সৃজনী এক সুপ্ত ভালবাসা, কখন যে কার মধ্যে সে জেগে উঠে নিজের নিদর্শন রাখতে শুরু করবে তা আগে থেকে কল্পনা করা সম্ভব নয়। তবুও মননশীল মানুষের অন্তরেই সে আদরণীয়। সেই মননশীলতা সমাজের যে কোনও স্তর থেকেই আসতে পারে। কোনওভাবেই সৃজনীকে ধনীর খেয়াল বলে চালাতে পারবেন না। সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মালেও হয়তো সুযোগ সুবিধা বেশি আসে। কিন্তু কুঁড়েঘরেও চাঁদের আলো প্রবেশ করে। শুধু তাকে লালন করতে জানতে হয়। শিল্প যত লালিত পালিত হবে, শৈল্পিক সত্ত্বার বিকাশ ততই মননশীল হবে। ১৬ বছর ধরে তেমনই কাজ করে চলেছেন বেন উইলসন। আরও পড়ুন-এই রেস্তরাঁয় একটা বার্গার কিনতেই পকেট থেকে খসে ৬৫ হাজার টাকা, কেন জানেন?
বছর ৫৭-র বেন লন্ডনের উত্তরাংশের বাসিন্দা। তিনিও আমার আপনার মতোই অতি সাধারণ একজন মানুষ। তবে সাধারণ হলেও বেনের ভিতরে লুকিয়েছিল অসাধারণত্ব। তাইতো চিবানো চুইং গামকেই বানিয়ে ফেললেন ক্যানভাস। না না কোনও ইজেল নয়, পছন্দের ব্যালকনিতে সাজানো বাগান। ক্যানভাসে ফুটে উঠছে শিল্পীর মনন, তা-ও নয়। একবারে মাঝ রাস্তায়। যেখানে ফাঁকা থাকাই দুস্কর, সেখানেই বেন এঁকে চলেছেন। ইজেলের ভূমিকায় পিচ, ক্যানভাস সেই ফেলে দেওয়া চুইং গাম। পথচলতি মানুষের যেখানে বিরাম নেই সেখানে চুইং গাম তো আর দুর্লভ নয়। বেনকে শুধু রং কিনতে হয়েছে সঙ্গে তুলি। তবে এখানেই শেষ নয়। সৃজন থাকলেও হয় না তাকে প্রকাশের প্রচেষ্টাও থাকতে হয়। এঁটো চুইং গাম নিয়ে মাঝ রাস্তায় কেউ ছবি আঁকছেন। এ দৃশ্য দেখলে আমরা মানে জনগণ কী প্রতিক্রিয়া দেবেন সেটাও ভাবতে হবে। সেদিক থেকে বেন বেশ ভাগ্যবান। জন্মেছে লন্ডনে তাই তাঁর মানসিকতাও তেমনভাবে তৈরি। আরও পড়ুন-চকলেট কিনতে ২৬ লক্ষ টাকা খরচ করলেন এই মহিলা
VIDEO: Lying on a footbridge spanning London’s River Thames, Ben Wilson puts the final touches to his latest creation: a miniature painting on chewing gum, stuck to the steel structure pic.twitter.com/iLwJH82R95
— AFP news agency (@AFP) February 15, 2020
কে কী ভাবল বড় কথা নয়, সৃজনকে লালন করাই প্রয়োজনীয়। বেন সেটাই করেছেন। পথচারী যখন গন্তব্যে যেতে ছুটছেন, তাঁদের পাশে সামান্য জায়গা করে নিয়ে প্রায় শুয়ে পড়েছেন বেন। একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়ার মতো, চিবানো চুইং গামকে ধীরে ধীরে একটা ক্যানভাসের রূপ দিলেন প্রথমে। তারপর শুরু হলে মনের আনন্দে রঙের খেলা। গোলাকার সেই ক্যানভাসে কোনওটা মানুষের মুখ। কোনওটা বা দেওয়াল চিত্র। আমাদের দেশে পটে আঁকা চিত্রায়ন নিশ্চই নজরে এসেছে, অনেকটা সেরকম বলতে পারেন। কোনওটা দেখলে মনে হবে মায়ের কোলে শিশু হাসছে। কোনওটা আবার বয়ে চলা নদী, পাশে লতানো ফুলে ঝাড়। চিবানো চুইং গামও যে শিল্পকলা সমৃদ্ধ হতে পারে, তা ভাবনার ক্ষমতা একমাত্র শিল্পীরই থাকে। বেনেরও ছিল। আরও পড়ুন-১৬ সেকেন্ডে ধুলো হয়ে গেল, ১৬ হাজার টন ইস্পাতের বিল্ডিং, কোথায় জানেন?
নিশ্চই শুরুটা এত সহজ হয়নি। তবে তাতে কী, মন যখন সৃজনকে প্রকাশ্যে আনতে চায় তখন পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি কতটা আর বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। সেই ২০০৪, উত্তর লন্ডনের বার্নেট শহর। সেখানকার রাস্তাতেই চুইং গাম কুড়িয়ে প্রথম তার চিত্রায়ন করলেন বেন। লোকে প্রথমে অবাক হয়ে দেখেছে। পথের মাঝে এমন একজন বসে পড়ে চুইং গামে শিল্পকলার বাহার দেখাচ্ছেন। অনেকেই বিরক্ত হয়েছেন। তবে যখন সৃজনে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠা চুইং গাম নজরে এসেছে, তখন সেই বিরক্তির জায়গা নিয়েছে শ্রদ্ধা। বেনের তুলি আরও সচল হয়ে উঠেছে। একে একে পর্তুগাল, সেন্ট্রাল ইউরোপ, ব্রাসেলস, প্যারিস, বার্লিনের রাস্তায় ব্যস্ত বেনকে ওই একই ভঙ্গিমায় ছবি আঁকতে দেখা গিয়েছে। পথচলতি মানুষ এখন আর অবজ্ঞা ভরে নয়, ব্যস্ততার ফাঁকে এগিয়ে এসে বেনের শিল্পকর্ম দেখে। অবাকও হয়। সেখানেই শিল্পী বেন উইলসনের জয়। চিবানো চুইং গামও যে ড্রয়িংরুমের সৌন্দর্য বাড়াতে পারে তা তিনি করে দেখিয়েছেন। বাকিটা তো সমঝদারের হাতে, যিনি শিল্পের কদর বোঝেন।