শুক্রবার মানেই বক্সঅফিসে নতুন ছবি, সিনেমা পাড়ায় তোরজোর। হলের সামনেও দর্শকদের উঁকিঝুঁকি, কী পোস্টার পড়ল, কটার শো, এমনই কত কি। তবে রক্সির তাতে হেলদোল নেই। আজ থেকে আর খুলবে না ধর্মতলার শতাব্দী প্রাচীন সিনেমা হল রক্সি। আধুনিকতার গ্রাসে সিঙ্গল স্ক্রিন রক্সিও ইতিহাস হয়ে গেল। আজ শুক্রবার, একটা সময় নতুন ছবি দেখার জন্য কলেজের ছেলেমেয়েদের জটলা থাকত রক্সির সামনে। আরও পড়ুন- ৬৯-এই পূর্ণচ্ছেদ! না ফেরার দেশে বাংলা ছবির ‘রাজা’
জটলাই বলব, তখন তো আর বুক মাই শো-তে টিকিট কাটার সুযোগ ছিল না। লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে যদি হাউসফুলের কোপে পড়ে বোকা বনতে হয়, তার থেকে আগেভাগে টিকিট কেটে রাখি। এমনটাই ভাবতো নয়ের দশকের তরুণতুর্কিরা। ধর্মতলা ছিল সে যুগের উঠতি প্রেমের মুক্তাঞ্চল। উত্তর কলকাতার ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে এখানেই সিনেমা দেখতে আসত। দক্ষিণও তাই। বাড়ির থেকে বেশ দূরে চট করে বড়দের নজরে পড়ার ভয় নেই।
আসলে সেই সময়ের তরুণ প্রজন্মের পকেটমানি কনসেপ্ট তখনও তেমন জাঁকিয়ে বসেনি। টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে, বাড়িতে যদি দাদু ঠাকুমা, নিদেন পক্ষে একমাত্র কাকা কিম্বা মা। এসব স্নেহচ্ছায় থেকেই দু দশটাকা যা বরদান জুটত তাই জমিয়েই প্রায় লুকিয়ে সিনেমা দেখা। সেই সময় রক্সির টিকিটের দাম ১০-১৫ টাকার বেশি ছিল না। সবমিলিয়ে চলে যেত ভালভাবেই। সঙ্গে পপকর্ন, চা আবার ধূমপানও। এমনটাই জানালেন সমরজিৎ সরকার রায় মহাজন। তিনি দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা, কর্মূসত্রে এখন শহর ছেড়ে অনেকটা দূরে। কিন্তু রক্সি বন্ধ হওয়ার খবরে একটু হলেও নস্টালজিক হয়ে পড়লেন সেদিনের তরুণ।
জানালেন, শীর্ষেন্দু নামের এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে ছয়জনের দলে রক্সিতে বহুবার সিনেমা দেখতে এসেছেন। আসলে সেই সময়কার কলেজ পড়ুয়ার পকেটে যে টাকা থাকতো তাতে রক্সিই ছিল বেস্ট। ধর্মতলা চত্বরে তখন অনেকগুলো হল। মেট্রো, গ্লোব, লাইটহাউস, চ্যাপলিন, এলিট ও রক্সি। এরমধ্যে রক্সি ও এলিটেই বেশি হিন্দি ছবি আসত। গ্লোবে, চ্যাপলিনে ইংরেজি সিনেমা। তাই রক্সিই ছিল টার্গেট। সাউথসিটিতে পড়তাম। চার বান্ধবী পড়ত মুরলীধর গার্লসে। আগে থেকে টিকিট কাটা থাকত। তারপর একদিন দলবেঁধে সোজা ধর্মতলা। ট্রাম আর মেট্রো চড়েই বেশি আসা হত। এখনকার মতো পপকর্ণের বাস্কেট নয়, তখন প্লাস্টিকের মধ্যে থাকত পপকর্ণ। তেলচিটে গন্ধমাখা সেই টাইমপাস ছিল কতই না মহার্ঘ্য। আর সিনেমা দেখে ফেরার পথে নিজামের বিফ রোল, কিম্বা বিফ ভুনার সঙ্গে লাচ্ছা পরোটা এখনও জিভে স্বাদ পাই।
নিজামের রোল আর রক্সি সেই সময়কার প্রিয় সমার্থক ছিল। রক্সির একপাশে গরমকালে কাঁচাআম নিয়ে একজন বসতেন। বান্ধবীরা আমমাখা নিয়েই হলে ঢুকতো। রক্সির সঙ্গে সেই কাঁচালঙ্কা বিটনুনের গন্ধটাও কেমন একাত্ম হয়ে গেছে। শাহরুখ কাজল জুটির ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে’, এখানেই দেখা। তালিকায় রয়েছে ‘আন্দাজ আপনা আপনা’র মতো ছবিও। সেসময় প্রকাশ্যে ধূমপান নিষিদ্ধ হয়নি, তবে কলেজছাত্রদের জন্য তো নিষিদ্ধই ছিল। তাতে কী যায় আসে, বাড়ির লোকজন তো আর দেখতে পাচ্ছে না। তাই প্রথম লুকিয়ে বিড়ি খাওয়া এই রক্সিতেই। একেবারে প্রেক্ষাগৃহের মধ্যে বসে, ভাবা যায়!
শুধু সমরজিৎবাবু কেন, বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের আইকন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুও রক্সিতে সিনেমা দেখেছেন। ছবির নাম ‘কিসমত’। ১৯০৮-৯ সালে অপেরা রূপে রক্সির জন্ম হল। তখন নাম ছিল এম্পায়ার থিয়েটার। কালে কালে তাই একদিন রক্সিতে বদলে গেল। কলকাতা পুরসভার বদান্যতায় ৯৯ বছরের লিজে রক্সি হাতবদল হয়েছিল। সময়সীমা ফুরিয়েছে। বহুদিন ধরে লোকসানে চলছিল রক্সি। লিজের পুনর্নবীকরণ না করেও হলের সামনে দোকান বসিয়ে পয়সা কামাচ্ছিলেন মালিক। ২০০৪ থেকেই এই চলছে, বার বার জানিয়েও কোনও ফল হয়নি। তাই বৃহস্পতিবার রক্সির গেটে তালা ঝুলিয়ে দিল কলকাতা পুরসভা।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কলোনিয়াল কলকাতার খোলনলচে অনেকটাই বদলেছে। স্মৃতি বিজড়িত চ্যাপলিন, মেট্রো ও গ্লোব আগেই উধাও হয়েছে। এক দশকের ব্যবধানে কেউ ধর্মতলা চত্বরে এলে একটু চমকে উঠবেন বৈকি। শপিংমল, হাইরাইজে ঢেকেছে ব্রিটিশ স্থাপত্যের শহর। রক্সিও সেই কায়দাতেই তৈরি। তবে আজ থেকে সে কোন নামে চিহ্নিত হল বোঝা যাচ্ছে না। বছর দশেক পর ওই পথে হাঁটতে গিয়ে হয়তো আগামী প্রজন্মকে একদা রক্সির গল্প শোনাবেন। তাতে মিশে থাকবে নিজামের বিফ রোলের রসায়ন, বিটনুন লঙ্কার সঙ্গত, টুকরো হাসি আর লুকিয়ে সিনেমা দেখার নিষিদ্ধ ভাললাগা।