Dal Lake

Kashmir: কাশ্মীর! এক বিভাজিত আখ্যান (চতুর্থ পর্ব)

Sanjucta Sarkar

সংযুক্তা

কাশ্মীরে (Kashmir) ১৯৯০ এর পর বহু জঙ্গি আত্মসমর্পণ করেছিল। তাদের সরকারি রি-হ্যাবে রেখে তারপর একটা শংসাপত্র দিয়ে ছাড়া হয়৷ যেখানে লেখা থাকে এঁরা আত্মসমর্পণ করেছিলেন। বাড়ির দেওয়ালে সেই শংসাপত্র ল্যামিনেট করে টাঙিয়ে রাখা হয়। কখনও কখনও সেনারা এসে দেখে যায়। আর আত্মসমর্পণকারীদের নিয়ম করে লোকাল থানায় গিয়ে হাজিরা দিতে হয়। এঁদের উপরে সেনা-পুলিশ সকলেরই নজর থাকে। কেউ কেউ সেনা মুখবীর হয়ে যায়,  কাউকে আবার সার্টিফিকেট থাকা সত্ত্বেও জঙ্গি কার্যকলাপে লিপ্ত  থাকার অভিযোগে ফের তুলে নিয়ে যায় সেনা।

এর সবই প্রথম জনসমক্ষে এসেছিল ওই কাশ্মীরি  (Kashmir) ভদ্রলোকের দাবিতে। হইচই আরও পড়ে গিয়েছিল, যখন সেই ছ’জনের মৃতদেহ আগ্নেয়াস্ত্র সমেত মিডিয়ার সামনে পেশ করা হয়৷ মৃতদের পরিবারের তরফে অভিযোগ দায়ের হয়৷ জানা যায়, ওই ছয় কিশোর নাকি জঙ্গি তো দূর,  কোনওরকম সরকার বিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত ছিল না। একেবারে সাধারণ মানুষ। এক রাতে ‘ক্যাসোর’ (কর্ডন অ্যান্ড সার্চ অপারেশন) পর ওই ৬ জনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হল ‘জিজ্ঞাসাবাদের’ জন্য। তারপর তারা আর ফেরেনি। পরিবারের তরফে খোঁজাখুঁজি হলেও তাদের হদিশ পাওয়া যায়নি৷ এদিকে টিভিতে বাড়ির ছেলের মৃতদেহ দেখে পরিবারের তরফে থানায় যোগাযোগ করা হয়৷  Kashmir: কাশ্মীর! এক বিভাজিত আখ্যান (তৃতীয় পর্ব) Bangla Magazine – % (bongmag.com)

পরে বিষয়টি নিয়ে সেনাবাহিনী প্রকাশ্যে বিবৃতি না দিলেও মৌনতাও অনেক কিছু জানিয়েছিল। ১৯৯০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে কাশ্মীরে (Kashmir) ট্রান্সফার চেয়ে বহু সেনা আবেদন জানিয়েছিলেন। নানা মানবাধিকার সংস্থার বারংবার হস্তক্ষেপের জেরে এই জঙ্গি সন্দেহে ইচ্ছানুযায়ী ধড়পাকড় ‘কিঞ্চিৎ’ শিথিল হয়েছিল। মনে রাখতে হবে কাশ্মীরে ‘উধাও’ হয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা কিন্তু দশ লক্ষ ছাড়িয়েছে সেই কবেই। কিন্তু সন্ত্রাসের মূল কাণ্ডারীরা আজও ঘুরে বেড়াচ্ছে।


পাকিস্তান কেড়ে নিতে চায় কাশ্মীরকে, (Kashmir) তা বোঝাপড়া তাদের সঙ্গে যেমন কূটনীতির মাধ্যমে হচ্ছে হোক না৷ তবে সাধারণ মানুষের এই নিত্য দুর্ভোগ কেন? পণ্ডিত হোক বা মুসলমান, বিচারের আশায় প্রতিটা মানুষ হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাজনৈতিক দলাদলিতে প্রাণ যাচ্ছে জওয়ানদের। উপরতলার নির্দেশ পালন করতে গিয়ে জনসমক্ষে চক্ষুশূল হচ্ছে, এমনকী প্রাণটাও দিতে হচ্ছে। কী লাভ হচ্ছে, তার উত্তর আজও কারোর কাছে নেই। ওই সেনার কাছেও ছিল না।

সারা ভারত যে রাজ্যকে জঙ্গি তৈরির কারখানা বলে চিহ্নিত করে৷ কিছু হলেই রাজ্যের বাইরে পড়তে আসা ছেলে মেয়েদের রাস্তায় ফেলে মারে৷ সেই ভারতবাসী খবর রাখে না, জানেও না কুপওয়ারা জেলার যমজ গ্রাম কুনান ও পোশপরার কথা। আজ এই ২০২০-তে পৌঁছেও যারা বিচারের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে। বলা হয়, ওই দুটি গ্রামের প্রতিটা ঘর থেকে আজও কান্নার রোল ওঠে৷ কী হয়েছিল ১৯৯৩ এর ফেব্রুয়ারির সেই শীতল রাতে? ক্যাসো চলছিল। ঘরের সমস্ত পুরুষ সদস্যদের টেনে হিঁচড়ে বের করে সামনের এক স্কুলে জমায়েত করা হল। Kashmir: কাশ্মীর! এক বিভাজিত আখ্যান (দ্বিতীয় পর্ব)

আর তারপর? বাড়ির ছোট থেকে বড়ো, মেয়ের সামনে মা, মায়ের সামনে মেয়ে, দিদা, ঠাকুমা একের পর এক নির্মমভাবে ধর্ষিতা হলেন সরকারি উর্দিধারীদের সৌজন্যে। আর ওদিকে স্কুলে আটকে রাখা পুরুষদের উপরে চালানো হল অকথ্য অত্যাচার। তারস্বরে বাজল মাইক৷ মেয়েদের বলা হল, চিৎকার করলেই তাদের পরিবারের পুরুষ সদস্যদের উপরে অত্যাচার বাড়বে৷ বাড়ি আর স্কুলঘর থেকে ভেসে আসা আর্তনাদে সেদিন ইতিহাস কেঁপে উঠেছিল। কোর্ট মার্শালে ধরা পড়ল না কিছুই। সেনার তরফ থেকে বিবৃতি এল, জঙ্গিরা সেনাদের মতো জংলা পোশাকে এই কাণ্ড ঘটিয়েছে। এই বিবৃতিও এসেছিল অনেক পরে। প্রথমে তো গোটা ঘটনাই অস্বীকার করা হয়৷ তবে সুবিচার আজও মেলেনি।



এখনও চলছে সেই মামলার বিচার। সেই নারকীয় রাতের কারণে কুনান ও পোশপরার বেশীরভাগ মেয়ে আজও কুমারী৷ কেউ কেউ প্রজনন ক্ষমতা হারিয়েছেন, ‘ধর্ষিতা’ তকমা অন্তরায় হয়েছে কারোর জন্য। ধর্ষিতার পরিবারের সঙ্গে কারা আর আত্মীয়তা করতে চায় বলুন! এই কুনান-পোশপরার প্রেক্ষাপটেই তৈরি মণিরত্নমের জাতীয় পুরস্কার ও ফিল্মফেয়ার-সহ প্রায় আটটি পুরস্কারজয়ী সিনেমা ‘দিল’৷ এবার বলুন, রাজ্যের বাইরে ও ভিতরে যে মানুষগুলিকে আমরা নিরাপত্তাটুকু দিতে অক্ষম, তাদের কাছ থেকে ঠিক কী আশা করছি? Everest Base Camp: সাগরমাথার পাদদেশে

২০১৬ -র এক রিপোর্টে বেরিয়েছিল ৪৫% যুব সম্প্রদায় মানসিকভাবে আক্রান্ত। কিছুদিন আগেই যাকে ছাড়া হল সেও যে জঙ্গি ছিল না৷ তাঁকে সেনা ‘ভুলবশত’ গ্রেপ্তার করেছিল নয়ের দশকে, আরও একবার প্রমাণিত হল। এরকম কত ক্যাজুয়ালটির দাম একটি রাজ্য কয়েক দশক ধরে চুকিয়ে আসছে, কিসের আশায়? যাতে পাকিস্তানকে শিক্ষা দেওয়া যায়? যাতে আমাদের যাদের নিজের বাড়ির ছাদ মেরামতের টাকা নেই, তাদের কাশ্মীরে জমি কিনতে পারার আশায়? এতকিছুর পরেও কাশ্মীর  (Kashmir) থেকে আইএএস অফিসার, সেনাতে যোগ দেওয়ার মতো ছেলে মেয়েরা বেরিয়ে আসছে। মনে মনে খুশি হচ্ছেন তাই না? আর ভাবছেন, যারা বন্দুক তুলে নিয়েছিল বা নিয়েছে, তাদের মোক্ষম জবাব এই সাদা কলারের চাকরি করা ছেলে মেয়েরা।



ওই শুরুতেই যে বলেছিলাম, এক পরিস্থিতিতে ভিন্ন মানুষের ভিন্ন প্রতিক্রিয়া হয়। আপনারাই বরং ভাবুন এরকমটা আপনাদের সঙ্গে দিনের পর দিন চলতে থাকলে, আপনারা কি করতেন? মুশকিল হল, আলো অন্ধকার যে পথই তারা বেছে নিয়েছে, ভারত-পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলাদলির সামনে মাথা নত করে হেরে যেতে হয়েছে তাদের প্রত্যেককেই। যে ছেলেটি ১০-১২ বছর বয়সে বিনা কারণে সেনার হাতে চড় খেয়ে, রাস্তায় অপদস্থ হয়ে বন্দুক তুলে নিয়েছিল, নিজের দাদাকে পিকনিক থেকে সেনাদের তুলে নিয়ে যাওয়ার পরে, আবার ওর বয়সী আরেকটি ছেলে নিজের বাবাকে চোখের সামনে মরতে দেখেও প্রথমে ডাক্তার হয়ে তারপর আইএএস অফিসার হয়েছিল। তবে হেরে গেছে দু’জনেই। একজন সেনার গুলিতে, আরেকজন রাজনীতির সামনে। “সবার পিছে, সবার নিচে, সব-হারাদের মাঝে”

উল্লেখ্য, সেনা মাত্রই যে সবাই খারাপ, তাও না। কান পাতলে সেনা-কাশ্মীরির  (Kashmir) বন্ধুত্বেরও অনেক গল্প শোনা যায়, মানবকল্যাণ স্বার্থে সেনাদের বিভিন্ন উদ্যোগও চোখে পড়ে। কিন্তু মসনদে বসা মাথাগুলো যে কয়েক দশক ধরে এর উপরে ভিত্তি করেই ক্ষমতা উপভোগ করে যাচ্ছে৷ আমরা যাদের প্রশ্ন করতে কেবলই ভুলে যাচ্ছি, তারাই আসলে ব্যর্থ। আর আমরা একটা রাজ্যকে এইভাবেই প্রতিদিন হারিয়ে দিচ্ছি। কিছুতেই তাদের মূলস্রোতে ফিরতে দিচ্ছি না।



“এক মাসের ট্রেনিংয়ে আমি মুম্বইতে ছিলাম৷ ওই প্রথম আমার কাশ্মীরের বাইরে যাওয়া, থাকা। কি স্বাধীন জীবন! ওইভাবেও থাকা যায়! যখন খুশি বেরোও, আবার যখন খুশি ফিরে আসো, তোমায় কেউ কিচ্ছু বলবে না, কেউ কিচ্ছু করবে না। আমাদের এখানে এই সোশ্যাল লাইফটাই নেই। আমরা ওইজন্যই চট করে বাইরে গিয়ে কারোর সঙ্গে মিশতে পারি না। আসলে আমাদের অভ্যেস নেই তো এরকম নিশ্চিন্ত হয়ে চলাফেরা করার৷ তাই আমাদের মধ্যে কেউ কেউ বাইরে গিয়েও নিজেদের এক কোণে রেখে দিই৷  আবার কেউ কেউ বেপরোয়া হয়ে উঠি৷” বছর ২৪-এর ব্যাংককর্মী যুবকের চোখে-মুখে, স্বরে বিস্ময়, উচ্ছাস, আবার কিছুটা গুমড়ে থাকা বেদনা। কলকাতা-মুম্বইয়ের নিশ্চিন্ত জীবন কি ওঁরও প্রাপ্য নয়?  লাঞ্ছিত “অরণ্যের অধিকার”, লালগড়ের পথে মহাশ্বেতা

“আমি আবার যেতে চাই বাইরে। এবার কলকাতা যাব৷” মুখে স্মিত হাসি। “কেন? কলকাতা কেন? কেউ আছে?” প্রশ্ন করা হল। “না, ঘুরতে যাব। আসলে যা চলছে বাইরে, খুব নিরাপত্তাহীনতায় ভুগি। কলকাতার মানুষজন শুনেছি খুব উদার, খুব নিরাপদ জায়গা, তাই ওখানেই যাব৷” লজ্জা হল। ওকে কিভাবে বলি, ওখানেও দলাদলি শুরু হয়ে গেছে। নাহ, তবে এখনও কলকাতা হারিয়ে যায়নি। প্রচ্ছন্ন গর্বও হল।



“তোমার কোনও বিশেষ বন্ধু আছে?” প্রশ্ন করা হলে লাজুক হাসি এল উত্তরে। “দেখা সাক্ষাৎ হয়?” এবার মুখটা তীব্র যন্ত্রণায় গম্ভীর। “না। গত আড়াই মাসে দেখা কথা কিছুই হয়নি। মাঝে মাঝে ভাবি যে যাই। তবে ও দাক্সুম এলাকায় থাকে। ওই জায়গাটা নিরাপদ না। তাছাড়াও আমাদের এখানে ওরকম মেয়েদের বাড়িতে হুটপাট যাওয়া যায় না। প্রেম করে বিয়ে ব্যাপারটাও তেমন প্রচলিত নয়। প্রেম করলেও মেয়ের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব অনেক সময় নিজেদের প্রেমের ব্যাপারটা লুকিয়ে দিতে হয়৷ পাশের বাড়ির কাকু-কাকিমার মারফতে বা অন্য গল্প ফেঁদে। এখনও এখানে বিয়ের আগে মেলামেশা বা একে অপরকে চেনা জানা, ব্যাপারটা মেনে নেয় না। বাগদান হয়ে গেলে অবশ্য আর চিন্তা থাকে না। তাই আমি গেলে ওর অসুবিধা হতে পারে। এই ভেবেই আর যাই না৷”

দু’জনেই চুপ। “আর তো কটা দিন। খবরে দেখাচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি জনসংযোগ আবার চালু হবে,” বললাম। “ওরকম রোজই দেখায়। চালু হলেও আবার বন্ধ করে দেবে। আমার মনে হয় ও আমাকে ভুলেই যাবে৷” উদাস হাসি বেরিয়ে এল, গলা থেকে। “কেন? ভুলে যাবে কেন?” প্রশ্ন করা হল। “বাহ রে! এই তো চার মাস আগে পরিচয়। এখনও মনে সেভাবে দাগ কাটা হয়নি। কত কি চেনা-জানার বাকি ছিল, তার মাঝে এই অবস্থা। ভুলে যেতেই পারে। আর কি অবস্থায় আছে সেটাও নির্ভর করবে। দ্বারকানাথের লোলা



হয়তো এত কিছুর পরে এসব নিয়ে ভাবতেই চাইবে না। হয়তো ওর বাড়ির লোক এমন কোনও ছেলের সঙ্গে বিয়ে বা বাগদান সেরে ফেলতে পারে, যে কাশ্মীরের  (Kashmir) বাইরে থাকে। চার মাসের চেনা ছেলের উপরে ভরসা করে ও কি আর বসে থাকবে?” “হতেও তো পারে ও তোমার ব্যাপারে ঠিক এইগুলিই ভাবছে। ভাবছে তুমি বাইরে চলে গেছো বা তোমারও হয়তো… তুমিও হয়তো চার মাসের চেনা মেয়ের জন্য বসে নেই বা তুমি বিপদে পড়েছ, উধাও হয়ে গেছো, আর ফিরবে কিনা…” “তাহলে তো আর কথাই নেই৷” কথা থামিয়েই বলল।



এই অনিশ্চয়তা আর অপূর্ণ থেকে যাওয়া সাধগুলি নিয়ে তৈরি জীবন কাটাতে ঠিক কতোটা মানসিক শক্তির প্রয়োজন পড়ে? আমার জানা নেই। কিরকম লাগে, নিজের সাধ-আহ্লাদগুলির পূর্ণতা যখন পুরোপুরিভাবে এক রাজনৈতিক সমীকরনণের উপরে নির্ভরশীল থাকে! ‘চেষ্টা করেছি, পারিনি’ বলার মধ্যেও একটা তৃপ্তি লুকিয়ে থাকে; কিন্তু ‘চেষ্টা করেছি ওরা হতে দেয়নি,’ বা সফল হওয়া অসফল হওয়া সবটাই যখন রাষ্ট্রের হাতে, আমার চেষ্টা করার সিদ্ধান্তটাও তখন রাষ্ট্রের মুখের দিকে চেয়ে করতে হবে৷ হয়তো বা চেষ্টা করতে দেওয়াই হবে না৷ নিজের জীবনটাই নিজের হাতে না থাকার অতৃপ্তিটা বোধহয় আমার আপনার অনুমানের চেয়েও অনেক বেশি গাঢ়।

Facebook Comments Box

Post Author: bongmag

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।