যাবে।
তুমি কালকেই এম্প্যাথিতে অ্যাপয়েন্টমেন্ট কর। যত টাকা লাগে লাগুক। আমাদের মেযেকে সুস্থ করতেই হবে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট হল। ডাক্তার বসু জানালেন, এমন কেস উনি অনেক হ্যান্ডল করেছেন। পরের দিনই বিকেল পাঁচটায় ওঁরা তিনজনে যাবেন অজয়নগরের এম্প্যাথিতে। ডাক্তার সতীনাথ বসুর চেম্বারে।
ও জুঁই, বল না আমায় তুই, ওকে না পেলে তোকেই কেন এত ভালাবেসে ছুঁই? আমার মনের জমা কান্নারা যেদিন আকাশ ছোঁবে, তোর কাছে কি নিরুদ্দেশোর কোনও ডাক পৌঁছবে? যেন আমাদের গাঁটছড়া বাঁধা সুতোয় বাঁধার মত৷ পায়ে পিষে গিয়ে স্নিগ্ধ সাদা আজকেও অক্ষত। আমি কাঁদলে, আমার সঙ্গে কাঁদিস না কেন তুই? ও জুঁই? ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরছে কাবেরীর। নার্ভের কড়া ওষুধ দেওয়া হয়েছে। কোমরে দুটো ইঞ্জেকশন দিয়েছে। উঠতেই পারছে না বিছানা থেকে। হাতদুটো ঠকঠক করে কাঁপছে বুড়ো মানুষের মতো।
বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে আবার বিছানায় টলে পড়ে গেল কাবেরী। ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠল। কিন্তু না, হেরে গেলে চলবে না। দেবীকে ফোন করতে হবে। পরপর ১৭ বার চেষ্টা করল। ছোট্ট একটু রিং হযেই কেটে যাচ্ছে। তার মানে? ওকে ব্লক করে দিয়েছে দেবী? চিৎকার করে কেঁদে উঠল কাবেরী।
অনাদরের এক চরম স্বাধীনতা আছে, কাবেরী এখন সেই স্বাধীনতা উপভোগ করছে। ওর সর্দি, গলাব্যথা বা জ্বর হয়নি, যে বাবা মা বারবার এসে আহা উহু করে যাবে। বরং তাঁরা এখন অনেক বেশি চিন্তিত তাঁদের সামাজিক সুরক্ষা নিয়ে। যেন সামাজিক সুরক্ষার যে বিমাটা তাঁরা করিয়েছিলেন, আজ থেকে বছর ১৭ আগে, ম্যাচিওরিটির সময় সেটা হঠাৎ ল্যাপস করেছে। তাঁরা যেন এখন কাবেরীকে সহ্যই করতে পারছেন না। শারীরিক ক্লান্তির জেরে ওর সারাদিন শুয়ে থাকা, দিনের মধ্যে বেশিরভাগ সময় অচেতন থাকা, উঠতে গেলে টলে পড়ে যাওয়া, এই সমস্তটাই তাঁদের কাছে অসহ্য এক ন্যাকামির মতো লাগে। বিশেষ করে অলোকেশের কাছে।
ইতিমধ্যেই সোসাইটির অনেকেই তাঁকে প্রশ্ন করেছেন, মেযের কী হয়েছে? বাইরে বেরোচ্ছে না কেন? তাঁরাও কেন কমিউনিটিতে আসছেন না, ইত্যাদি ইত্যাদি। নানান কাল্পনিক গল্প খাড়া করে অলোকেশ তাঁদের মুখ বন্ধ করেছেন ঠিকই। কিন্তু কৌতূহলী চোখগুলো যেন অলোকেশের ফোর বি বিল্ডিংযের চারদিকেই ঘুরে বেরাচ্ছে। হাউসিং এর দু’জন তাঁর সাথে একই অফিসে চাকরি করেন৷ অফিসেও তাঁরা অলোকেশের মধ্যে অস্বাভাবিকতা খুঁজে পাচ্ছেন। আর বাড়িতে এই মেয়ে। বৃদ্ধের মতো হাত পা কাঁপছে। সারাদিন শুযে রযেছে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতে। আরও পড়ুন-ক্যানভাসে বৃষ্টির রাত, প্রহর জাগে ১৪ ফেব্রুয়ারি
শর্মিলা অবশ্য এতটা ভাবেন না৷ তাঁর বেশি চিন্তা মেয়েকে নিয়েই। মেয়েটা আর কোনওদিন ভাল হবে তো? ডাক্তার বসুর ওষুধ খেয়ে তো মেয়ে দিনদিন আরও কাহিল হয়ে পড়ছে। এখন মনে হয়, যেন আর কখনও উঠে দাঁড়াতেও পারবে না। দেবাদৃতা যে ওর জীবন থেকে দূর হয়েছে, তাতে শর্মিলা খুশি। কিন্তু মেয়েকে যে নিজের করে পাওয়া যাচ্ছে না। গত দশদিনে একবারও “মা” বলে জড়িয়েও ধরেনি মামন। যেমন করত সকাল সন্ধ্যা রাতে সবসময়। নিজের মেয়েকে যেন চিনতেই পারছেন না তাঁরা।
আর কাবেরী? তার কাছে এখন অখণ্ড অবসর। দেবী আর তার সঙ্গে কথা বলছে না। তবুও ঘুরিয়ে ফিরিযে চেষ্টা করে চলেছে দেবীকে ধরার। বারবার একই কথা। এই মুহূর্তে ব্যস্ত। অথচ এই দেবীই প্রথম এগিয়ে এসেছিল ওর দিকে। সবকিছু আজকে কেমন ধোঁয়াশার মত লাগছে ওর কাছে। হঠাৎ, মেসেঞ্জারে একটা মেসেজ। সৌরনীল। তোমার থেকে অবহেলা পেয়েছি, অথচ কি অপরাধ করেছি, বুঝতে পারিনি। তোমার বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে রয়েছি। যদি একবার দেখা করার অনুমতি দাও, তাহলে আসতে পারি। কী করা উচিত বুঝতে পারছিল না কাবেরী। এসো, লিখে ফেলল, প্রায় কিছু না ভেবেই।
উপরে উঠে এল সৌরনীল। দরজা খুললেন শর্মিলা। তোমাকে তো ঠিক, আমি সৌরনীল, কাবেরীর সঙ্গে হিস্ট্রি ক্লাসে পড়তাম, সনৎ স্যারের কাছে। ও কি ঘরে আছে? হ্যাঁ হ্যাঁ আছে। এসো এসো ভিতরে এসো৷ যাক, কালী মা তাহলে সত্যিই আছেন। কালই মামনের বাবাকে দিযে লেক কালীবাড়িতে পুজো দিতে পাঠাতে হবে। এই ছেলে যদি মেযের মন ঘোরাতে পারে। দারুণ দেখতে ছেলেটাকে। ফরসা টুকটুকে সাহেবের মতো। এক মাথা কোঁকড়ানো ঝাঁকড়া চুল। ছিপছিপে রোগা মুখটা যেন দুষ্টুমিতে টলটল করছে সবসময়। নিশ্চই কোনও বড় ঘরের ছেলে। দেখা মাত্র শর্মিলার ভীষণ ভাললাগে ছেলেটাকে।
তুমি এখন কী পড়ছ বাবা? জিগ্যেস করেন শর্মিলা। আমিও এবার বায়ো সায়েন্স নিয়ে আইএসসি দেব। আগের দিনের কাবেরীর ওই ব্যবহারের পরে আজ এই আতিথেয়তা বড় অবাক করে সৌরনীলকে। বাবা, তুমি ওই ঘরে যাও কাবেরী আছে। মামন, এই মামন ওঠ। দ্যাখ তোর এক পুরোনো বন্ধু এসেছে। দরজায় টোকা দিয়ে আবার সৌরনীলের দিকে ফিরে বলেন,ওর শরীরটা ভাল নেই কয়েকদিন। কী হয়েছে? যেন একটু চমকে ওঠে সৌরনীল। ওই একটু জ্বর জ্বর মতো। যাও না তুমিই গিয়ে জিজ্ঞেস করো। শর্মিলা যেন ঢোক গিললেন কথাটা বলার সময়।
একটা সাদা থ্রি কোয়ার্টারের সঙ্গে কালো টি শার্ট পরে আছে কাবেরী। সৌরনীল আসার আগে চুলগুলো যথাসম্ভব গুছিয়ে নিয়েছে। নিজেকেও গোছানোর অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু পারেনি। ঘরে ঢুকে ওকে দেখে চমকে যায় সৌরনীল। এ কাকে দেখছে চোখের সামনে? চোখের তলায় কালি। মুখটা বিবর্ণ, ফ্যাকাশে। ঠকঠক করে কাঁপছে হাতদুটো। উঠে দাঁড়ানোর বিন্দুমাত্র শক্তি নেই। কিছুটা দাঁড়ানোর চেষ্টা করেই আবার বসে পড়ে বিছানায়। তোমার কী হয়েছে কাবেরী? আরও পড়ুন-Rituparno Ghosh: ঋতুপর্ণ ঘোষ ও এক ঋতু-ময় চিত্রকল্প
গত ১১ দিনে একবারও কেউ এভাবে কথা বলেনি তার সঙ্গে৷ কথাই ক’জনে কটা বলেছে গুনে বলা যায়। গলা থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইছিল কান্না। তবুও জোর করে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল তুমি আবার কেন এসেছ এখানে? তোমাকে তো আগের দিন বললাম, যা ভাবছো, সেটা সম্ভব নয়। একজন বন্ধু শুধু আর একজন বন্ধুর থেকে বুঝি ওইটুকুই চাইতে পারে? আমি বলতে এসেছি, তুমি ভুল করছো কাবেরী। সৌরনীল যেভাবে কথাগুলো বলল পৃথিবীর যেকোনও কেউ সেই কণ্ঠস্বরে শীতল হয়ে যেত। কিন্তু, কাবেরী বলল, ঠিক ভুলের হিসেব করার তুমি কে? তোমার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। আমার পার্টনারের নাম শুনবে? দেবাদৃতা রায়।
দেবাদৃতা রায়? চোখ দুটো কুঁচকে গেল সৌরনীলের। তোমাদের স্কুলের? নিউআলিপুর বি ব্লকে থাকে? তুমি কী করে জানলে? কাবেরীর যেন আকাশ থেকে পড়ার পালা। কারণ গত দু’বছর ধরে ও আমার বন্ধু ইন্দ্রনীলের গার্লফ্রেন্ড। মানে? মানে আর কিছুই নয়। তুমি নিজে একজন হোমো সেক্সচুয়াল। কিন্তু ও হোমো নয় বাই সেক্সচুয়াল। তোমার সঙ্গে ও আনন্দ করেছে ঠিকই, কিন্তু আসল জায়গায় একদম ঠিক। কাবেরীর চোখে ঘোর অবিশ্বাস। বিশ্বাস না হলে চলো আজ তো বুধবার। এখনই ওদের দু’জনকে একসাথে ইলিয়ট পার্কে দেখিয়ে দিতে পারি তোমাকে।
যাব তো বটেই। আমি অন্য কারোর কথায় দেবীকে অবিশ্বাস করতে পারব না। কাবেরী যেন নিজের দুর্বলতার কথা সম্পূর্ণ ভুলে গেছে। হঠাৎ, সৌরনীলের চোখ পড়ে যায় ড্রেসিংটেবিলের ওপর। তুমি ফোলিঅ্যাক্ট কেন খাচ্ছো? এটা তো নার্ভের ওষুধ। মা বাবার ধারণা, মেয়ের মাথা খারাপ হয়েছে, তাই সাইকোলজিক্যাল চিকিৎসা চলছে। কাবেরীর চোখে সারা পৃথিবীর অবজ্ঞা।
ছি ছি ছি! তাোমার মাকে তো এমন মনে হয়নি কখনও। ছুটে বাইরে বেরিয়ে আসে সৌরনীল। এসো বাবা তোমার জন্যই, টেবিলে মিষ্টির প্লেট। মিষ্টি পরে খাব। আগে বলুন, ওকে সাইক্রিয়াটিস্ট কেন দেখানো হয়েছে? ওর দুর্মতির কথা তোমাকে কী বলব বাবা? কিচ্ছু বলতে হবে না। কারণ আমি পুরোটা জানি। কিন্তু সেটা জেনেটিক ক্রোমোজোমের জন্য। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শর্মিলা শুনছেন সৌরনীলের কথা। আগে যে বিষয়টা ছিল শুধুমাত্র এম এবং এফ মানে মেইল এবং ফিমেইল, এখন সেটাই জি,এল,বি,আই অনেক ভ্যারিয়েশন। বিষয়টা এখন অনেক কমপ্লিকেটেড। জি মানে গে, যখন একজন ছেলের ছেলেকে ভাল লাগে। এল মানে লেসবিয়ান, যখন একটা মেযের আর একটা মেয়েকে ভাল লাগে। এখনও সৌরনীলের দিকে কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন শর্মিলা।
এই ট্রিটমেন্ট বন্ধ করুন কাকিমা। নয়তো কাবেরীকে বাঁচানো যাবে না। বেশ, ওর বাবা অফিস থেকে ফিরুক। ওকে বলে দেখব। তুমি যা বলছো তাই যদি হয়, তালে তো…, কাকুকে বোঝান কাকিমা। এটা সাইকোলজিক্যাল সমস্যা নয়। কাবেরীর মেয়ে পার্টনারই লাগবে এবং সেটা আপনাদের মেনে নিতেও হবে। খুব আস্তে আস্তে বলল, যেভাবে আমি মেনে নিয়েছি। কিছু বললে বাবা? জিজ্ঞাসা করলেন শর্মিলা। নাহ। আপনার সামনে এই কথাগুলো বলতে আমার খারাপ লাগছে। কিন্তু এটাই বাস্তব।
কাবেরী রেডি হয়ে চলে এসেছে। কই? কোথায় নিয়ে যাবে চলো। তোমরা আবার এই অবস্থায় কোথায় বেরোবে? চমকে উঠলেন শর্মিলা। এই সামনেই কাকিমা। আমার সঙ্গে মোটরবাইক আছে, চিন্তা নেই। আবার পৌঁছে দিযে যাব। যাক, ভালই হযেছে। ঘরের মধ্যে আটকা থাকতে থাকতে মেযেটা আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছে। তার থেকে একটু বাইরে বেরিয়ে এলে মনটাও ভাল হবে। কাবেরী সৌরনীলের সঙ্গে বাইরে যেতে শর্মিলা যেন খুশিই হলেন।
ওরা বেরিয়ে যেতেই বাড়ি ফিরলেন অলোকেশ। শর্মিলা নিজের মতো করে তাঁকে বুঝিয়ে বললেন সৌরনীলের বলা কথাগুলো। অলোকেশ যেন আগুনে ঘি পড়ার মতো জ্বলে উঠলেন। ওকে কাপ্তানি করতে বারণ করো। এটা আমাদের ফ্যামিলি ম্যাটার। ডাক্তার বসু বলছেন, বাড়িতে রেখে চিকিৎসা করা সম্ভব নয়। মেযেকে হোমে দিতে হবে। এখনই গাড়ি আসবে নিয়ে যেতে। মানে সোজা কথায় অ্যাসাইলাম। হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন শর্মিলা। আহ! নাকি কান্না বন্ধ করো। আমি বাবা, আমি যা করব, মেযের ভালর জন্যই করব।
ইলিয়ট পার্কে ইন্দ্রনীলের বুকে মাথা রেখে বসে আছে দেবাদৃতা। ওদের একদম সামনে গিয়ে দাঁড়াল কাবেরী। যেন কিছুটা চমকে উঠল দেবাদৃতা৷ কীরে তুই এখানে? আমার ফোন ধরছিস না কেন? আগুন জ্বলছে কাবেরীর চোখে। আমার ইচ্ছে। কাবেরীর চোখের দিকে তাকাতে পারছে না দেবাদৃতা। জ্বলজ্বল করছিল কাবেরীর চোখদুটো। হঠাৎ জলে ভিজে গেল। তোকে ছাড়া আমি বাঁচবা না দেবী। আমাকে ছেড়ে যাস না প্লিজ! শাট আপ, চিৎকার করে উঠল দেবাদৃতা।
এতক্ষণ চুপ করে বসে থেকে এবার ইন্দ্রনীল বলে উঠল, মেযেটা কে দেবী? একটা পাগল! ক্লাস নাইন থেকে আমার পিছনে পড়ে রযেছে। একটু সুন্দরী মেযে দেখলেই ছুকছুক করে। দেবীর কথাগুলো বিশ্বাস হচ্ছিল না কাবেরীর৷ আমি পাগল? পাগল ছাড়া কী? ওর চিকিৎসার প্রয়োজন। এক্ষুণি অ্যাসাইলামে দেওয়া প্রয়োজন।
পৃথিবীটাকে লাথি মারতে ইচ্ছে করছিল কাবেরীর। মনে হচ্ছিল পুরো পৃথিবীটা যেন এই মুহূর্তে ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। “আজকে আকাশ ভেঙে পড়ে যাক, নামুক অস্তরাগ, কী করে মুছবো হৃদযের থেকে কলঙ্কের এই দাগ। হাঁটতে হাঁটতে দিগন্ত পার, এই বালুতটে ফিরব না আর, ভুলে গেছি আমি কত টুকু কার, হৃদযের তটে দাগ। আজ ধরিত্রী ভাগ হয়ে যাক, নামুক অস্তরাগ৷” সেলিমপুরের মোড়ে এসে সৌরনীল বলল, সাবধানে যেও। কী করে বুঝবে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে অ্যাসাইলামের জাল দেওয়া গাড়ি। চারজন মিলে গাড়িতে টেনে তোলার সময় একটাই নাম ধরে চিৎকার করছিল কাবেরী, সৌরনীল! সৌরনীল! কেউ শুনল না। সৌরনীলও নয়।
চারটে নোংরা দেওয়ালে নানা রকমের দাগ, বিশ্রী কদর্য কিছু লেখা, স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার, এইটাই এখন কাবেরীর জীবন। এখানে আসার পরে তিনদিন প্রায় কোনও জ্ঞানই ছিল না তার৷ একটা কড়া ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছিল। এখনও বেশিক্ষণ দাঁড়াতে গেলে মাথা টলমল করে। সব থেকে অসহ্য বিষয় হল বাথরুমের ছিটকিনি নেই। আসা থেকে একটা দানা খাবারও স্পর্শ করেনি। যদিও রাজভোগ কেউ সাজিয়ে রাখেনি চোখের সামনে। মোটা চালের ভাত, ডালের জল আর খোসা সুদ্ধ তরকারি।
কোনওদিনও এমন খাবার চোখেই দেখেনি কাবেরী। খাওয়ার কথা ভাবতেই পারে না। চোখের সামনে সেই খাবারই হাপুস হুপুস করে গিলছে বাদবাকি সবাই। ওদের দিকে তাকালেও কেমন চোখ ভিজে যায় কাবেরীর। ওদের আর জীবন বলে কিছু বাকি নেই। ওর ঠিক সামনেই এক থালা ভাত নিয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছে যে, মাঝে মাঝে ওর দিকে তাকিয়ে আওয়াজ করে হাসছে। উশকো খুসকো চুল পিঠ ছাড়িযে নেমে গেছে মাটি পর্যন্ত। গায়ের রঙ শ্যামবর্ণ। মেয়েটার নাম মুন্নি।
নিজের সাথে মেয়েটাকে মেলাতে চেষ্টা করে কাবেরী। আয়না নেই এখানে। হয়তো ওকে দেখতেও এখন মুন্নির মতোই লাগছে। একমাত্র হাওয়া ঢোকে উত্তরের জানলাটা থেকে। যদিও ওখানে বসতে দেয় না সবসময়। দিনের মধ্যে আধঘণ্টা। তারপর টেনে ভিতরে নিয়ে যায় দু’জন বিশাল চেহারার মহিলা। ওর সব ছুকছুকানি নাকি তিনদিনে বের হয়ে যাবে। ওরা টেনে নিয়ে গেল বাথরুমে। সারা বাথরুমে ছড়িয়ে রয়েছে চাপ চাপ রক্ত। ভিতর থেকে পাকিযে বমি আসতে শুরু করে কাবেরীর। আর কিছুতেই এখানে নয়। যেভাবে হোক পালাতেই হবে এখান থেকে।
বাথরুমের পিছনে একটা দরজা আছে। দুপুরবেলা হোমের সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়েছে, আস্তে আস্তে ওই দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায় কাবেরী। একছুটে পেরিয়ে গেল নোংরা পুকুরের পারটা। আর এখানেই বিশাল ভুল করে ফেলল। ভীষণ হাঁফিয়ে গেছিল। তাই বসে পড়েছিল পুকুর ঘাটের আগাছাগুলোর উপরে। আর তখনই হোমের একজন মহিলা গার্ড ওকে দেখে ফেলল। তিনজন মিলে টেনে ধরে মারতে মারতে ওকে নিয়ে এল বিছানায়। চারজন মিলে চেপে ধরল হাত পা। ওর পাগলামো নাকি মাত্রা ছাড়িযে গিয়েছে। একটা তার খুঁজে দেওয়া হল মাথাটা পেঁচিযে। মুখের মধ্যে খুঁজে দেওয়া হল স্টিলের একটা পাত।উফফ! কী ভয়ঙ্কর শক। একবার ইলেকট্রিক শক খেয়েছিল থ্রিপিন প্লাগের থেকে। কিন্তু এ যেন সহ্যের বাইরে। কাটা মুরগির মতো ছটফট করছে কাবেরী। হঠাৎ সবকিছু স্থির। আর কিচ্ছু জানে না। শুধু বুঝতে পারছে, মুখ থেকে লালা বেরিয়ে আসছে।
সারাদিন একা কাবেরীর ঘরটায় বসে থাকেন শর্মিলা। সারা ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মেয়ের জামা, পিঙ্ক কালারের হেলমেট, ড্রেসিং টেবিলে সাজার জিনিস আর মাকে জড়িয়ে ধরা একটা ছবি। সেটাকে বুকে। চেপে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকেন শর্মিলা। মেয়ে আর ফিরবে তো? দু’মাস হয়ে গেল, মা বলে ডাকেনি একবারও। স্কুটিটায় ধুলa জমে সাদা হয়ে গেছে। দুটো আয়নায় মাঝে মাকড়সার জাল। চাকাদুটো হাওয়া নেই। সিটের Gপর এখনও লেখা কে+ডি….. কাবেরী+দেবী। সবকিছুই যেন জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। হঠাৎ কলিং বেলটা বেজে উঠল। চমকে উঠে দরজা খুলতে এলেন শর্মিলা। অলোকেশ, মুখটা ভীষণ থমথমে।
আমাদের মামনের কী খবর? প্রায় চিৎকার করে উঠলেন শর্মিলা। শিশুর মতো ডুকরে উঠলেন অলোকেশ। ওরা ছেড়ে দিচ্ছে। ডাক্তার বসু হাল ছেড়ে দিলেন। আমাদের মেয়ে আর ভাল হবে না। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে অলোকেশ চিৎকার করে উঠলেন, আমি ওই ডাক্তারের নামে কেস করব। ওকে ঘানি ঘুরিয়ে ছাড়ব। আমাকে ভরসা দিয়ে…৷ তাতে লাভ? ভীষণ ঠাণ্ডা শর্মিলার গলা। তুমি ওর সঙ্গে পারবে? তুমিই সর্বস্বান্ত হবে। আমার মেযেটার জীবন আমি শেষ করে দিলাম, শর্মী…। একবারও যদি ওকে বুঝতে চাইতাম….৷” শর্মিলা অবাক হয়ে দেখলেন, চিৎকার করে কাঁদছেন অলোকেশ। কুড়ি বছরে এমন কখনও দেখেননি তিনি।
পদ্মপুকুরের পাডরটা আজকে ভীষণ ফাঁকা। নজরুল মঞ্চেও কোনও অনুষ্ঠান নেই এখন। নিস্তব্ধ দুপুর পেরিয়ে বিকেলের দিকে পা বাড়াচ্ছে সময়। হাওয়ার শব্দের সঙ্গে মিশে সাদার্ন অ্যাভিনিউর গাড়ির আওয়াজ গুলো অস্পষ্ট লাগছে৷ স্যাঁতসেঁতে ঠাণ্ডা একটা দিনে কাকগুলো শুধু জটলা করছে কৃষ্ণচূড়ার ডালে। প্রতিদিন এখানে বসে থাকে সৌরনীল। অনেকদিন গিয়ে ঘুরে এসেছে কাবেরীর বাড়ির থেকে। ও কোথায় আছে, এটাও জানাতে রাজী নয় কাবেরীর বাড়ির লোক। যদি ফিরে আসে কাবেরী। যদি ওকে খুঁজতে খুঁজতে স্কুটি নিয়ে চলে আসে এই পদ্মপুকুরে! ওকে যে অপেক্ষা করতেই হবে। ও যে কথা দিয়েছে সবথেকে কাছের বন্ধুকে।
হঠাৎ, খেয়াল হল কুকুরগুলো এত চিৎকার করছে কেন? একটা পাগলিকে। তাড়া করেছে প্রায় সাত আটটা কুকুর। পাগলিটা ছুটছে প্রাণের দাযে। ওকে বাঁচানার জন্যই তাড়াতাড়ি ছুটে গেল সৌরনীল। কাছে গিয়ে পাগলিটার মুখ দেখে আঁতকে উঠল সৌরনীল। কাবেরী! কাবেরীর কাঁধ ধরে ধাক্কা দিতে দিতে সৌরনীল বলছে কাবেরী…! কাবেরী দেখো আমি সৌরনীল, কাবেরী…!” ওর আওয়াজকে ছাপিয়ে হা হা করে হেসে উঠল কাবেরী। কী বীভৎস সেই হাসি! আরও পড়ুন-করোনাভাইরাস মানুষের কৃতকর্মের ফল, নাকি সভ্যতার অভিশাপ?
“কাঁদিও কাঁদিও আমারই মতোন করে কাঁদিও, কৃষ্ণ কৃষ্ণ নাম বদনে বলিও। সুন্দর বিরহ, মনে হবে যেন, কেন কাঁদে বধূবালা, বনমালী তুমি…”
1 thought on “ঋতুর বিপরীতে”
Trinanjoy Bhattacharya
(17th সেপ্টেম্বর 2021 - 1:18 অপরাহ্ন)শারদীয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাই সকলকে। বং ম্যাগকে জানাই কৃতজ্ঞতা। বন্ধু শাম্মি হুদাকে জানাই ভালোবাসা।