এবং রূপকথা
১৯৫৮-র ২৯ সেপ্টেম্বর যে যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০২০-র ১৮ ফেব্রুয়ারি ভোট তিনটে বেজে ৩৫ মিনিটে তার যবনিকা পড়ল। ভরা বসন্তে চলে গেলেন আটের দশকের বাঙালি মধ্যবিত্তের ভিরু প্রেমের নায়ক তাপস পাল। ভিরু প্রেমই তো বলতে হবে, এমন সাদামাটা চেহারা, ঠোঁটের উপরে সদ্য গজানো গোঁফ নিয়ে আর কেই বা সদর্পে প্রেম করতে পেরেছে। সেই সময়কার হার্টথ্রব নায়িকা মহুয়ার বিপরীতে নায়ক হয়েছেন। যে মহুয়ার এক চাহনিতেই বাংলার তরুণ সমাজ প্রেমের নতুন ভাষা পড়তে শিখেছিল। মাসল নেই, নেই মাচো চেহারা। না ছিল ফিল্মি ব্যাকগ্রাউন্ড। তারপরেও চন্দননগরের নিপাট ভালমানুষ চেহারার তাপস পাল কিন্তু কলকাতার একসে বরকর এক যুবকদের হারিয়ে অডিশনেই তরুণ মজুমদারের মন জিতে নিলেন।
একেই বলে ভাগ্য, ছাত্রজীবন থেকে নাটক করলেও অভিনয় দেখতেই বেশি পছন্দ করতেন। তবে কলেজে পড়ার সময় মনে হল সিনেমায় সুযোগ পেলেই অভিনয় করবেন। ‘দাদার কীর্তি’ ছবির জন্য সেসময় নতুন মুখ খুঁজছেন তরুণ মজুমদার। খবর পেয়ে বছর বাইশের তাপস চলে গেলেন কলকাতায়, অডিশনও দিলেন। সেদিনই ভাগ্যদেবী মফঃস্বলের লাজুক তরুণের আগামী রচনা করে ফেলেছিল। ‘দাদার কীর্তি’ ছবির পোস্টার তখন কলকাতার বিভিন্ন সিনেমা হলের চারপাশে। অভিনেত্রী মহুয়া তখন বাঙালির স্বপ্নসুন্দরী। তাঁর নতুন ছবি আসছে, সবাই হুড়মুড়িয়ে পোস্টারের সামনে পৌঁছে গেল। কিন্তু মহুয়ার সঙ্গে এ কে? কেমন ভ্যাবাগঙ্গারাম টাইপের চেহারা। ইনি কিনা মহুয়ার নায়ক, একে কেউ দেখবে না। তরুণ মজুমদারের নিশ্চই ভীমরতি হয়েছে, নাহলে এঁকে কিনা মহুয়ার বিপরীতে নেন। ছবির পরিশ্রম পয়সা সব জলে গেল বলে।
সাধারণ দর্শক শুধু নন, টলিপাড়ার অনেক আচ্ছা আচ্ছা ব্যক্তিত্বও সেদিন আড়ালে ছবির ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। তবে পাশাও উল্টে যায়, নাহলে মহুয়ার হাতযশ বলতে হবে। যাই হোক না কেন, আটের দশকের বাঙালির ড্রয়িংরুমে প্রেমের গানের জায়গা করে নিল রবিঠাকুরের ‘চরণও ধরিতে দিয়ো গো আমারে’। কেন জানি না মারকাটারি নায়িকা মহুয়ার বিপরীতে লাজুক গোবেচারা কেদারকে সবাই ভালবেসে ফেলল। প্রথম সিনেমাতেই বাজিমাত করলেন তাপস পাল। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সাফল্য যেন চন্দননগরের যুবকের জন্যই ওঁত পেতে অপেক্ষা করছিল। একেবারে সোনায় মোড়া অভিনয় জীবন। ‘সাহেব’ ছবিতে কি অভিনয়টাই না করলেন। সেই মধ্যবিত্ত বাঙালির ভিরু চাহনি। দাদাদের সংসারে বেকার ভাই। এবারও বক্সঅফিসে তুমুল ঝড়। ৮৪ সালে কারোর কথা না শুনেই যেমন ঝড়ের মতো বাংলা ছবিতে এসেছিলেন ঠিক তেমনভাবেই চলেগেলেন মুম্বই। হ্যাঁ, তিনিই তাপস পাল বাঙালির হার্টথ্রবের বিপরীতে গোবেচারা হয়েও যিনি জিতে যান। ভাগ্যদেবীর কি মহিমা, পরবর্তীকালে যাঁর অঙ্গুলিহেলনে চলবে বলিউড সেই মাধুরীর প্রথম নায়ক তাপস পাল। আরও পড়ুন-ক্যানভাসে বৃষ্টির রাত, প্রহর জাগে ১৪ ফেব্রুয়ারি
মুম্বই তাঁকে আপন করে নেয়নি, যে স্বপ্নকে সম্বল করে বলিউডে গিয়েছিলেন তা খানখান হয়ে যেতেই ফের টলিপাড়ায় ফিরে আসেন তাপস। তারপর বাঙলা ছবিতে নিজেকে উজাড় করে দেন। ‘ভালবাসা ভালবাসা’ ছবিতে দেবশ্রীর সঙ্গে জুটি বেঁধে অসাধারণ অভিনয়। বাণিজ্যিক বাংলা ছবিতে তাঁর মতো কটা নায়ক যে এতবার জুটি বদলে সাফল্য পেয়েছেন তা হাতে গুনে বলা যেতে পারে। এরপর শতাব্দী, তারপর রচনা। হিট কিন্তু তাপসকে কখনও ছেড়ে যায়নি। শুধু বাণিজ্যিক ছবিই বা বলি কীকরে। পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘উত্তরা’, একেবারে ভিন্ন চরিত্রে অভিনয়। সেই পালোয়ানিতেও রাখলেন প্রতিভার ছাপ। সম্মান এল, জেনিভায় গেলেন পুরস্কার আনতে। পরে বুদ্ধদেববাবুর ‘জানলা’ ছবিতে চোর-এর চরিত্রে ফের অনবদ্য তাপস পাল। এর মাঝে ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’ বা আরও পরে ‘আটটা আটের বনগাঁ লোকাল’। সিনেমার জগতে এসব একেকটা দলিল হয়ে থাকবে। সত্যি সত্যি তাপস পালকে সেভাবে ব্যবহার করতে পারেনি টলিউড। নাহলে জাতীয় পুরস্কারের ঝুলিটা আরও ফুলে ফেঁপে উঠত।
বাণিজ্যিক ছবি যে তাঁর গণ্ডি ছিল না, মাঝে মাঝে পথ ভুলে দু-একটা ভিন্ন ধারার ছবিতে অভিনয় করে নিজেই সেই প্রমাণ রেখেছেন। নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া নয়, যখন অভিনেতা হিসেবে নিজেকে ভালবাসার সময় তখনই জীবনের ট্র্যাক বদলে ফেললেন তিনি। তাঁর জীবন অন্য খাতে বইতে শুরু করল, বাংলাছবি না বুঝেই এক অসামান্য অভিনেতাকে হারিয়ে ফেলল। আসলে তাপস পাল নিজেই জানতেন না তিনি কি ছিলেন। ৮০ সালে যখন টলিপাড়ায় গোবেচারা কেদার ঝড় তুলতে আসছে। সেই বছরেই অস্তাচলে গিয়েছেন বাংলা ছবির চিরকালের আইকন উত্তম কুমার। তাপস পাল যদি অভিনয় জীবনকে আর একটু সময় দিতেন, তবে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় এত তাড়াতাড়ি ভিন্ন ধারার ছবির একমাত্র মুখ হয়ে উঠতেন না, এটা হলফ করে বলা যায়। আরও পড়ুন-ফেলে আসা মেয়েবেলা ও মন কেমনের বসন্ত উৎসব
ভালবাসা তাঁকে সবসময় জড়িয়েছিল, কেদারকে ভুলে গেলে যে মধ্যবিত্ত বাঙালির ভিরু প্রেমকে অস্বীকার করতে হয়। ভুলত্রুটি সকলের জীবনেই থাকে, তারপরেও শত দুঃখে হাসিমুখে বেঁচে থাকে সাহেবরা। যেমন আচমকাই সাফল্যকে মুঠোবন্দি করেছিলেন, তেমন হঠাৎ অবহেলাতেই হারিয়ে গেলেন। যে কেদারের জন্য আমৃত্যু চোখের জল ফেলবেন সন্ধ্যা রায়। তিনি তো মানুষ তাপসকে চেনেন না। চেনেন নিজের ছেলেকে, মঙ্গলবার কাকভোরে যাঁর কোল শূন্য হয়ে গেল।