ঝ্যাং জুন, (Zhang Jun) চিন থেকে ভারতে এসে এদেশের নত্যশৈলীকে আপন করে নিয়েছিলেন একদা। আজ হাজারো তিক্ততার মধ্যেও সেই ঝ্যাং জুনই যেন মৈত্রী সূত্র হয়ে চিন ভারতের সখ্যতাকে জিইয়ে রেখেছে। তাইতো কোভিডের জন্য লকডাউন এবং অন্যান্য সীমাবদ্ধতা ওঠার পর বেজিং-এর এশিয়া ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক অডিটোরিয়ামে ৩০০ এরও বেশি জ্যাং-এর ভক্তরা ভিড় করেছিলেন। চাইনিজ শিশু ও বড়রা যারা এই নাচকেই তাঁদের জীবনের মূলমন্ত্র হিসেবে ভেবেছেন, তাঁরা সকলেই ঝ্যাং জুনকে সম্মান জানিয়ে নাচলেন এদিন।
ঝ্যাং জুনের এক উৎসাহী শিষ্য জিধ শান শানের কাছে এ এক স্বপ্নপূরণ। তিনিও ভারত ও চীনের একজন প্রতিষ্ঠিত নৃত্যশিল্পী যিনি জ্যাং জুনের দেওয়া শিক্ষাকে পাথেয় করে চলেছেন। এই দিন চীনে ভারতের রাষ্ট্রদূত প্রদীপ কুমার রাওয়াত এবং প্রাক্তন উপঅর্থমন্ত্রী এবং এআইআইবি- এর প্রেসিডেন্ট জিন লিকান শেষ পর্যন্ত এই অনুষ্ঠানে ছিলেন এবং হিন্দি ও তামিল গানে নাচকে অনেক উৎসাহ দিয়েছেন। জ্যাং জুন(১৯৩৩-২০১২) তাঁর নৃত্যের সাধনার মাধ্যমে অনেক চিনা ও ভারতীয় শিক্ষার্থীদের আদর্শ হয়ে উঠেছেন।
১৯৫০ – সালে চিনের প্রধানমন্ত্রী জু এনলাই- এর উৎসাহে ভারতে এসেছিলেন ঝ্যাং জুন। মাও সে তুং- এর শিল্প বিপ্লবের সময় তিনি অনেকবার ভারতে আসেন। বিরজ মহারাজ, উদয় শঙ্করের কাছে নাচ শেখেন। পরে বর্তমান চেন্নাই-এর কলাক্ষেত্রে নৃত্যশিক্ষা নেন।
তারপর তিনি চিনে নাচের দল গঠন করেন এবং এর ফলে জিন শান শানদের মত অনেকেই শিখতে ভরত নাট্যমের মতো নাচে পারদর্শী হয়ে ওঠার সুযোগ পান।
১৯৩৩ সালে চিনের কিচুয়ান প্রদেশে এক বুদ্ধিজীবি পরিবারে জ্যান জুংয়ের জন্ম। ক্ল্যাসিকাল অর্কেস্ট্রা কনডাক্টর উই জুনের সঙ্গে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন।
১৯৯৬ সালেমারণব্যাধি ক্যানসার তাঁর শরীরে আগমন বার্তা জানায়। ২০১২ সালে এক পৃথিবী শোকের মাঝে প্রিয়জনকে ফেলে অমৃতলোকে যাত্রা করেন ঝ্যাং জুন।
পুত্র হান সিয়াও সিয়া এদিন তাঁকে নিয়ে দেখানো একটি তথ্যচিত্রে বলেছেন, বাবা ঝ্যাং জুন ভারতের এই নৃত্যশৈলিকে আরও মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিতে চাইতেন। তিনি নিশ্চয়ই আজকের এই দৃশ্য দেখে উপরে বসে খুবই খুশি হচ্ছেন।
তিনি আরও বলেছেন তাঁর মা বছরে অনেকবার ভারতে যেতেন এবং যখন ফিরে আসতেন তখন বাড়ির পরিবেশটাই পালটে যেতো। সারা বাড়িতে ভারতীয় সঙ্গীত বাজতো। সময়ের সাথে সাথে আরও অনেকে তাঁর সাথে দেখা করতে আসত।
তিনি অনেক শিষ্যকে শিক্ষা দিয়েছেন এবং তিনি আশা রাখতেন তাঁর ছাত্র ছাত্রীরা একদিন তাঁকেও ছাপিয়ে যাবে।প্রত্যেক দিন বাবার কাছে অনেকেই নাচ শিখতে আসতেন। তাঁদের মধ্যে বাচ্চারাও ছিল।
মি. রাওয়াত বলেছেন, ঝ্যাং একজন সেরা নৃত্য শিল্পী ছিলেন। আমি সবসময় অবাক হই যে তাঁর ভারতীয় সঙ্গীত ও নৃত্যের প্রতি কী ভাবে এত আগ্রহ জন্মাল? হয়তো তিনি আগের জন্মে ভারতীয় ছিলেন এবং পরের জন্মে সেই গুণ গুলো নিয়েই চিনে জন্ম নিয়েছেন।
নাচের প্রতি তাঁর ভক্তি ছিলো অপরিসীম। এমনকি আমাদের দুই দেশের মধ্যে লড়াই চললেও তাঁর মধ্যে কখনো সেসবের প্রভাব পড়েনি, তিনি ছিলেন ছাত্রছাত্রীদের কাছে আদর্শ। তার কিছু ঝলক আমরা আজ দেখতেই পেলাম, এবং তাঁর অন্যতম শিষ্য জিন শান শানেরও নাচ দেখলাম। নাচের প্রতি এমনই ভক্তি ছিল যে ক্যানসার শরীরে নিয়েও নিত্য অনুশীলন চালিয়ে গেছেন।
শিষ্য জিন শান শান ১২ বছর বয়স থেকে তাঁর কাছে নাচ শেখা শুরু করে। আর আজকের দিনে জিন চিনে ভারতীয় নৃত্যের একজন বরেন্য শিল্পী হিসেবে সমাদৃত। নৃত্যগুরুর কাছেই যেন প্রকৃত শিক্ষা পেয়ে এসেছেন জিন শান শান। জিন, ঝ্যাং- এর উপদেশে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দি বিভাগে পড়াশোনা করেন। ভারতে এসে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাস করেন। এই সময় তিনি বিখ্যাত ভরত নাট্যম শিল্পী লীলা স্যামসনের কাছে শিক্ষা নেন। জিন, ভারতীয় দূতাবাসের সবসময় নাচ প্রদর্শন করতেন এবং তাঁর তৈরি ভরত নাট্যম স্কুলে ১০০ জনের ওপর শিক্ষার্থীকে তিনি শিক্ষা দান করেছেন। জিনের মেয়ে জেসিকা উ ওরফে উজিং সিও একজন নামী নৃত্যশিল্পী।
জিন বলেছেন, “আমি আরাঙ্গেত্রামে নেচেছিলাম, তখন আমি সন্তানসম্ভবা, তাই জেসিকার রক্তে নাচ আছে। ভারতে প্রচুর প্রাচীন কলা রয়েছে এবং চীনেও তা আছে। আমরা পরস্পরের সংস্কৃতি আরও বেশি করে জানলে আমাদের দুই দেশেরই একে অপরকে বুঝতে সুবিধা হবে।”
Facebook Comments Box