অর্ণব কর
ইশকুলে ভুগোল পরীক্ষায় একটা প্রশ্নের উত্তর প্রায়শই দিতে হত। “পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় অঞ্চল কোনটি?” উত্তরটা অবধারিত ভাবেই দুর্গাপুর (Durgapur)। আমরা বর্তমানে ড: বিধান চন্দ্ররায়ের গড়ে তোলা স্বপ্নের শহর হিসেবেই দুর্গাপুরকে জানি। কিন্তু সব শুরুর আগেও একটা শুরু থাকে। হঠাৎ করে শহরের নাম দুর্গাপুর কেন? কী সেই ইতিহাস? আসুন, আমাদের খানিকটা অতীতের পথে হেঁটে যেতে হবে৷
দুর্গাপুর যে একটি প্রাচীন জায়গা, তা একটু পড়াশোনা করলেই বুঝতে পারবেন৷ বছর দশেক আগে পর্যন্ত দুর্গাপুর শহরের অনেকাংশই ছিল ঘন জঙ্গলে ঢাকা। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “আনন্দমঠ” উপন্যাস খ্যাত ভবানী পাঠক মূলত দুর্গাপুরেই(প্রচলিত ধারণা) তাঁর ডেরা বেঁধেছিলেন।বর্তমান অম্বুজা অঞ্চলের “দেবী চৌধুরানীর মন্দির” খ্যাত কালীমন্দির ও লাগোয়া ঝিল তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। এছাড়াও নিকটবর্তী গড় জঙ্গলে পুরাণ খ্যাত মেধা মুনির আশ্রম দুর্গাপুরের (Durgapur) প্রাচীনত্বে সিলমোহর দিয়েছে৷ আরও পড়ুন-Kashmir: কাশ্মীর! এক বিভাজিত আখ্যান (তৃতীয় পর্ব)

সময়টা ১৭৬৫ সাল, বর্ধমানের মহারাজার কাছ থেকে পুরো একটা মৌজার জমিদারি সত্ত্ব পেলেন গোপীনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর নামানুসারে এই জায়গার প্রথম নাম হয় গোপীনাথপুর মৌজা। রানিগঞ্জ ছিল তখন কয়লাখনির বড় আকর। সেখান থেকে কয়লা দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহের জন্যই পাতা হয়েছিল বর্ধমান- অন্ডাল রেলপথ।
এই উপলক্ষে ১৮৫৫ সালের ২ অক্টোবর দুর্গাপুর (Durgapur) হল্ট স্টেশন স্থাপিত হলে লাগোয়া অঞ্চলটির নতুন নামকরণ হয় তৎকালীন জমিদার দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে, দুর্গাপুর। ধীরে ধীরে এই স্টেশনকে ঘিরে গড়ে উঠতে থাকে জনবসতি৷ তারই ভবিষ্যৎ রূপ আজকের দুর্গাপুর৷ নামের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে স্থানীয় সাগরভাঙা অঞ্চলে এখনও সেই জমিদার বাড়ি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে৷


তবে বর্তমান দুর্গাপুর (Durgapur) শহরের জনক প্রকৃত অর্থেই ডাক্তার: বিধান চন্দ্র রায়। লবণহ্রদ ও কল্যাণীর পাশাপাশি দুর্গাপুরের আধুনিকীকরণ ও শিল্পনগরীতে পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান সর্বজনবিদিত। বর্তমান দুর্গাপুরের সূচনার মূলে পৌঁছাতে হলে প্রায় ৬০ বছর আগে ফিরতে হবে৷
১৯৫৪ সালে বিধানচন্দ্র রায় তৎকালীন কেন্দ্রীয় শিল্পমন্ত্রী নিত্যানন্দ কানুনগোর কাছ থেকে দুর্গাপুর (Durgapur) ইস্পাত কারখানার অনুমোদন আদায় করেন। শোনা যায়, হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়া কানুনগো মহাশয়ের চিকিৎসা করেছিলেন তিনি৷ সেকারণেই কৃতজ্ঞতা স্বরূপ এই অনুমোদন। কারখানার পত্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে দুর্গাপুরের বসতি ও অনুসারী শিল্পের চাহিদা। দরকার পড়ে আরও বিপুল শক্তির, যার ফলশ্রুতি আজেকর দুর্গাপুর বাঁধ৷ আরও পড়ুন-অন্য ‘বিন্যাস’-এর লেখক বুদ্ধদেব গুহ

১৯৬১ সালে দুর্গাপুর (Durgapur) প্রোজেক্ট লিমিটেড নামক সরকারি উদ্যোগে দামোদর নদের উপরে দুর্গাপুর বাঁধ তৈরি হয়৷ অবশেষে ১৯৬৮ সালে দুর্গাপুর পায় সাব ডিভিশনের মর্যাদা। সফল হয় বিধান রায়ের স্বপ্ন। আজকের দেশের প্রথম সারির ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ঝা চকচকে জাংশন মল, বড় বড় হাইরাইজ, ডিপিএলের গগনচুম্বী চিমনি, সেই দুর্গাপুরের ভিত্তি৷
তবে এহেন তাক লাগিয়ে দেওয়া বর্তমানের সঙ্গে রয়েছে দুর্গাপুরের (Durgapur) ঈর্ষণীয় অতীত৷ এখানকার প্রাচীন আকর্ষণের মধ্যে অন্যতম ইছাই ঘোষের দেউল, গড় জঙ্গলের গভীরে মা শ্যামারূপার মন্দির (ধর্ম মঙ্গল খ্যাত), মেধা মুনির আশ্রম, ভিড়িঙ্গি কালীমন্দির, রাঢ়েশ্বর শিব মন্দির, দেবী চৌধুরানীর মন্দির।
অন্যদিকে দামোদরের পারে গড়ে ওঠা হুজুকডাঙা, সিটি সেন্টারের বুকে অত্যাধুনি কজাংশন মল, অ্যামিউসমেন্ট পার্ক, ইকো পার্ক- সবই আধুনিক দুর্গাপুরের প্রতিচ্ছবি৷ আরও পড়ুন-COVID-19 Outbreak In Timbuktu: পৃথিবীর শেষপ্রান্ত টিম্বাকটুতে এবার করোনাভাইরাসের থাবা

সম্প্রতি অন্ডালে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের নাম তৈরি হয়েছে বিমানবন্দর৷ এটি দুর্গাপুরের (Durgapur) মুকুটে নতুন পালক। এইভাবে ইতিহাসের আশ্রয়ে আধুনিকতার আবাহনে শিল্পনগরী দুর্গাপুর ক্রমশ নিজেকে সাজিয়ে নিচ্ছে নতুন করে৷ শহরের বুক চিরে চলে গেছে ঝকঝকে রাজপথ৷ অগনিত ভারী ও মাঝারি শিল্পের খানা দুর্গাপুরকে শিল্পাঞ্চলের মর্যাদা দিয়েছে৷ সেদিনের প্রাচীন গোপীনাথপুর আজ দুর্গাপুর নামে দেশের অর্থনৈতিক মানচিত্রে স্বতন্ত্র জায়গা করে নিয়েছে৷