এবং রূপকথা
মন খারাপের কোনও নির্দিষ্ট দিন হয় না, মুহূর্ত হয়। কখন সে হানা দেবে আগের থেকে বোঝা বড় মুশকিল। হাসিখুশি দিলদরিয়া সাহেবের এমন চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছেন না কেউই। যাঁরা ‘চন্দননগরের মাল’ বলে তাঁকে নিয়ত উপহাস করেছেন, কোথাও গিয়ে তাঁদেরও আজ কষ্ট হচ্ছে। তাপস পাল শহুরে যুবকের নয়, বাংলার হিরো। একটা মাত্র দুর্বাক্য কেদার চাটুজ্জের প্রতি বাঙালির চোরা টানকে ঘৃণায় পরিণত করেছিল। কতটা পরিশীলিত অভিনয় তানিয়ে আলোচনা প্রায় বন্ধ। সবাই তখন তাঁর মুণ্ডুপাত করে চলেছেন। আসলে আবেগ তো বাঙালির সম্বল, সেখানে পড়েছে খোঁচা। মধ্যবিত্তের ভীরু প্রেমের নায়ক কিনা অশালীন হুমকি দিচ্ছেন।
ভালবাসায় ছেদ পড়েছিল, কেদারের বদলে যাওয়া নিতে পারেনি বাঙালি। যে আদরে যত্নে সাহেবকে আগলে রেখেছিল, সেই আদর তিরস্কারে রূপ নিয়েছিল মুহূর্তে। গোলাপের পাপড়ি ছোঁয়ানো পথ কীভাবে কাঁটায় ভরে যেতে পারে তা জীবিতাবস্থাতেই টের পেয়েছেন তাপস পাল। রাজনীতি তাঁকে অনেক দিলেও কে়ড়েছে প্রচুর। আর ভালবাসার তো কোনও পরিমাপ হয় না। হয় না মূল্যায়ণও। ক্ষমা চেয়েও সেই ঘৃণার পরিসরকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সরাতে পারেননি। তাই সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর মৃত্যুর খবর সংক্রান্ত কোনও তথ্য এলেই সমবেদনা, শ্রদ্ধার সঙ্গে কমেন্ট বক্সে উপচে পড়েছে বক্রোক্তি। তবে মৃত্যু তো চীরন্তন, তার কোনও অলসতা নেই, নেই ছেদও। কেওড়াতলা মহাশ্মশানে পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গিয়েছে তাপস পালের নশ্বর শরীর। এই শেষবেলাতেও আত্মীয় পরিজন, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী, অগুন্তি অনুরাগীকে কাঁদিয়ে গেলেন তিনি। আরও পড়ুন-মধ্যবিত্ত বাঙালির ভীরু প্রেমের নায়ক, জীবননাট্যের শেষ অংকে মহুয়ার দেশে তাপস পাল
অভিনেতা মানেই জনগণের কাছে প্রিয় মানুষ। কারোর প্রিয় নায়ক, কারোর বা ক্রাশ। কিন্তু সেই অভিনেতাও ঘৃণার পাত্র হতে পারেন। যার ব্যপ্তি এমন বিস্তৃত তা আগে আর কজন দেখেছেন। আজ ভালবাসা আর ঘৃণা যেন হাত ধরাধরি করে চলল। সকাল থেকে আকাশের মন খারাপ, প্র্কৃতিও কেমন যেন থমকে আছে। বসন্তের সেই উচ্ছ্বলতা নেই, রোদ্দুরও কেমন ম্রিয়মান। বেলা গড়িয়ে কখন যে দ্বিপ্রহর হল ঠিক বোঝা গেল না। উত্তমকুমারের মুন্সিয়ানা তাঁর ছিল না, তাই শহুরে দর্শকের প্রিয় নায়ক কখনওই হয়ে উঠতে পারেননি। থেকে গিয়েছেন মধ্যবিত্ত বাঙালির পাশের বাড়ির ছেলে হয়ে। তারপর দিন আনি দিন খাই পরিবারের দায়িত্ববান দাদা। এমন কাছের মানুষের মৃত্যুতে যে আলোচনা হবেই। সেই আলোচনা বৈঠকখানার চৌকাঠ পেরিয়ে হেঁশেলে ঢুকবে। পল্লী বাংলার পুকুরঘাটে এই অবেলাতেও ভিড় জমবে। সেখানেও উঁকি মেরে যাবে সাহেব। বিকেলের চায়ের আড্ডায় বছর চল্লিশের বাঙালি স্মৃতিতে শান দিতে কেদার চাটুজ্জেকে মনে করবেন। এসবের ফাঁকে অপ্রিয় স্মৃতিও ভিড় করে।
মরে যেন শিক্ষা দিয়ে গেলেন তাপস পাল। নিজেও যথেষ্ট শিক্ষা পেয়ে গেলেন। মুখে লাগাম না থাকলে কী হতে পারে তা হাড়েহাড়ে টের পেয়েছেন। সিনেমার অঙ্গনে রাজনীতি যে কীভাবে কালসাপের মতো বেড়ে ওঠে জীবন দিয়ে উপলব্ধি করতে হল। উদাহরণ রেখে গেলেন টলিপাড়ার সামনে, লাইট ক্যামেরা অ্যাকশনের সঙ্গে রাজনীতির সখ্যতা হতে পারে না। সমান্তরালে চলাও বেশ ঝক্কির। চলচ্চিত্র মানেই জনগণের কাছে স্বপ্নের দেশ। মনের মাধুরি মিশিয়ে অনুরাগী তার প্রিয় নায়ককে দেখতে থাকে, রাজনীতির ময়দান যখন সেই মাধুরীতে কাদা ছিটিয়ে মলিন করে। তখনতো পোশাক খুলতেই হয়, বেরিয়ে পড়ে কদর্য চেহারা। সেই চরম আঘাত তিল তিল করে গড়ে তোলা শৈল্পিক মাধুর্যকে ভেঙে খান খান করে দেয়। তখন কেদার চাটুজ্জে নয়, সবকিছুর ঊর্ধ্বে চলে যাওয়া তাপস পালের এপিটাফ লেখে ‘চন্দননগরের মাল’। আরও পড়ুন- ক্যানভাসে বৃষ্টির রাত, প্রহর জাগে ১৪ ফেব্রুয়ারি
এ যেন প্রিয় কবির বিয়োগান্তক উপন্যাস। যেখানে গল্পের নায়ক ভাগ্য বিড়ম্বিত, আচমকা মৃত্যু তাঁকে সহানুভূতিতে ডোবালেও কোথাও যেন পাঁকের গন্ধ জেগে থাকে। সেই পাঁক ঠেলে একদিন পদ্ম পাপড়ি মেলবে। কেদার, সাহেবের হাত ধরে তাপস পাল থেকে যাবেন স্মৃতিতে। তাঁর নতুন বাড়ির ঠিকানাটা তো নেওয়া হয়নি।