সৌভিক রায়
সালটা ২০১৩, চলেছি এভারেস্ট বেস ক্যাম্প (Everest Base Camp) ট্রেকে৷ হাওড়া স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু, রওনা দিলাম মিথিলা এক্সপ্রেসে৷ বিকেল ৩টে বেজে ৪৫-এ ছাড়ল ট্রেন৷ গন্তব্য তো আপনাদের জানা৷ দুই বন্ধু ট্রেকিংয়ে যাব৷ হ্যাঁ আমার পর্বতারোহণের সারথি সুব্রত একদিন আগেই পৌঁছে গেছে কাঠমান্ডু৷ তখনও পর্যন্ত আমাদের পর্বতারোহণের অভিজ্ঞতা সেরকম নেই৷ একবার মাত্র সান্দাকফু গেছি৷ কিছু ইউটিউব ভিডিও দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে হাই অল্টিচিউড ট্রেকে বেরিয়ে পড়লাম৷ একেবারে গাইড পোর্টার ছাড়াই৷ সকাল সাড়ে নটা নাগাদ বিহার নেপাল সীমান্তবর্তী জনপদ রাক্সলে পৌঁছে গেলাম৷ স্টেশনটা খুবই ছোট৷ বাইরে এসে টাঙা ধরে সীমান্ত টপকে গেলাম৷
কাঁটাতারের সামনে এসএসবি জওয়ান পরিচয়পত্র দেখল৷ তবে নেপালে প্রবেশের পর কোনও চেকিংই হল না৷ টাঙাওয়ালা শেয়ারের ভাড়া খাটে এমন সুমো স্ট্যান্ডে নিয়ে আসল৷ সেখান থেকে আমি কাঠমান্ডুর শেয়ার গাড়িতে বসে পড়লাম৷ তার আগেই কারেন্সি এক্সচেঞ্জ ও মধ্যাহ্ন ভোজ সেরেছি৷ প্রায় সাতঘণ্টা জার্নি করে বহু পাহাড়ি রাস্তা পেরিয়ে পৌঁছালাম কাঠমান্ডু৷ আরও পড়ুন-ঘুঙরু বাঈ
বিকেল পাঁচটা নাগাদ এসে পৌঁছালাম কাঠুমান্ডুর বাল্খু-তে৷ সেখান থেকে থামেলে (নেপালের জমজমাট শহর) এলাম৷ এখানেই আমার হোটেল৷ সুব্রত হোটেলের নিচে দাঁড়িয়ে থাকায় খুঁজে পেতে অসুবিধা হয়নি৷ নেপালে প্রবেশের পর থেকে মোবাইলের যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে৷ সেদিন সন্ধ্যার মধ্যে ট্রেকিংয়ের যাবতীয় সরঞ্জাম কেনার পাশাপাশি মোবাইল সিম কার্ড নিয়ে নিলাম৷ এখানে তিন সংস্তার সিমকার্ড মেলে৷ নমস্তে, এনসেল ও নেপাল টেলিকম৷ আমি এনসেলের সিম নিলাম৷
পরের দিন সকালে পারমিট করাতে যেতে হবে৷ সেখানে বাইরের পর্বতারোহীদের জন্য পাসপোর্ট আবশ্যক ছিল৷ যদিও আমি কলকাতা থেকে পাসপোর্ট নিয়ে রওনা হইনি৷ সে যাইহোক বলে কয়ে সমস্যা মেটানো গেল৷ সবকিছুর আগে দরকার ট্রেকিংয়ের পারমিট৷ তা করাতে হবে ট্যুরিজম অফিস থেকে৷ তাহলেই মিলবে সচিত্র পরিচয়পত্র৷ যার নাম ট্রেকার ইনফর্মেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (TIMS)৷ এজন্য ছবি ও প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রমাণ সঙ্গে রাখতে হবে৷ সেই কার্ডে প্রচুর স্ট্যাম্পিংয়ের জায়গা রয়েছে৷ এরপর পর্বতারোহণের পথে যত চেকপোস্ট পড়বে, সব জায়গাতেই সেই কার্ডে স্ট্যাম্প মেরে দেওয়া হবে৷
সকাল সকাল ট্রেক পারমিট বানাতে বেরিয়ে পড়লাম৷ নতুন শহর হাঁটতে ভালই লাগছিল৷ মিনিট ১৫ হাঁটার পর পৌঁছে গেলাম কাঠমান্ডু ট্যুরিজম অফিসে৷ এখান থেকে আমাকে TIMS কার্ড ও সাগরমাথা ন্যাশনাল পার্কের পারমিট নিতে হবে৷ ওখানে শুনলাম, সার্কভুক্ত দেশগুলির জন্য বড় অংশের ছাড় রয়েছে, চিনও পড়ছে এই তালিকায়৷ বিদেশিদের জন্য ২ হাজার টাকা, সার্কভুক্ত দেশ ৪০০ টাকা৷ পারমিট বানাতে ফর্ম ফিল আপ করতে হবে, সেখানে ছবিও জরুরি৷ সাগরমাথা ন্যাশনাল পার্কের পারমিট করালাম না৷ জানতে পারলাম, সাগরমাথা (Everest Base Camp) ন্যাশনাল পার্কের অফিস থেকে যদি পারমিট করাই তাহলে ডিসকাউন্ট পাব, এখানে তা মিলবে না৷ তাই ওটি দ্বিতীয় বারের জন্য তুলে রাখলাম৷ আরও পড়ুন-Rituparno Ghosh: ঋতুপর্ণ ঘোষ ও এক ঋতু-ময় চিত্রকল্প
ফিরে চললাম থামেলের দিকে৷ এবার যেতে হবে তারা এয়ার লাইন্সের অফিসে৷ কলকাতা থেকে ইমেল মারফৎ এই এয়ারলাইন্সের সঙ্গে যোগাযোগ করি৷ একটি টাকাও খরচ না করে আমার লুকলা যাওয়ার টিকিট বুক হয়েছিল৷ আমি এয়ারলাইন্সের অফিসে গিয়ে সেই ইমেলের প্রিন্টআউট দেখিয়ে কনফার্ম টিকিট নিই এবং পেমেন্ট করি৷ লুকলাতে খুব ছোট ছোট বিমান যায়৷ একেকটা বিমানে ১০-১২টা আসন থাকে৷ সাধারণত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাতিল হয়ে যাওয়া ছোট বিমানগুলি কাঠমান্ডু থেকে লুকলা যাতায়াত করে৷ আর লুকলা বিমানবন্দরের অবস্থানও ভয় পাওয়ার জন্য যথেষ্ট৷ ডিসকভারি এই লুকলা বিমানবন্দরকে world’s Most Dangerous Airport আখ্যা দিয়েছে৷
এভারেস্ট বেস ক্যাম্প (Everest Base Camp) পৌঁছাতে হলে এখান থেকে বিমানে লুকলা পর্যন্ত যেমন যাওয়া যায়৷ তেমন হেঁটেও যাওয়ার সুযোগ রয়েছে৷ তবে তা সময়সাপেক্ষ৷ কারণ দ্বিতীয় অপশন বেছে নিলে ট্রেক আরও সাতদিন বেড়ে যাবে৷ যাইহোক তারা এয়ারলাইন্সের অফিস থেকে টিকিট নেওয়ার পর মধ্যাহ্নভোজন সেরে ফেললাম৷ তারপর স্থানীয় সিদ্ধার্থ ব্যাংকে গিয়ে মুদ্রা বিনিময় হল৷ এরপর হোটেলে ফিরে বিশ্রাম নিয়ে সন্ধের দিকে শহরের আশপাশটা ঘুরে দেখছিলাম৷ থামেলের একটু বাইরে যেতে মনে হল, এই শহরে যত না মানুষের বাস তার থেকে বেশি ভগবানের বাস৷ যত বাড়ি আছে তার থেকে বেশি মন্দির৷
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই বুঝতে পারলাম বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে৷ চিন্তা হল, আমাদের ফ্লাইটটা ক্যানসেল না হয়ে যায়৷ এই চিন্তা মাথায় নিয়েই এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেখলাম, ভাগ্য সঙ্গ দিয়েছে৷ বৃষ্টি থেমে যাওয়ায় আধ ঘণ্টা দেরিতে লুকলাগামী বিমান উড়ল৷ আগেই বলেছি, বিস্বের বিপজ্জনক বিমানবন্দর এই লুকলা৷ তাই বিপদ এড়াতে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে বা বৃষ্টি হলে লুকলায় বিমান ওঠানামা বন্ধ হয়ে যায়৷ আরও পড়ুন-একটা বৃষ্টি দিন ও ভাল-বাসার নবনীতা
এদিকে বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার ফলে মেঘমুক্ত ঝকঝকে আকাশ৷ লানটানের পাহাড়গুলি কাঠমান্ডু এয়ারপোর্ট থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল৷ আমাদের ফ্লাইটটা ছিল ১৮ সিটের৷ খুব নিচু থেকে উড়তে শুরু করায় নিচের ঘরবাড়ি, পাহাড়, নদী সবই সুস্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল৷ ১০ মিনিট পরেই পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন নদী, উপত্যকার উপর দিয়ে উড়তে লাগল বিমান৷ এটা একটা অপূর্ব অভিজ্ঞতা৷ দূরে দূরে বরফাবৃত পাহাড়ের সারি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে৷ আধঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম লুকলা৷ ল্যান্ডিংয়ের সময় একটু ভয়ই লাগছিল৷ কিন্তু তারপরে মনটা আনন্দে ভরে গেল৷
লুকলায় নেমে আমাদের ট্রেকিং ব্যাগ সংগ্রহ করলাম৷ বিমানবন্দরের বাইরে স্থানীয় যুবকরা দাঁড়িয়ে আছে৷ তাদের জীবিকা সাধারণত পোর্টারি করা৷ এদিকে পোর্টার ছাড়া ট্রেক করব, আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছি৷ তাই বিমানবন্দর থেকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে প্রাতরাশ সেরে ফেললাম৷ লুকলার শেষ প্রান্তে আমাদের পারমিট চেক হল৷ এবার রাস্তা ক্রমশ নিচের দিকে নেমে চলেছে৷ বাম দিকে দুধকোশিকে রেখে শুরু হল হাঁটা৷ জঙ্গলের রাস্তা পাথরের সিঁড়ি দিয়ে নামছি৷ সরু সরু ঝর্না এদিক ওদিক চলে গেছে মাঝে মাঝে ছোট ছোট গ্রাম৷ সব গ্রামেই থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে৷ এদের মধ্যে সবথেকে বড় জনপদ হল ফাকডিং (Phakding)৷
অনেকে লুকলা থেকে যাত্রা করে প্রথমদিনের ট্রেক এখানেই শেষ করে৷ আমাদের হাতে সময় থাকায় আরও একটু এগিয়ে চললাম মঞ্জোর দিকে৷ হাঁটতে লাগলাম৷ মঞ্জোর মিনিট ১৫ আগেই আচমকা ঝেঁপে বৃষ্টি এল৷ মাথা বাঁচাতে কিছুক্ষণ একটা পাথরের খাঁজে অপেক্ষা করি৷ বৃষ্টিটা একটু ধরতেই সামনে এগিয়ে গিয়ে থাকার জায়গা পেলাম৷ বেশ সুন্দর জায়গা৷ কিছুক্ষণ পর আবার জোরে বৃষ্টি নামল৷ বাকি দিনটা অস্থায়ী আস্তানার জানলা থেকে বাইরের দিকে দেখেই কাটিয়ে দিলাম৷
পরদিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে মঞ্জো পৌঁছে গেলাম৷ সেতু টপকে এবার নদীর বাম দিকে যেতে হবে৷ মঞ্জো হল সাগরমাথা (Everest Base Camp) ন্যাশনাল পার্কের গেট৷ এখান থেকে ন্যাশনাল পার্কের টিকিট কাটায় সার্ক ডিসকাউন্টও পেয়ে গেলাম৷ আমরা নদীর বাঁদিক দিয়ে কিছুটা হাঁটার পর আবার সেতু টপকে ডানদিকে এলাম৷ এবার রাস্তা একদম নদীর পার ঘেঁষে৷ এখান থেকে ফার্নগাছ শুরু হল৷ মাঝে মাঝে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে৷ আবার কমেও যাচ্ছে৷ কিছুটা এগিয়ে একটা অপূর্ব দৃশ্য দেখলাম৷ সামনে দুটো পাহাড়ের মধ্যে মাটি থেকে প্রায় ৫০০ মিটার উঁচুতে দুটি ঝুলন্ত সেতু৷ নিচেরটি এখন আর ব্যবহার হয় না৷ তবে উপরেরটি সচল৷
এখানেই দুধকোশি আর ইজমাখোলা নদী এসে মিশেছে৷ এই ইজমা খোলাতেই আসে এভারেস্টের (Everest Base Camp) বরফ গলা জল৷ ডানদিকে পাথুরে রাস্তা ধরে এবার পাহাড়ের উপরে উঠতে শুরু করলাম৷ প্রায় ঘণ্টাখানেক ওঠার পর উপরের ব্রিজের মুখে এসে পৌঁছলাম৷ ব্রিজটা হাওয়ায় দুলছিল৷ একটু ভয় ভয়ও করছে৷ সব ভয়কে পাশে সরিয়ে ব্রিজের উপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম৷ এক কিলোমিটারের কাছাকাছি দীর্ঘ হওয়ায় সেতু পেরিয়ে যেতে প্রায় মিনিট দশেক সময় লাগল৷ কিছুটা যাওয়ার পর ভয় কেটে গেলে নিচের দিকে তাকানোর সাহস পেলাম৷
ব্রিজ পেরিয়ে আবার উপরে ওঠা৷ এবার রাস্তা একটু যেন ভাল হয়ে গেল৷ এখানকার মাটি লাল৷ আরও ৪০ মিনিট হাঁটার পর দূরে নামচে বাজার দেখতে পেলাম৷ তখন সূর্য মাথার উপর থেকে সরতে শুরু করেছে৷ দূরে নামচে বাজার, অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম৷ পাহাড়ের এতটা উচ্চতায় এমন একটা শহর কে বানাল, ভাবতেই কেটে গেল অনেকটা সময়৷ নামচে বাজার আয়তনে খুব ছোট হলেও একেবারে বড়ো শহরের মতো৷ বাজার, হোটেল ব্যাংক-সহ সমস্ত রকমের সুযোগ সুবিধা এই নামচে বাজারে রয়েছে৷ সেই রাতের জন্য একটা টি হাউস (ট্রেক রুটে থাকার আস্তানাকে বলা হয় টি হাউস/ হোমস্টে) ঠিক করে ফেললাম৷ থাকার খরচ দিন প্রতি ১০০ টাকা৷ খাওয়ার খরচ আলাদা৷ আরও পড়ুন-ক্যানভাসে বৃষ্টির রাত, প্রহর জাগে ১৪ ফেব্রুয়ারি
ফাকডিং থেকে নামচে বাজারের মধ্যেকার উচ্চতা ১ হাজার মিটার৷ পর্বতারোহণে এলে এসব জায়গায় সাধারণত ২ দিন থাকা উচিত৷ উচ্চতা জনিত সমস্যার সঙ্গে যুঝে নিতে যে প্রতিরোধ ক্ষমতা দরকার তা দুদিনে সামান্য হলেও তৈরি হয়৷ সেই কারণে এই নিয়ম৷ আমরা কিন্তু নিময়টা ভাঙি ৷ সেই রাতটা কাটিয়ে পরদিন সকালে উপরের দিকে উঠে যাই৷
পরের দিন বেরিয়ে পড়লাম নামচে বাজার থেকে৷ আবার সিঁড়ি দিয়ে রাস্তা উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে৷ কিছুটা ওঠার পরেই রাস্তা ফের সমান হয়ে গেল৷ ডানদিকে অনেক নিচে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ইজমাখোলা৷ ঘণ্টাখানেক ওঠার পর একটা বাঁক ঘুরেই প্রথমে এভারেস্ট (Everest Base Camp) দর্শন হল৷ দূরের ঝকঝকে নীল আকাশের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে এভারেস্ট ও লোৎসে৷ বিপরীতে আমাধবলম৷ দু’দিকে দুই পাহাড়শ্রেণী দৃশ্যমান৷
আরও কিছুটা যাওয়ার পর ধীরে ধীরে নিচের দিকে নামতে শুরু করলাম৷ এবারের গন্তব্য তেংবচে (Tengboche)পাহাড়৷ কিন্তু সেখানে যেতে গেলে ৬০০ মিটার নিচে ইজমাখোলার সেতু পেরোতে হবে৷ সরু রাস্তা ধরে নিচের দিকে নেমে চললাম৷ অনেকটা সময় লাগল৷ মাঝে কিছু ছোট গ্রাম দেখা গেল৷ তিন চারটে বাড়ি নিয়ে তৈরি৷ কিছুক্ষণ পর এসে পৌঁছালাম ইজমা খোলার ধারে৷ সামনেই সেতু৷ সেতুর দু’পারে অনেক খাবারের দোকান৷ দেরি হয়ে যাবে ভেবে এবারেও দুপুরের খাবার এড়িয়ে গেলাম৷ সেতু পেরিয়ে খাড়া রাস্তায় উপরে উঠতে থাকলাম৷ এই ওঠাটা অনেক কষ্টকর৷ বহুবার থেমে জল খেয়ে বিকেল পাঁচটা নাগাদ পৌঁছালাম তেংবচের উপরে৷
এখানে দুটো বড়ো টি-হাউস আছে৷ হাতে সময় থাকলে দিবচে গিয়ে থাকতাম৷ সেই জায়গা আর একটু নিচে, তুলনায় অনকে সস্তাও৷ কিন্তু একবেলা অভুক্ত থেকে আর শরীর দিচ্ছিল না৷ সন্ধেও হয়ে গেল৷ তাই এখানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম৷ তেংবচে প্রাচীন মনাস্ট্রির জন্য বিখ্যাত৷ বিকেলের বাকিটা সময় মনাস্ট্রি ঘুরে কাটিয়ে দিলাম৷ লামার সঙ্গে অনেক গল্প হল৷ লামা জানালেন, মনাস্ট্রির পুরোনো পুঁথিতে ইয়েতির আগমনের কথা তিনি পড়েছেন৷ এক কালে এখানে ইয়েতি আসত৷ কিন্তু এখন সেসব শুধু গল্পকথা৷ পরের দিন সকালবেলা তেংবচে থেকেও খুব সুন্দর এভারেস্ট (Everest Base Camp) দর্শন হল৷ বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গকে মানসচোখে দেখার অনুভূতিটাই অন্যরকম৷ অবশ্য যত দেখছি, তত নেশা চেপে যাচ্ছিল, কত তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছাব, তাই নিয়ে ভিতরে ভিতরে উত্তেজনা টের পাচ্ছিলাম৷
পরের দিন সকালে তেংবচে থেকে বেরিয় পড়লাম৷ জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে ফের নিচে নামতে হবে৷ এই জঙ্গল একটু অন্যরকম “লর্ড অফ দ্য রিং” ছবির rivendell জঙ্গলের মতো৷ জঙ্গল শেষে নদীর ধারে এসে পৌঁছালাম৷ দেখলাম নদী পারাপারের সেতুটা ভাঙা৷ সামনের পথরেখা দেখে বুঝতে পারলাম আমাদের আগের অভিযাত্রীরা এই পথেই এগিয়ে গেছে৷ একটু চলার পরে দেখতে পেলাম অস্থায়ী সরু সেতু৷ যার চেহার দৈন্যদশাগ্রস্ত৷ ওই সেতু পেরিয়ে ফের উপরের দিকে ওঠা৷ এই সময় ডানদিকে ফের আমাধবলম দেখা দিল৷ এতক্ষণ আমাধবলমের পাদদেশ দিয়েই হাঁটছিলাম, তাই চোখের আড়ালে ছিল তার রূপ৷ ফের সেতু পেরিয়ে উপরে উঠতে থাকায় আমাদের চোখে ধরা দিল৷ এবার দূরে পাংবচে গ্রাম দেখা গেল৷ নদীর অপর প্রান্ত থেকে আমাদবালম যেন পাংবচেকে দু’হাতে আগলে রেখেছে৷
সোজা রাস্তা লোয়ার পাংবচে যাচ্ছে৷ আমরা উপরের পথ ধরলাম৷ কারণ পুরোনো পাংবচে গ্রাম দেখতে হবে৷ সেটির অবস্থান উপরেই৷ গ্রামটি খুবই পুরনো৷ একটি ছোট মনাস্ট্রি ছাড়াও গ্রামে প্রবেশ ও প্রস্থানে মুখে বেশকিছু স্তূপ (এখানেই থাকে লামাদের চিতাভস্ম) রয়েছে৷ এদিনও দুপুরের খাবার খেলাম না৷ পাংবচে পেরোবার পর অদ্ভুতভাবে ল্যান্ডস্কেপ বদলে যেতে লাগল৷ কোনও গাছপালা নেই আশপাশে৷ বেশ খানিকটা ব্যবধানে এক হাঁটু সমান ছোট ঝোঁপের সারি দৃশ্যমান৷ কিছু ঝোঁপে সুন্দর বনফুলও ফুটে আছে৷ এখানে ঠিক রাস্তা বলতে কিছু নেই৷ যেন একটা ফাঁকা জায়গার মধ্যে থেকে হেঁটে গেলেই হবে৷ মাঝে মাঝে ছোট বড়ো পাথর পড়ে রয়েছে৷ পাহাড়ের ওপ্রান্তে ছোট বড় হিমবাহ দেখা যাচ্ছে৷ যেখান থেকে জল এসে মিশছে ইজমাখোলায়৷ এখানেই রয়েছে ছোট্ট গ্রাম সোমরে৷ এই সোমরে থেকে কিছুটা এগিয়ে রাস্তা দু’ভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে৷
আমাদের যেতে হবে ডানদিকের রাস্তা ধরে ডিংবচের দিকে৷ এই সময় আমার শরীরটা খারাপ করতে শুরু করল৷ ডিংবচে যেতে গেলে ইজমাখোলার উপরের আরও একটি সেতু পেরোতে হয়৷ এই সেতুর পাশে এসেই বমি করে ফেলি৷ শরীর খারাপ লাগায় সেতু সিঁড়িতেই বেশ কিছুটা সময় বসে থাকি৷ সুব্রত কিছুটা আগে হাঁটছিল সেদিন৷ ও এতক্ষণে ডিংবচে পৌঁছে আমার জন্য অপেক্ষা করছে৷ মাথার উপরে তাকিয়ে হঠাৎ মেঘের আনাগোনা দেখে আমি আবার হাঁটা লাগালাম৷ বুঝতে পারছিলাম মাথা ঘুরছে, পা এলোমেলো পড়ছে৷ মেঘ এসে যাওয়ায় দৃশ্যমানতা ছিল না বললেই চলে৷
হয়তো পড়েই যেতাম৷ সেই সময় দু’জন সুইস ক্লাইম্বার ছিলেন আমার পিছনে৷ ওঁরা বেশ কিছুক্ষণ ধরেই আমায় লক্ষ্য করছিলেন৷ ততক্ষণে অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে৷ ওই দু’জনে আমায় ধরে ধরে ডিংবচে পর্যন্ত নিয়ে এলেন৷ পথে জানালেন, আমার এএমএস (অ্যাকিউট মাউন্টেনিং সিকনেস)হয়েছে৷ আমাকে ডেক্সামেথাসন নামের একটা ওষুধ খেতে হবে৷ অন্তত দু’রাত ডিংবচে-তে থাকার পরামর্শ দিলেন৷ সেই রাতটা শারীরিক অস্বস্তিতে কাটল৷ কিন্তু পরের দিন ঘুম ভাঙলে দেখলাম বেশ ফ্রেশ লাগছে৷ সেদিনটা ডিংবচেতে থেকে গেলেও চারপাশটা ঘুরে দেখলাম৷ কিছুটা দূরে চুখুং নামের একটা গ্রাম রয়েছে৷ সেখান থেকে ঘুরে ফের ডিংবচে-তে ফিরলাম৷ চুখুংয়ে তিন চারটি হিমবাহের মুখ রয়েছে৷ এই গ্রামে প্রচণ্ড ঠান্ডা৷ দু’রাত থাকায় শরীরে অনেকটাই সুস্থতা অনুভব করলাম৷
পরদিন লবুচের উদ্দেশে রওনা দিলাম৷ এবারের রাস্তা পাহাড়ের উপর দিয়ে৷ এখানে কোনও গাছপালা নেই৷ চারদিকে শুধু পাথর আর পাথর৷ বাঁদিকে তাবুচে, চোলাসে, আরাকমতাসের পিক গুলো দেখা যাচ্ছে৷ আরও কিছুটা দূরে চোলা লেকের নীল জলও দৃশ্যমান৷ এবার এসে পৌঁছলাম বিশ্বের সর্বোচ্চ হিমবাহ কুম্ভর মুখে৷ হিমবাহটির একেবারে মুখের সামনে ছোট সেতু৷ সেটি পারাপার করেই গেলাম ওপারে৷ দুটি ছোট বাড়ি, জায়গাটির নাম দুগলা৷ এখানে আমরা খাওয়াদাওয়া সারলাম৷ এবার চড়াই ভাঙতে হবে৷ এখনও পর্যন্ত এবারই সবথেকে কঠিন চড়াইয়ের সামনে পড়লাম৷ খুব ধীরে ধীরে একেকটা পা ফেলে উপরের দিকে উঠে গেছি৷ প্রায় একঘণ্টা চলার পর মাথায় এসে পৌঁছলাম৷ সেখানে পৌঁছে দেখি পর্বতারোহীদের অনেকেই শুয়ে বসে আছেন৷ পথ ক্লান্তিতে আমরাও প্রায় ৪০ মিনিটের মতো বসে থাকলাম৷
এবারের গন্তব্য লাবুচে, তখন দূরে দেখা যাচ্ছে৷ এখানে রাস্তা বলে কিছুই নেই৷ শুধু পাথর, তার উপর দিয়ে পা ফেলে চলতে হবে৷ পায়ে যেন কোনওভাবে আঘাত না লাগে৷ ডানদিকে রয়েছে কুম্ভ হিমবাহের জমা করা মাটির ঢিপি৷ আর লাবুচে পিক৷ কিছুক্ষণ পরে লাবুচে-তে পৌঁছে গেলাম৷ এখানে থাকার ব্যবস্থা খুবই কম৷ কিন্তু দুগলাতে আগেই পরিচয় হওয়া একটি গ্রুপ আমাদের জন্যে ঘরের বন্দোবস্ত করায় কোনও সমস্যা হয়নি৷ আমাদের পরেও যারা এসেছিল, তাদেরকে রান্নাঘরে রাত কাটাতে হয়৷
সারাদিনের প্রচণ্ড ধকলের পর লাবুচের রাত কাটল গভীর ঘুমে৷ পরের দিন দেখব এভারেস্ট বেস ক্যাম্প, তাই একটা নিশ্চিন্ত ভাবও ছিল, তাতে বেশ শান্তির ঘুম হয়েছে৷ বেলা করে ঘুম ভাঙতে দেখি সবাই বেরিয়ে পড়েছে৷ আমরাও হাঁটা শুরু করলাম৷ রাস্তা আগের দিনের মতোই৷ এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য শুধু দু’চোখ ভরে দেখতে হয়, বর্ণনার ভাষা নেই৷ ডানদিকে কুম্ভ গ্লেসিয়ারের ঢিপির পিছনে নুপসে কোংমা পিক দেখা যাচ্ছে৷ বাদিকে লাবুচে-র পিকগুলো৷ আর সামনে পুমোরি৷
অনেকটা যাওয়ার পর আবার চড়া ভাঙার পালা এল৷ সেই পথটুকু পেরিয়ে যেতেই চোখের সামনে কুম্ভ হিমবাহ৷ ছোটবেলায় ভূগোল বইতে পড়েছিলাম হিমবাহ, আজ তাকে প্রত্যক্ষ করলাম৷ লক্ষ লক্ষ বছর ধরে জমে থাকা বরফ ধুলো পড়ে কালো হয়ে গেছে৷ কোথাও কোথাও সেই বরফের আস্তরণ ভেঙে ঝকঝকে সাদা বরফ বেরিয়ে পড়েছে৷ সেই জলে তৈরি হয়েছে সবুজ পুকুর৷ এখানে কুম্ভের সঙ্গে মিশেছে আরও একটা গ্লেসিয়ার৷ সেটি পেরোলেই গোরাকশেপ৷ গ্লেসিয়ার পেরোতে এমনকিছু অসুবিধা হয়নি৷ ডানহাতে স্বতন্ত্র চেহারা নিয়ে দৃশ্যমান মাউন্ট এভারেস্ট৷
গোরাকশেপে পৌঁছে দুটো থাকার আস্তানা পেলাম৷ প্রথমটায় উঠলাম৷ ব্যাগপত্র রেখে মধ্যাহ্নভোজের পর বেসক্যাম্পের (Everest Base Camp) দিকে যাত্রা শুরু হল৷ প্রথমে লেকের ধার দিয়ে গেলাম৷ তারপর গ্লেসিয়ারের ধার বরাবর হাঁটতে লাগলাম৷ ডানদিকে কুম্ভ গ্লেসিয়ার দেখতে পেলেও এভারেস্ট ততক্ষণে নুপসের পিছনে আত্মগোপন করেছে৷ ডানদিকে পাহাড়ের গায়ে ঝুলে থাকা পাথরগুলো বড়ো বিপজ্জনক৷ এই বুঝি গড়িয়ে পড়ল গায়ে৷ দূরে দেখতে পাচ্ছি, গ্লেসিয়ারের মধ্যে কিছু তাঁবু পাতা আছে৷ ওটাই হয়তো বেস ক্যাম্প ( Everest Base Camp) ৷ কুম্ভ গ্লেসিয়ারের সবথেকে সুন্দর জিনিস হল, কুম্ভ আইসফল৷ এটাই হয়তো হিমবাহের উৎস৷ আমরা যখন যাচ্ছি, তখন অনেকেই ফিরে আসছে৷
একটা সময় রাস্তা গ্লেসিয়ারের মধ্যে নেমে গেল৷ এইবার আর কোনও সঠিক রাস্তা নেই৷ আমরা দেওরালি(আকার অনুযায়ী সাজানো বড়ো পাথর, ছোট পাথর, একেবারে মাথায় ছুঁচালো পাথর৷ সেটির মুখ যেদিকে থাকবে, সেদিকেই গন্তব্য) লক্ষ্য করে এগোতে লাগলাম৷ সামান্য দূরে দেখলাম জনা পাঁচেক অভিযাত্রী ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছেন৷ পৌঁছে গেলাম এভারেস্ট বেস ক্যাম্প (Everest Base Camp) ৷ কিন্তু বিভিন্ন কারণে বেশিক্ষণ গ্লেসিয়ারের উপরে থাকা গেল না৷ ঠাণ্ডায় হাঁটু পর্যন্ত জমে যাচ্ছে৷ অল্প অল্প বরফ পড়ছে৷ দৃশ্যমানতা ধীরে ধীরে কমে আসছে৷ বাকিরা ততক্ষণে রওনা দিয়ে দিয়েছে৷ কারণ বেলা বাড়লে বেস ক্যাম্পের (Everest Base Camp) আবহাওয়া বদলে যেতে থাকে৷ যা পর্বতারোহীদের জন্য উপযুক্ত নয়৷ ততক্ষণে আমরা ছবি তুলতে শুরু করেছি৷ এক রাশিয়ান বেস ক্যাম্প পৌঁছে সিগারেট ধরিয়ে চারদিকটা দেখতে শুরু করল৷ ফেরার সময় শুরু হল ঝড় সঙ্গে তুষারপাত৷ শরীর ক্রমশ ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল৷ তবে আধঘণ্টার বেশি এই দুর্যোগ স্থায়ী হল না৷ দিনের বেলাতেই অন্ধকার নেমে এসেছে৷ রীতিমতো হেড ল্যাম্প জ্বালিয়ে গোরাকসেপে ফিরে আসি৷
পরের দিন কালা পাথারে চড়লাম৷ থেকে এভারেস্ট ও বেস ক্যাম্পের (Everest Base Camp) ঝকঝকে ভিউ পাওয়া যায়৷ কিন্তু মেঘলা আকাশ আমাদের সেই দৃশ্য দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করল৷ এবার ফেরার পালা৷ নামতে থাকি, দুগলা পর্যন্ত নেমে ডিংবচের দিকে না গিয়ে পেরিচে চলে আসি৷ সেদিন রাত কাটাই ফাংবচে-তে৷ তারপরের দিন নামচে বাজার৷ তারপর লুকলাতে চলে এলাম৷ আসা যাওয়ার পথে মোট পাঁচটি দিন আমরা বাঁচিয়ে ফেলেছি৷ বেস ক্যাম্পে যাওয়ার পথে দুদিন কম সময় নিয়েছি৷ তিনদিনে ফেরার রাস্তা টপকে এলাম৷ আসলে কোনও জায়গা থেকে ফরাটা সহজই হয়৷ কারণ ততক্ষণে পথ চেনা হয়ে গেছে৷ আর চড়াই ভেঙে কাহিল শরীর উতরাই দেখলে চনমনে হয়ে ওঠে৷ তাইতো তাড়াতাড়ি নিচে নামা যায়৷ আমাদের ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হয়নি৷ মোট ১০ দিনে এভারেস্ট বেস ক্যাম্প (Everest Base Camp) ঘুরে সমতলে ফিরে আসি৷
1 thought on “Everest Base Camp: সাগরমাথার পাদদেশে”
Eshita karmakar
(17th সেপ্টেম্বর 2021 - 9:14 অপরাহ্ন)I can feel the enjoyment and excitement by reading this vlog what you felt during this trip…..
Lots of love and and eagerly waiting for your next vlog .