মেঘ পিওন ব্যাগে করে সবসময় যে কেন এত দিস্তা দিস্তা মন খারাপ নিয়ে আসে কেই বা জানে। হয়তো এই মন খারাপের মধ্যেই ভাল থাকার পাসওয়ার্ডের চাবি মিলতে পারে। না না আজ আর কাব্য নয়। এক সপ্তাহের ধুমধাম সেরে ঝলমলে চন্দননগর যেন আজ রাতভর অন্ধকারে ডুবে থাকবে। প্রবল বেগে বাংলা অভিমুখে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় বুলবুল যে পূর্বভাস দিচ্ছে, তাযেন এই মন খারাপের সঙ্গে মানিয়ে যাওয়া বেহাগ। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর কাজের বাড়ি থেকে ফিরতেই বেলা গিয়েছে। আজ ডায়মন্ড হারবার লোকালের ভিড়টার কথা মনেই করতে চাইল না শ্যামা। কিন্তু ভিড়ের মাঝে আলো ছড়িয়ে বসে থাকা অমন সুন্দর মুখখানি যে সে ভুলতেই পারছে না। আরও পড়ুন-বিদায় বেলায় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রায় চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী, রাতভর যেন রূপকথার জাল বোনে গঙ্গার পাড়ের এই শহর
বহুদিন পর বাড়ি ফিরছে, দেশের বাড়ি। দিল্লিতে যেন কোন সরকারি আপিসের বড় অফিসার। নামও বলেছিল, মুক্যুসুক্যু শ্যামার অতশত মনে নেই। ছেলেকে গ্রামের বাড়ির জগদ্ধাত্রীপুজোর গল্প করছিল দিদিমণি। ফুটফুটে বাচ্চা মায়ের কোলে মাথা রেখেই মন দিয়ে শুনছিল, কেমন চোখ ধাঁধানো গল্প। কাজের বাড়ির মাসিমা একটু আচার দিয়েছে, তাই দিয়েই ব্যাগে থাকা মুড়ি মেখে খাচ্ছিল শ্যামা। আর তার পাশে বসেই চলছিল মা ছেলের পুজোর গল্প। সারাবছর ধরে পরিকল্পনা চলে, এবার মা ঘরে এলে কী শাড়ি পড়ানো। ভোগের উপকরণে কোনও রদবদল হবে কি না। যেবার দিদিমণি মাধ্যমিক পাশ করল সেবার বড় মা ঠাকুরের নথ গড়িয়ে দিলেন। ছোট দাদাবাবু যেবার বিদেশে পড়তে গেল, সেবার ঠাকুরের বাজুবন্ধ এল। আর দিদিমণি চাকরি পেলে নিজেই তো সোনার হার গড়িয়ে দিলে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই হইহই করে বিয়ে হয়ে গেল। জামাই সরকারি আমলা, বড় মা আনন্দে ঠাকুরের মুকুট গড়িয়ে দিলেন। মুখুজ্জেবাড়ির জগদ্ধাত্রীর গয়না দেখলে পাড়ার লোকেরও চোখ টাটায়। তবে ঠাকুর দেবতার গয়না কিনা তাই নজর দিতে পারে না, পাছে দোষ লাগে। তাহলে গাঁ ঘরে তো আর মুখ দেখানো যাবে না। বিয়ের পর প্রথম পুজোয় দিদিমণির বড় ধুনুচি নিয়ে কি নাচটাই না নাচলেন, আর মাকে প্রথম বরণ করে সিঁদুর খেলা! দিদিমণির অমন ফরসা গালে লাল রং, আহা শ্যামা যেন চোক বন্দ করলেই দেখতে পাচ্ছে। আরও পড়ুন-‘আলো নিয়ে চন্দননগর আজ যা ভাবছে, গোটা দেশ তা ভাববে আগামী বছর’
ওমাসি যাইগো, আকাশ যে আঁধার করে এল। ট্রেন ততক্ষণে পিয়ালি স্টেশন ছাড়িয়ে গিয়েছে। শ্যামাও যেন ভেসে চলল এক অনাদি কালের জগতে, মাঝে মাঝে ভোররাতে ঘুম ভেঙে গেলে সেসব দিনের কথা বেশ মনে পড়ে। মনে হয় কোনও স্বপ্ন, এই দিন আনি দিন খাইয়ের সংসারে, এসব তো কখনও ছিল না। হয়তো বা আগের জন্মের কথা। সেবার কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোতে বাবা একখানা লাল কাপড় এনেছিল। দুগ্গাপুজোয় মালিক ছুটি দেয়নি। তাই লক্ষ্মীপুজোতেই শ্যামাদের চারচালা ঘরে আনন্দের ঢেউ আনত। সকালবেলা উপোশি মা সারা উঠোনে চালের গুঁড়োর আলপনা আঁকত। আগের দিন রাতেই নাড়ু করেছে। ঠাকুমা সকালে মোয়া বানালো। সন্ধ্যা নামতেই পাড়ার হরি ঠাকুর এসে পুজো করে গেল। তার আগে মা লাল শাড়িখানা শ্যামাকে পরিয়ে দিল। নিজের পরনে একটা লালপেড়ে সাদা থান, শতব্যবহারের জায়গায় জায়গায় পিঁজে গিয়েছে। সেদিন প্রসাদ খেতে এসে প্রসন্ন খুড়ি শ্যামাকে দেখে অবাক। মাকে ফিসফিসিয়ে কী যেন বলে চলে গেল। ঘুমিয়ে পড়েছিল শ্যামা, হঠাৎ বাবা-মায়ের কথায় সচকিত হয়ে শুনতে পায়, খুড়ির ভাইপোর সঙ্গে তার বিয়ের কথা হচ্ছে। কালীপুজো পেরোলেই বিয়ে। দেখতে দেখতে লালচেলি পরে শ্বশুরবাড়ি চলে গেল সে। গরীবের বিয়েতে তো আর সানাই বাজে না, পাড়ার কালীমন্দিরেই সেসব পাট চুকলো, বাবা পুরোহিতকে বিয়ে বাবদ ৫১ টাকা ধরে দিয়েছিলেন। জামাইকে যৌতুকে দিলেন ভ্যানরিকশা কেনার টাকা। মেয়ে তার ভাল থাকবে, এই আশায়। আরও পড়ুন-চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী প্রতিমার কাঠামো পুজো হয় দুর্গা দশমীতে, পুজোর কয়েকদিনের অনুভূতি অসামান্য
চন্দননগরের খলিসানিতে শ্বশুরবাড়ি, কতক্ষণ ট্রেনে চেপে ডায়মন্ড হারবার থেকে সেখানে পৌঁছাতে হয়। বিয়ের পড়ে অমন জগদ্ধাত্রী পুজো দেখে চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল। বর ভাড়া খেটে ফিরলে রাতেই লাইটিং দেখতে বেরতো দুজনে। বেশ কাটছিল দিনগুলো। বছর ঘুরেছে, এবার ডায়মন্ড হারবার যাওয়ার সময় হয়ে এল, বর বললে ঠাকুর দেখিয়ে তারপর নিয়ে যাবে। শ্যামার কোল আলো করে যে মা আসবে। শরীরটা ভাল ছিল না, কোন সকালে ভদ্রেশ্বরে গেল মানুষটা, সেদিন দশমী শোভাযাত্রা বেরিয়ে কাতারে কাতারে লোক রাস্তায়। বেলা গড়িয়ে সন্ধে হল, মানুষটা বাড়ি এল না। শ্যামা ভারী শরীর নিয়েই ঘরবার করছে। সারারাত দাওয়ায় বসে থাকতে থাকতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ কীযেন শব্দে সে ধরফড়িয়ে ওঠে, পাশের বাড়ির মেনিটা রান্নাঘরে বাসন ফেলেছে, একে নিয়ে আর পারা গেল না। ওমা পূব আকাশ যে ফর্সা হয়ে গেল তিনি যে এলেন না। আ মোলো যা কখন নাইতে এয়েছিস, এখন ডুব দিলে জ্বর হবেই হবে, চল চল ঘরে চল, মেয়েটা যে মা মা করে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলল, আর মায়ের দিকি কোনও হুঁশ নেই। শ্যামার মেয়ে চম্পা, আর পাঁচ দিন পরেই জন্মদিন, আজ ডায়মন্ডের বাজার থেকে ওর জন্য নুপুর কিনবে, কথা দিয়েছিল। দেখতে দেখতে মেয়েটা বড় হয়ে গেল, সামনের বছর ক্লাস ফাইভে উঠবে, পাড়ার মাস্টারমশাই বলেছেন, মেয়ে পড়াশোনায় খুব ভাল। ওকে নাকি সবাই মিলে নরেন্দ্রপুরের মিশনে ভর্তি করে দেবে। শ্যামার আর কী সামর্থ্য, তা-ও যদি মেয়েটার একটা হিল্লে হয়।
নাহ সেদিন কেন, মানুষটা আর কোনওদিনই ফেরেনি। স্ট্যান্ডের অন্য ভ্যানওয়ালারই খবরটা এনেছিল। জগদ্ধাত্রীঠাকুর দেখতে আসায় ট্রেনে খুব ভিড়ছিল, কাজ সেরে কোনওরকমে ঝুলতে ঝুলতে ফিরছিলেন তিনি। গাড়ি চন্দননগরে ঢোকার আগেই হাতল থেকে ফস্কে যায় হাত। না সেসব আর মনে করতে চায় না শ্যামা। সেই যে বাবা-মা পোয়াতি মেয়েকে বাড়ি এনেছিল আর চন্দননগরে যাওয়া হয়নি। বিসর্জনের ঘাটেই শাখা-পলা ভেঙে সাদা থান জড়িয়ে দিয়েছিল পড়শিরা, শ্যামা তখন ১৭। ট্রেনের দিদিমণি জগদ্ধাত্রীর ভাসানের গল্প করছিলেন, তিনি কী করে জানবেন ওই দিনে শ্যামার কি ভেসে গিয়েছে। নাহ সিঁদুর খেলা হয়নি, মা চলে যাওয়ার বিষাদ তাকে ছুঁতেই পারেনি, পাথর হয়ে গিয়েছিল। এমন মন খারাপ করা বৃষ্টি নিয়ে সেই দিনটা আবার ফিরে এল। পিছনের নটা বছর শ্যামা মনে করেনি, ট্রেনের দিদিমণি কেমন করে যেন তার লুকোনো ব্যথাটা জেনে ফেলেছে। মনের কোণে ধুলো পড়া স্মৃতিতে বাজছে বিসর্জনের সুর। বুকের মধ্যে চিনচিনে ব্যথাটা যেন কার কথা বলতে চাইছে। ভাবতে ভাবতেই ডুব দিল শ্যামা, পায়ে কীযেন একটা ঠেকতেই টেনে তোলে, শোলার কাজ, জায়গায় জায়গায় রং এখনও টিকে আছে। লাল রং, জগদ্ধাত্রী ডাকের সাজ। বিসর্জনে ধুয়ে গিয়েছে। শোলাখানা সরাতে গিয়ে সাদা কাপড়ে লাল রং লেগে গেল। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। ট্রেনের দিদিমণি সব গুলিয়ে দিলেন।