রিমি
যুগ যুগ ধরে বাঙালি মেতে ওঠে তার প্রাণের উৎসব দুর্গাপুজোয় (Durga Puja)৷ যুগের পরিবর্তন, সময়ের অভাবে পুজোর অনেক বিধি নিয়মে বদল এসেছে। উদযাপনে এসেছে বিস্তর ফারাক। তবুও দু্র্গাপুজোর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বাঙালির সেন্টিমেন্ট এতটুকুও ফিকে হয়নি৷ কর্পোরেটের বিজ্ঞাপন, স্পনসরশিপের মতো বাণিজ্যিক শব্দবন্ধ আজ দুর্গাপুজোর অঙ্গ। সবচেয়ে বড় ঠাকুর থেকে শুরু করে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে সেরা হয়ে ওঠার লড়াই।
চিন্তাভাবনায়, সৃজনশীলতায় কোন পুজো কতটা উচ্চমানের, কোন পুজো দেখতে মানুষ বেশি ভিড় জমাচ্ছে, ভিড়ের মধ্যে থেকে আঁচ করে নেওয়া মাথার সংখ্যা কাদের বেশি, কোন পুজো পেল সেরার শিরোপা, এগুলোই নতুন ট্রেন্ড। যদিও করোনাকালে মানুষ তাও হারিয়েছে। অনলাইন বা ভার্চুয়াল পুজোয় গিয়ে ঠেকেছে। তবে আজ থেকে দু’শো বছর আগে দুর্গাপুজো একেবারেই এমনটা ছিল না।
Durga Puja: দুর্গাপুজোর সূচনা কাল
বাংলায় ঠিক কবে দুর্গাপুজো (Durga Puja) শুরু হয়েছিল তা নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে৷ সঠিক তথ্যও সেভাবে পাওয়া যায়নি৷ ইতিহাস বলছে আনুমানিক ১৫০০ শতকের শেষের দিকে বাংলায় প্রথম দু্র্গাপুজো শুরু হয়। সম্ভবত, দিনাজপুর-মালদার এক জমিদার স্বপ্নাদেশ পেয়ে পর পারিবারিক ভাবে দুর্গা পুজো প্রথম শুরু করেছিলেন। আবার শোনা যায় সপ্তদশ শতকের গোড়ার দিকে উত্তরবঙ্গের রাজশাহি জেলার তাহিরপুর অঞ্চলের রাজা কংসনারায়ণ দুর্গার আরাধনা শুরু করেন।
কারও মতে, মনুসংহিতার টীকাকার কুলুকভট্টের পিতা উদয়নারায়ণের হাত ধরেই প্রথম দুর্গাপুজোর (Durga Puja) সূচনা হয়েছিল৷ পৌত্র কংসনারায়ণ তা অনুসরণ করেন। ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, আজ থেকে দুশো বছর আগে দুর্গাপুজোর আয়োজন হতো আরও ধুমধাম করে। তখন ছিল তোষামোদের পুজো। ব্রিটিশ শাসনকালে ইংরেজদের তোষামোদে রাখতে দুর্গাপুজোকে প্রচারের আলোয় নিয়ে আসেন জমিদাররা। প্রায় সমস্ত জমিদার বাড়িতেই ঘটা করে দুর্গাপুজোর আয়োজন হতো। আড়ম্বরের কোনও খামতি থাকত না৷ খাওয়াদাওয়ার এলাহি আয়োজন থেকে এবং নানা রকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, তখনকার দুর্গাপুজোর মেনুতে সবই হাজির। আরও পড়ুন-রাত পোহালেই দেবীপক্ষ, দুর্গা ফিরছে দূর গাঁয়…
যিনি আয়োজনে তাক লাগিয়ে দিতেন, তিনিই ইংরেজদের চোখে সেরা হয়ে উঠতেন। সেকালে জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজোর উৎসবে মেতে ওঠার জন্য ইংরেজরাও বছরভর অপেক্ষা করে থাকত। গ্রাম বাংলার মেয়ে, বউরা পুজোর আগে বেসন দিয়ে মাথা ঘষতেন, ত্বকে লাগাতেন ময়দা, জাফরানের মিশ্রণ। নীল দেওয়া নতুন তাঁতের কাপড় পরত ছোট ছোট ছেলে, মেয়েরা। দেনা, পাওনা মিটিয়ে নেওয়ার জন্য দুর্গাপুজো (Durga Puja) এবং চড়কের মতো শুভ দিনগুলিকে বেছে নেওয়া হত। মিষ্টিমুখের রেওয়াজ সেসময়ও ছিল।
জমিদার বাড়িগুলিতে দেশ,বিদেশ থেকে সুন্দরী নর্তকী ও গায়িকাদের বায়না করে আনা হত৷ সন্ধেয় বসত আসর। রণ পা’য় চড়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন, মাঝেমধ্যে সুরাপান, জমিয়ে তাস খেলার ব্যবস্থা৷ কার বাড়িতে কত বড় ও সুন্দর ঝাড়লণ্ঠন আর দামি কারণবারির আয়োজন হয়েছে, তানিয়েও জমিদার বাড়িগুলির মধ্যে চাপা প্রতিযোগিতা চলত৷ সেই অনুযায়ী জমিদার বাড়ির দর বাড়ত। প্রতিমার (Durga Puja) জন্য নিত্য নতুন সোনার গয়না, দামী রত্নের মুকুট থেকে শুরু করে, ঘটা করে হাজার হাজার লোক খাওয়ানো, কিছুই বাকি ছিল না। আরও পড়ুন-কাশের বনে লাগল দোলা, উমা আসে বাপের বাড়ি…
শোনা যায়, একবার নাকি কলকাতায় শোভাবাজারের নবকৃষ্ণের রাজবাড়িতে এমন ঘটা করে পুজো (Durga Puja) হল, যে লোক তাকে ফিস্ট বলে ধন্য ধন্য করতে লাগল৷ সাহেবদের মনোরঞ্জনের জন্য পুজোর দিনগুলোয় মুর্শিদাবাদ, লক্ষ্ণৌ থেকে জমিদার বাড়িতে আনা হত বাঈজিদের৷ প্রায় ৩০ দিন ধরে চলত দুর্গাপুজোর উৎসব।
তবে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুর সময়ে এই চিত্র পাল্টাতে থাকে। ব্রিটিশ শাসনের শৃঙ্খলমুক্ত হতে তখন চারিদিকে উঠেছে ইংরেজ হটাও রব। এই সময়ই জমিদার বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে, সমাজের শ্রেণীবিভাজনকে দূরে সরিয়ে দুর্গাপুজো (Durga Puja) হয়ে ওঠে সর্বজনীন৷ ১৭৯০ সালে গুপ্তিপাড়ার ১২ জন বন্ধু বা ইয়ার মিলে প্রথম সর্বসাধারণের দুর্গাপুজোর সূচনা করেন৷ সেই থেকেই বারোয়ারি পুজোর প্রচলন। সম্ভবত সনাতন ধর্মতসাহিনি সভার উদ্যোগে বাগবাজারে প্রথম সর্বজনীন দুর্গোৎসবের সূচনা হয়। আরও পড়ুন–ঢাকের বাদ্যি ডাকের সাজ, উমা এল ঘরে…
কালের নিয়মে জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজোর আয়োজনে অনেক সঙ্কোচন হয়েছে৷ সেই জাঁকজমক আর দেখা যায় না৷ বরং ঠাঁটেবাটে এখন বাড়ির পুজোকে টেক্কা দিচ্ছে বারোয়ারি পুজোগুলি৷ আগামী আবার দুর্গাপুজোকে (Durga Puja) ঘিরে ঠিক কোন ধরনের বিবর্তন দেখাবে, তা আগে থেকে আঁচ করা বড়োই মুশকিল৷ তবে এই দেখনদারির মাঝে মায়ের আগমনের আনন্দে কোন ভাটা পড়বে না তা বলাই বাহুল্য৷ রাজা আসে রাজা যায়, শরৎকালে মা দুর্গার আগমন অবিচল থাকে৷ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে উমার আরাধনায় সব দুঃখ ভুলে চারটি দিন মেতেওঠে আপামর বঙ্গবাসী৷