আজ পশ্চিম আফ্রিকার এক রহস্যময় শহরের কথা বলব, যার নাম টিম্বাকটু। এবার এই টিম্বাকটুতেও পৌঁছে গেল নভেল করোনাভাইরাস (COVID-19)। সংবাদ সংস্থা এপি জানিয়েছে, এই মুহূর্তে টিম্বাকটুতে কোভিড-১৯ এ আক্রান্তের সংখ্যা ৫০০-রও বেশি। সেখানে মারণ ভাইরাসে ৯ জনের মৃত্যুও হয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে অনেকেই ভেবেছিলেন সাধারণ জ্বর হয়েছে। প্রথম দিকে জ্বরের ওষুধ দিয়ে পরিস্থিতি নিয়্ন্ত্রণে আনার চেষ্টা হলেও শেষরক্ষা হয়নি।
COVID-19 Outbreak In Timbuktu
সাহারা মরভূমির প্রান্তভাগে অবস্থিত এই শহরটিতে কোনও বাণিজ্যিক বিমান চলাচলের ব্যবস্থা নেই। তারপরেও টিম্বাকটুতে পৌঁছে গেল করোনাভাইরাস (COVID-19)। টিম্বাকটুর সমার্থক নামটি হল পৃথিবীর শেষ প্রান্ত। স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মীরা জানালেন মহামারী করোনাভাইরাসও এই ইতিহাসের শহরকে একটু একটু করে গিলে ফেলছে। স্থানীয় হাসপাতালের বাইরে লাগোয়া এলাকায় তাঁবু খাটিয়ে আইসোলেশন করা হয়েছে। সেখানেই থাকছেন রোগী। এর মধ্যে আবার ৩২ জন কোভিড রোগীকে জায়গার অভাবে বাড়িতেই কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। আরও পড়ুন-করোনাভাইরাস মানুষের কৃতকর্মের ফল, নাকি সভ্যতার অভিশাপ?
দুঃখের বিষয় এই যে গোটা টিম্বাকটু শহরে একটিও ভেন্টিলেশন নেই। এদিকে করোনা আক্রান্ত (COVID-19) রোগীর হৃদযন্ত্রের সমস্যা শুরু হলে তাঁকে অক্সিজেন সাপোর্টে রাখতেই হবে। তাঁবুতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন টিম্বাকটুর বছর ৫০-এর শিক্ষক হারানডানে টোরে। তিনি জানালেন, “জীবন্ত মাছকে জল থেকে তুললে সে যেমন ডাঙায় উঠে খাবি খায়। অক্সিজেনের অভাবে আমার অবস্থাও তেমনই। মনে হচ্ছে বুকের উপরে এক পাহাড় প্রমাণ পাথর চেপে বসে আছে। যার জেরে গলা আটকে আছে, শ্বাস নিতে পারছি না। এই অসহনীয় কষ্ট আর সহ্য হচ্ছে না। রাত হলে শ্বাসের সমস্যাও বাড়ছে। মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছে এবার মৃত্যু এলে বেঁচে যাই। কিন্তু ঈশ্বর যেন অলৌকিকভাবে আমাকে ফের প্রাণের মায়ায় বাঁধছেন।”
টিম্বাকটুতে করোনাভাইরাস
জানা গিয়েছে, পশ্চিম আফ্রিকার মালি নামের এই দেশে প্রথম করোনাভাইরাস (COVID-19) আসে গত মার্চ মাসে। সেই সময় দুজনের শরীরে প্রথম করোনাভাইরাসের জীবাণু পাওয়া যায়। আক্রান্তদের একজন রাজধানী বামাকোয় থাকেন। সেখানে আন্তর্জাতিক বিমান অবতরণের করে নিত্য। অন্যজন মালির কেয়েস শহরের বাসিন্দা। এপ্রিল মাসেই রাজধানী বামাকো থেকে হাজার কিলোমিটার পথ পেরিয়ে টিম্বাকটুতে আঘান হানে কোভিড-১৯।
এমনিতে রাজধানী থেকে টিম্বাকটু আসতে গেলে সড়কপথে ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে। সপ্তাহে মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি বাসই রাজধানী থেকে টিম্বাকটুতে আসে। সেখানে হু হু করে চলে এল করোনাভাইরাস। সরকারি ভাবে এখনও কোভিডে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে অন্য সাধারণ কিছু রোগীর মৃত্যুর পর কোভিড-১৯ (COVID-19) টেস্ট হলে দেখা যায়, তাঁরা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন। হাসপাতালে অক্সিজেন সিলিন্ডার থাকলেও পর্যাপ্ত নার্স নেই। মূলত প্রশাসনিক কর্তারা আক্রান্ত হলে সেখানে নার্সরা বেশি থাকবে। এমন ঠিক থাকায় অনেক রোগীকে বাড়িতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আরও পড়ুন-Sonajharia Minz: ঝাড়খণ্ডের সোনাঝরিয়া মিনজ এখন স্বাধীন ভারতের প্রথম আদিবাসী মহিলা উপাচার্য
এখনও পর্যন্ত বিশ্বে করোনাভাইরাসের (COVID-19) চিকিৎসার জন্য সঠিক ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। তবে কেউ কোভিড-১৯ আক্রান্ত হলে তাঁর ফুসফুসে সংক্রমণ থেকে শুরু করে হৃদযন্ত্রের গোলমাল হতে পারে। টিম্বাকটুতে ভাইরাস আাক্রান্ত রোগীর জন্য উপযুক্ত চিকিৎসক নেই। এখানে বুকের এক্স-রে করানোর জন্য কোনও রেডিওলজিস্ট নেই। কিডনির সংক্রমণ সারাতে সক্ষম এমন চিকিৎসকও নেই। সবমিলিয়ে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর জন্য একেবারে কবরের পরিস্থিতি তৈরি হয়ে আছে টিম্বাকটুতে।
এদিকে মালির উত্তরাংশ ২০১২ সাল থেকে ইসলামী উগ্রপন্থীদের দখলে রয়েছে। সারা দিনে সেখানে জাতি সংঘের টহলদারি গাড়িই বার বার যাওয়াআসাই বুঝিয়ে দেয় টিম্বাকটু কতটা অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে। তার উপরে বিষ ফোঁড়ার মতো চেপে বসেছে এই করোনাভাইরাস (COVID-19)। এমাসে মালির স্বাস্থ্য মন্ত্রকের তরফে একটি মোবাইল গবেষণাগার এসে পৌঁছেছে টিম্বাকটুতে। সঙ্গে এসেছেন কোভিড টেস্ট করাতে দক্ষ একটি দল। এখন সেখানে সারা দিনে ১০০ জনের কোভিড টেস্ট করা হচ্ছে।
বলা বাহুল্য মালির জন্য এটা বিরাট বড় পদক্ষেপ। কেননা সেখানে করোনা সংক্রমণ শুরু দু’মাস কেটে য়াওয়ার পরেও প্রতি ১০ লক্ষ মানুষের মধ্যে মাত্র ১৭৩ জনের করোনাভাইরাস টেস্টের আয়োজন করা সম্ভব হচ্ছে। এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনা করা হলে আকাস পাতাল ফারাকটা চোখে পড়ে। মার্কিন মুলুকে মে মাস নাগাদ প্রতি ১০ লক্ষ মানুষের মধ্যে অন্তত ৩৮ হাজার ৩৯৪ জনের করোনাভাইরাসের (COVID-19) নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। আরও পড়ুন-Rituparno Ghosh: ঋতুপর্ণ ঘোষ ও এক ঋতু-ময় চিত্রকল্প
তবে একটা উদ্বেগের বিষয় থেকেই যাচ্ছে, টিম্বাকটুর মতো মালির উত্তরাংশের একেবারে প্রত্যন্ত এলাকায় যদি করোনাভাইরাস (COVID-19) থাবা বসায়, তাহলে কী হবে? সেখানে দখলদার কট্টরবাদী ইসলামিক জঙ্গি গোষ্ঠী এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করে রেখেছে যে সহজে চিকিৎসকদল, চিকিৎসা ব্যবস্থা, চিকিৎসা সামগ্রী, কোভিড-১৯ টেস্টের আয়োজন, কিছুই করা সম্ভব নয়। উত্তরের যাযাবর জনগোষ্ঠীর মধ্যে একবার এই ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে রোখা যে দায় হবে, তানিয়ে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে করোনাভাইরাসের (COVID-19) দাপটে টিম্বাকটু-র জনজীবনে খুব সামান্য পরিবর্তন এসেছে। তবে সংক্রমণ জনিত সতর্কতা কেউ অবলম্বন করছেন না বললেই চলে। দিব্যি মসজিদে জমাতে নামাজ হচ্ছে। মাস্ক তেমন কেউ পরছেন না। এমনকী, করোনাভাইরাস যে মৃত্যু ডেকে আনছে তানিয়েও সিংহভাগ বাসিন্দাদের মনে সন্দেহ রয়েছে। সাধারণ বাসিন্দারা আইসোলেশনে থাকা করোনা আক্রান্তর সঙ্গে চুপি চুপি দেখা করতে যাচ্ছেন রাতে। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন টিম্বাকটু হাসপাতালের প্রধান মাউসা হামা সানকারে।
সানকারে জানান, কোভিড রোগী টোরে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছেন। তবে দুশ্চিন্তার বিষয় হল বাসিন্দারা করোনাভাইরাসকে (COVID-19) সিরিয়াসলি নিচ্ছেন না। মাস্ক বাড়িতে রেখে মানুষ রাস্তায় খোলা মুখে ঘোরাঘুরি করছে। যদি বাসিন্দরা নিজেরা নিজেদের রক্ষায় সচেষ্ট না হন, তাহলে করোনাভাইরাস গোটা টিম্বাকটুতে হাহাকার ফেলে দেবে।
বলা যায়, পৃথিবীর একেবারে শেষপ্রান্তের এই টিম্বাকটুতে ঝড় শুরু হলে সাহারা মরুভূমি থেকে উড়ে আসে বালি। শহরটিতে কোনও ঐতিহাসিক প্রাসাদ নেই। নেই দালান কোঠাও। তবে অপূর্ব সুন্দর কারুকার্যে সমৃদ্ধ মাটির বাড়ি, মসজিদকে ঘিরে রয়েছে সমগ্র আফ্রিকার প্রাচীন ইতিহাস। শ্রুতিপাঠ্যকেই ১৫০০-১৬০০ শতকে হাতে লিখে রেখেছেন টিম্বাকটুর বর্তমান বাসিন্দাদের পূর্বসুরীরা। সেই পাণ্ডুলিপির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অমূল্য। সেখানে পৌঁছে গিয়েছে করোনাভাইরাস (COVID-19)। আরও পড়ুন-বিমান দুর্ঘটনাতেই নেতাজির মৃ্ত্যু হয়েছে, বিশ্বাস করতেন কৃষ্ণা বসু
শোনা যায়, পঞ্চম শতকে তুয়ারেগ নামের এক যাযাবর গোষ্ঠীই প্রথম টিম্বাকটুতে বসবাস করতে আসে। বুকটু নামের এক বৃদ্ধাই ছিলেন এই গোষ্ঠীর প্রধান। সেই থেকেই পশ্চিম আফ্রিকার মালির উত্তরাংশের এই বিস্ময়কর শহরের নাম হয়ে গেল টিম্বাকটু। পরবর্তীকালে জিন গ্যারেবার ও শানকোরে এলাকায় দুটি মসজিদ নির্মিত হলে ইসলামধর্মাবলম্বীতে ভরে যায় গোটা শহর। কবি সাহিত্যিকদের চোখেও টিম্বাকটু এক বিস্ময়। লর্ড টেনিসন তাঁর রচনায় এই শহরকে রহস্যময় বলেছেন।
টিম্বাকটুর অন্যতম আকর্ষণ শানকোরের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়। যেটির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে। ইউনেস্কোর বদান্যতায় সাম্প্রতিক অতীতে বিশ্বের অন্যতম দর্শনীয় পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত হয় টিম্বাকটু। ভ্রমণ পিপাসু মন দেশ বিদেশে ঘুরে একবার আফ্রিকা পরিদর্শনে আসতে চাইবে। তখন কিন্তু দর্শনীয় স্থানের তালিকায় টিম্বাকটু-কে রাখতে একদম ভুলবেন না। তবে বর্তমানে আলকায়দার মদতপুষ্ট জঙ্গিগোষ্ঠীর অত্যাচারে বেশ বিপর্যস্ত এই প্রাচীন জনপদ। এখন আর পর্যটন কেন্দ্র হিসবেও নিরাপদ নয় টিম্বাকটু। তারউপরে আবার করোনাভাইরাসের (COVID-19) থাবা।
১৯৮৮ সালে এই আফ্রিকান শহরটিকে বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা দেয় ইউনেস্কো। ফরাসি, বাম্বারা, আফ্রিকান কথ্যভাষা-সহ সোঙ্ঘাই ভাষাতেও বার্তালাপ করেন টিম্বাকটুর বাসিন্দারা। সাহারা মরভূমি একেবারে গায়ে লেগে আছে, তাই সারা বছরই প্রায় ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে গরম থাকে টিম্বাকটুতে। বর্ষার মরশুমে টিম্বাকটু লাগোয়া নাইজার নদী জলে টইটম্বুর হয়ে ওঠে। সেই সময় শহরও নদীর কাছে সরে আসে. তবে বর্ষা বিদায় নিলেই নদী থেকে আট কিলোমিটার দূরে সরে যায় টিম্বাকটু।
জলপথ, সড়কপথ ও বিমানে টিম্বাকটু পৌঁছাতে পারবেন। তবে ফেরাটা আপনার হাতে নয়। সেখান থেকে মালির রাজধানী শহরে ফিরতে সাপ্তাহিক বাসের উপরেই নির্ভর করতে হবে। মরভূমির শহরে গরম বড়ই অসহনীয় তাই নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারিতে ঘুরতে যাওয়াই শ্রেয়। তখনও গরম থাকে ঠিকই তবে তা সহ্য করে নেওয়া যায়। রাত বা দিন যেকোনও সময়ই টিম্বাকটুর ঐতিহাসিক সৌন্দর্যে মোহিত হতে পারেন। সেসব দর্শণে আলাদা কোনও দক্ষিণাও লাগে না। তবে থাকা খাওয়ার জন্য মূল্য তো দিতেই হবে।
বর্তমানে করোনা আক্রান্ত টিম্বাকটু বার বার তার ঐতিহাসিক গুরুত্বের কারণেই কলোনিতে পরিণত হয়েছে। ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, ইউরোপ, আমেরিকা, যে দেশ যখন সুযোগ পেয়েছে তখনই টিম্বাকটুকে নিজের করতলে বন্দি করেছে। মরোক্কো-ও একবার টিম্বাকটু জয় করে এখানকার বাসিন্দাদের হর্তা কর্তা বিধাতা হয়ে উঠেছিল। সেই তালিকায় ছিলেন সোঙ্ঘাই শাসক সোন্নি আলিও।
টিম্বাকটুর অমূল্য সম্পদ আর্বি ভাষার অজস্র পাণ্ডুলিপি। যার সংরক্ষণে উদ্যোগী হয় মালির সরকার। গবেষণার জন্য স্থানীয় আহমেদ বাবা সেন্টার এমনই ৩০ হাজার পুঁথিকে সংরক্ষণ করেছে। সেগুলি এখন ডিজিটাইজড। তবে জঙ্গি গোষ্ঠীর উৎপাতে ক্ষয়ক্ষতিও কম হয়নি। গ্রন্থাগার পুড়িয়ে, সমাধি নষ্ট করে মসজিদ গুঁড়িয়ে টিম্বাকটুর প্রাচীন ইতিহাসকে প্রতিদিন ধ্বংস করে চলেছে জঙ্গির দল। এই অপূরণীয় ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়। আন্তর্জাতিক আদালত এই ঘটনাকে অমার্জনীয় অপরাধ বলছে।
একাধারে জঙ্গিদের হামলা, সঙ্গে মহামারী করোনাভাইরাসের (COVID-19) ত্রাস তবুও বেঁচে থাকবে টিম্বাকটুর ইতিহাস। কেননা সবকিছু তো সরকারি সংগ্রহশালা পর্যন্ত পৌঁছায়নি। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছেও রয়ে গিয়েছে প্রাচীন আফ্রিকার ইতিহাস সমৃদ্ধ অনেক পাণ্ডুলিপি। যেখানে, গণিত, দর্শন, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, সাহিত্য, ধর্ম, শিষ্টাচার সবকিছুর উল্লেখ রয়েছে। টিম্বাকটুর মানুষের খাদ্যাভ্যাস। কোন সময় কোন পাত্রে খেতে হয়। কী নেই সেই তালিকায়। পঞ্চদশ ষোড়শ শতকের টিম্বাকটু সমগ্র, ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়া মহাদেশের কাছে এক বিরাট বিস্ময়।