সুদর্শনা সেন
বসন্ত এলেই তিনি স্মৃতিতে বাঁচেন, ঘণ্টা তলা, সেঁজুতি, গৌর প্রাঙ্গণ, আশ্রম মাঠের সেই আড্ডা। বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়েই দেখতে পান গোল থালার মতো চাঁদটা তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সেই ছোটবেলার মতো। আশ্রম মাঠে চল, আড্ডা হবে। তিনি বাংলাদেশ ভবনের মিউজিয়াম অ্যাসিস্ট্যান্ট তথা শান্তিনিকতনের ব্রহ্মচর্যাশ্রমের গুরু ক্ষিতিমোহন সেনের প্রপৌত্রী সুদর্শনা সেন। bongmag.com- এর সঙ্গে ভাগ করে নিলেন বসন্ত উৎসবের স্মৃতি।
আমাদের ছোটবেলায় বসন্ত উৎসব ছিল অদ্ভুত এক মেতে ওঠা। এই তো সেদিন মনে হয়। সকালে আমাদের প্রসেশন শুরু হত করবীর সামনে থেকে শান্তিনিকেতন গৃহর পিছন থেকে সারিবদ্ধ ভাবে নাচতে নাচতে গিয়ে বসতাম গৌর প্রাঙ্গণে। তখন বসন্ত বন্দনা থেকে বসন্ত উৎসবের অনুষ্ঠানের সবটাই গৌর প্রাঙ্গণের মুক্তমঞ্চে হত। বসন্ত উৎসবের আগের দিনটা ছিল আমার কাছে ভীষণ আগ্রহের ও আনন্দের।
এখন যেমন চারদিকে বড় বড় স্ক্রিনে অনুষ্ঠান দেখানো হচ্ছে। ক্যামেরা পার্সনরা পিছনে পিছনে ছুটছেন। তখনকার দিনে বসন্ত উৎসব কিন্তু এতটা বাণিজ্যিক ছিল না। তখনও ছবি তোলা হত, ক্যামেরা ম্যানরা থাকতেন, তবে সবটাই ছিল ভীষণ ঘরোয়া। সেই সময় যে বাজে লোকদের ভিড় হত না এমন কিন্তু নয়। তবে সংখ্যাটা কম ছিল। একটা সময় বসন্ত উৎসবের ভিড়কে নিয়্ন্ত্রণে রাখতে নিরাপত্তা বাড়িয়ে দেওয়া হল। যখন আমাদের অনুষ্ঠান হয়ে যাওয়ার পর গৌর প্রাঙ্গণে আসতাম, তখন বেশ ভয়ে ভয়ে থাকতাম, এই বোধহয় বাইরের কেউ জোর করে আবীর দিয়ে দিল। যাইহোক সেই সময় খুব সুন্দরভাবে নিরাপত্তা বাড়িয়ে তা নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
গৌর প্রাঙ্গণে দোলের আগের দিন বিকেলে একটা সঙ্গীতানুষ্ঠান হত। তবে সেই অনুষ্ঠানে ততটা থাকা হত না। ওই বিকেলটা আমাদের আবীর কেনার সময় ছিল। রতনপল্লিতে অমৃতা নামের এক দোকানে মিষ্টি চা ও নোনতার সঙ্গে জমত আড্ডা। বসন্ত উৎসব এলে অমৃতার সামনে নীলরঙের একটা শামিয়ানা টাঙানো হত। সেটা দূর থেকে দেখতে পেলেই উৎসবের অনুভূতিটা আরও প্রবল হত। সেই অমৃতা পরে মধুবন হয়ে গেল, এখন বোধহয় ফের নাম বদল হয়েছে মালিকানা বদলের সঙ্গে সঙ্গে। আরও পড়ুন- দোল এলেই ভয় হয়, উন্মত্ত জনতার ভিড়ে একলাটি শান্তিনিকেতন
বন্ধুদের সঙ্গে রতনপল্লিতে আবীর কিনতে যাওয়ার মজাটাই আলাদা ছিল। হালকা হলুদ, গোলাপীর দুটো শেড, টুকটুকে লাল, আর সবুজ। এই তিন চারটে রঙেরই আবীর মিলত। এখনকার মতো কমলা আবীর তখন ছিল না। বাটখাড়া নিয়ে আবীর মেপে বিক্রি হত। সাধারণত শাড়ি পরে যেতাম, খুব আনন্দ হত। বসন্ত উৎসব আসছে, এই আনন্দটা দারুণ ছিল। আগের দিনের আনন্দটা ছিল নিজেদের উদযাপন। অমৃতাতে বসে কেউ গান করছে। দফায় দফায় আড্ডা গান হত। সেই সময়টায় সবার মধ্যেই কেমন একটা আত্মিক টান ছিল।
এখন তো একটা আমোদের জায়গা হয়েছে শান্তিনিকেতন, বিশ্রী রকমের আমোদ। সবথেকে যেটা বাজে লাগে বাইরে থেকে আসা ট্যুরিস্টরা গলায় পলাশ ফুলের মালা জড়িয়ে আবীর মেখে শান্তিনিকেতনে ঢুকছেন। এটা সত্যি বড় হাস্যকর। পলাশফুলের মালা বিক্রির এই হিড়িক কিন্তু আমাদের ছোটবেলায় ছিল না। এখন যেমন যে যা ইচ্ছে নিয়ে রাস্তা আটকে বসে পড়ছে, এটা কিন্তু হত না। গাছের ফুল ছিঁড়ে গয়না পরার চল তখন থেকেই বেড়েছিল। বসন্ত উৎসবের পরে শান্তিনিকেতনে পলাশগাছ গুলি পুরো ন্যাড়া হয়ে যেত। খুব বাজে অবস্থা, সেই সময় হাল ধরেন শ্যামলী খাস্তগীর। এমন পলাশ নিধন যে চলবে না তা জানিয়ে দেন। এরপর থেকে পলাশ ফুল এক আধটা ব্যবহৃত হত। আমরা গাছের পাতা দিয়ে গয়না গড়িয়ে পরতাম। তখন পাঠভবনেই পড়ি। কানের হাতের গলার, খোঁপার। প্রতীকী হিসেবে একটা পলাশ ফুল হয়তো টিকলি হিসেবে বা কানে রাখতাম।
দোল আসছে আসছে এটা দারুণ আনন্দের ছিল। ক্লাস টেনে পড়ার সময় থেকেই দোলের আগের দিন রাতে আশ্রম মাঠে বসে গল্প হত। চাঁদের আলোয় ভেসে যেত গোটা মাঠ। এখন তো সেটাই আর পাওয়া যায় না। মাঠের চারদিকে বড় বড় আলোক স্তম্ভ। হলুদ, সাদা সবুজ আলোয় প্রকৃতির আলোটাই হারিয়ে গিয়েছে। তখন ঘাসে ঢাকা থাকত মাঠ, আমাদের ছোটবেলায় বসন্ত উৎসবে বৃষ্টি হয়েছে, এমনটা মনে পড়ে না। যত উঁচু ক্লাসে উঠেছি, তত বেশি রাত পর্যন্ত মাঠে বসে গল্প করার স্বাধীনতাটা বেড়েছে। হস্টেলের বন্ধুরা যতক্ষণ থাকত আমিও ততক্ষণ থাকতাম। কেউ বাঁশি, কেউ খোল বাজাচ্ছে, কেউ গাইছে। কেউ বা নাচ করছে। গোল গোল করে মাঠে এমন আড্ডা চলত। কোথাও কলাভবন, কোথাও সংগীত ভবনের ছেলেমেয়েরা গোল হয়ে বসে সাংগীতিক আড্ডা চলছে। আমাদের কোনও ভবন ভিত্তিক আড্ডা ছিল না। বন্ধুরা বসে গানে কথায় আড্ডায় মেতে উঠতাম। আরও পড়ুন-ফেলে আসা মেয়েবেলা ও মন কেমনের বসন্ত উৎসব
কলকাতায় যাঁদের টিকিট কেটে দেখতে হয়, সাংস্কৃতিক জগতের সেই সব খ্যাতিমানদের তখন অনায়াসে কাছে পেতাম। এখনও পাই তবে তখন অনেক অনাড়ম্বরভাবে পেতাম। আমাদের ছোটবেলায় অমর্ত্য সেন ধুতি পাঞ্জাবী পরে সেঁজুতিতে এসে বসে থাকতেন। চাঁদের আলোয় আশ্রম মাঠে সেবার আমাদের বন্ধু পাপিয়া নাচছে। হঠাৎ দেখলাম এক দীর্ঘাঙ্গী মহিলা নাচতে শুরু করলেন পাপিয়ার সঙ্গে। তিনি মঞ্জুশ্রী চাকী সরকার। এখন সেই অপশনটাই তো নেই।
এরপর পরদিন ভোরবেলা শাড়ি পরে সেজেগুজে গৌর প্রাঙ্গণে প্রসেশনে আসা। এখন যেমন বসন্ত উৎসব সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই লোকজন আবীরে রেঙে ঘুরে বেড়ায়, তখন কিন্তু ‘রাঙিয়ে দিয়ে যাও’ গানের আগে কেউ কাউকে আবীর দিত না। তখন থেকেই ভিড়টা বাড়তে শুরু করে। গৌর প্রাঙ্গণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পর আমরা বন্ধুরা আশ্রম মাঠে বসে আড্ডা নাচ গান চলত। আশ্রম মাঠ তখন ছিল খোলা আনন্দের জায়গা। সমস্ত ক্যাজুয়াল গ্যাদারিং হত সেখানেই। দলের মধ্যে একের পর এক গান হত, সঙ্গে তালমিলিয়ে নাচ। আরও পড়ুন- ‘রবীন্দ্রনাথ চাইতেন শান্তিনিকেতনকে ছড়িয়ে দিতে, পাড়ায় পাড়ায় বসন্ত উৎসব গড়ে উঠুক’
এসব মিটলে বন্ধুরা মিলে মিতু আইসক্রিম খেতে যাওয়া। মিল্ক বার, চকলেট বার থাকত গোপালদার কাছে। তিন চার টাকা দাম ছিল মিল্ক বারের। আবীর মাখা হাতে গোপাল দার মিতু আইস্ক্রিম স্মৃতিতে লেপ্টে আছে। আবীরের গন্ধের সঙ্গেই মুখের মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে মিতু আইসক্রিম। গোপালদা এখনও বসেন স্টেট ব্যাংকের সামনে। চেহারাটাও সেই একই রকম আছে।
এতকিছুর মিশ্রণে বসন্ত উৎসব এক সুমিষ্ট অনুভূতি। আমরা গৌর প্রাঙ্গণে বসন্ত উৎসব দেখেছি। আর বাবাদের সময় বসন্ত উৎসব হত আম্রকুঞ্জে। তখন আমগাছের ডাল থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া হত উত্তরীয়। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। জওহরবেদীর চারপাশে আল্পনা দেওয়া হত। তাঁরা রবীন্দ্রনাথকে দেখেননি, তবে রবীন্দ্রনাথের কাছের মানুষদের দেখেছেন, তাঁদের সঙ্গে কাজ করেছেন। সেই সময়কার বসন্ত উৎসবের গল্প শুনলে স্বপ্নের মতো লাগে। শান্তিনিকতনে রোদ্দুর, বৃষ্টি মেখে বড় হয়েছি, ছোটবেলাটা মিশে আছে আশ্রমের মোরামে, ধুলোতে। তাই তো বৈতালিকে অংশ নিতে ভুলি না। সব বন্ধুদের সঙ্গে আজ আর যোগাযোগ নেই। কিন্তু মনের টানটা রয়ে গেছে। বৈতালিকে গান গাইতে গাইতে যখন শান্তিনিকেতন গৃহের পাশ থেকে এগিয়ে চলি, কখনও ফেলে আসা ছাত্রী জীবনের কোনও সহপাঠীর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। তখন কী যে ভাল লাগে। এখন বসন্ত উৎসব আমার কাছে পুনর্মিলন উৎসব, নিজের মতো করে উদযাপনের একটা অবকাশ।