রাখী সরকার
ভানু মাটির বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসেছিল। তার মা এক বাটি মুড়ি সামনে রেখে বলল খেয়ে নে, আমি নাইতে যাচ্ছি। ভানু বাটিটা তুলে নেয় হাতে। একমুঠো মুড়ি মুখে তোলে। ছ্যা ছ্যা এসব খাওয়া যায়? বলেই থুঃ থুঃ করে মুখ থেকে ফেলে দেয় মুড়ি গুলো। হঠাৎ ভানুর চোখ পড়ে বারান্দার কোণে ঝুলিয়ে রাখা খাঁচাটার দিকে।
তাদের পোষা টিয়া পাখিটা খাঁচার ভিতরে লাফালাফি করে বেড়াচ্ছে। ভানু স্থির চোখে পাখিটাকেই দেখে। এগিয়ে আসে খাঁচার দিকে। খাঁচা খুলে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনে টিয়াকে। পাখিটা ভানুর হাতের চাপে চেঁচাতে আরম্ভ করে। ভানু আরও শক্ত হাতে পাখিটাকে ধরে। বারান্দা থেকে নেমে ঢুকে যায় পিছনের বাঁশ বাগানে।
ভানুর জিভ থেকে তখন জল ঝরছে। নিজের ধারাল দাঁত দিয়ে একটানে ছিঁড়ে ফেলে টিয়া পাখির মাথা। মুখে লেগে থাকা রক্তটা চেটে নেয় জিভ দিয়ে। পাখিটার শরীরটাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় বাঁশঝাড়ের মধ্যে। বেরিয়ে দেখে সামনে তার মা দাঁড়িয়ে। ভানু একটু থতমত খেয়ে যায়। মা বলে ওঠে। কিরে পাখিটা অত চেঁচাচ্ছিল কেন? বেঁজিতে নিয়ে গেল তো তাই। ভানুর মা বেশ অবাক হয়ে বলে, অত উপর থেকে নিয়ে চলে গেল! ভানু বেশ বিরক্ত হয়ে জবাব দেয়, তা নয়তো আমি নামিয়ে দিলাম।
মা এবার ভানুকে জিজ্ঞেস করে। কিরে, ওরা তোকে কাছ থেকে ছাড়ালো কেন? ভালই তো এতদিন কাজ করলি। ভানু চুপ করে থাকে। মনে মনে ভাবে দু’বছর আগের কথা। ভানুর বাবা লোকের জমিতে চাষ করে। শুধু ভানুর বাবাই নয়, এ গ্রামের সকলেই চাষের কাজ করে। কিন্তু ভানুর এসব ভাল লাগে না। ওর মন চায় অন্য কিছু করতে। কিন্তু কি করবে তা বুঝে উঠতে পারে না। বাবার হোটেলে খেয়ে আর সারাদিন ঘুরে বেরিয়ে বেশ একটা স্বাস্থ্যবান চেহারা তৈরি করেছিল ভানু। আরও পড়ুন-স্রোতের গন্ধ
সেবার রথের মেলাতে গ্রামে প্রথম ম্যাজিক শো আসলো। লোকজন ভিড় করে টিকিট কেটে দেখতে গেল। ভানুও গিয়েছিল। কত সব অদ্ভুত অদ্ভুত ম্যাজিক! মানুষকে দু’টুকরো করে ফেললেও মরে না। শূন্যের উপর ভেসে থাকে মানুষ। ভানু এতদিনে তার ভাললাগা খুঁজে পায়। মনে মনে পণ করে সে ম্যাজিক শিখবে। তাই রথের মেলা শেষ হলে ম্যাজিক শো যখন পাশের গ্রামে গেল। তখন একদিন ভানু নিজের দু তিনটে জামা প্যান্ট ব্যাগে ভরে রওনা হলো পাশের গ্রামে। সকালের খাওয়া সেরে, ম্যাজিক শোয়ের মালিক অতুলপ্রসাদ সবে পান নিয়ে বসেছেন। এমন সময় ভানু গিয়ে পড়ল তার পায়ে।
বাবু আমায় একটা কাজ দেন। কে তুই? অতুলপ্রসাদ বলে উঠল। বাবু আমি ভানু। পাশের গ্রাম থেকে এসেছি। চাষবাস ছেড়ে এখানে কি কাজ করবি? বাবু যা হোক একটা কাজ দেন। আমার চাষবাস করতে ভাল লাগে না। অতুলপ্রসাদ বললেন, আমার তো এখন লোকের দরকার নেই রে। ভানু পড়ে গেল তাঁর পায়ে। বাবু যা হোক একটা। আপনি যা বলবেন আমি তাই করব। ভানু কাকুতি-মিনতি করতে লাগল। সেদিন অতুলপ্রসাদ তীক্ষ্ণ হাসি হেসে বলেছিলেন যা বলব তাই করতে পারবি? ভানু সেদিন না বুঝেই বলেছিল, হ্যাঁ বাবু সব পারব।
তখন থেকে ভানু ম্যাজিক শো তে রয়ে গেল। একমাস পরে অতুলপ্রসাদ জানাল তাকে নর রাক্ষস সাজতে হবে। নর রাক্ষস ম্যাজিক শোয়ের একটা অন্যতম ম্যাজিক। যেখানে একটা মানুষের গায়ে মন্ত্রপুতঃ জল ছিটিয়ে দিলেই সে রাক্ষসে পরিণত হয়। তখন তাকে সাত আট জন মিলেও দড়ি দিয়ে ধরে রাখতে পারে না। সে হয়ে ওঠে হিংস্র। তখন তার সামনে ছুঁড়ে দেওয়া হয় জ্যান্ত মুরগি। সে সেই জ্যান্ত মুরগির মাথা তার দাঁত দিয়ে কামড়ে ছিঁড়ে ফেলে। খেতে থাকে কাঁচারক্ত। তখন আরেকটা মন্ত্রপুতঃ জল ছিটিয়ে তাকে আবার পুনরায় রাক্ষস থেকে মানুষ করা হয়। এটা যে শুধুই লোক ভোলানো তা কেবল জানত ম্যাজিক শোয়ের ভিতরের লোকেরা। এখন এসব ভানুকেও শেখানো হল। ভানুর মতো স্বাস্থ্যবান যুবক তার সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করলে সাত আটজনকে অনায়াসে হাঁপিয়ে তুলতে পারবে। এভেবেই ম্যাজিক শোয়ের মালিক অতুলপ্রসাদ ভানুকে কাজে রেখে দেন। আরও পড়ুন-কালান্তরের পটভূমি
কিন্তু কাজে ঢোকার সময় যে কথাটি ভানু সহজেই পারবে বলেছিল তা যে খুব একটা সহজ কাজ নয়, প্রাকটিসের প্রথমদিনই ভানু বুঝতে পেরেছিল। যে কোনও সাধারণ লোকের পক্ষে জ্যান্ত মুরগির মাথা দাঁত দিয়ে ছেঁড়া খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়। প্রথম দিন ভানুর হল তেমন অবস্থা। সে ঠিকমতো মুরগিটাকে ধরতেই পারল না। মুরগির বিশ্রী গন্ধে তার গা গুলিয়ে উঠল৷
বাড়িতে থাকার সময় মা কোথাও গেলে তাকে মুরগি তুলে রাখার কথা বলত। ভানু ঘেন্নায় কখনো কাছেই যেত না। দ্বিতীয় দিন ভানু মুরগিটাকে ধরতে পারলেও দাঁত দিয়ে মাথা ছেঁড়া তার পক্ষে সম্ভব হল না। অতুলপ্রসাদ সাফ জানিয়ে দিল এমন করলে ভানুকে আর কাজে রাখবে না। বাড়ি থেকে আসার সময় গাঁয়ের সব বন্ধুদের সে বলে এসেছিল ম্যাজিক শিখে তবেই বাড়ি ফিরবে। এখন যদি এক মাসে বাড়ি ফিরে যায়, তাহলে লজ্জায় মাথা কাটা যাবে। তাই ভানুর মনে জেদ চেপে গেল, যেভাবে হোক তাকে এটা পারতেই হবে।
এভাবে বেশ কিছুদিন বমি-টমি করার পর একদিন ভানু পেরেই গেল। তারপর থেকে শুরু হয়ে গেল তার নর রাক্ষস সাজার কাজ। সপ্তাহে একটা শো। বাকি সপ্তাহ অন্য ম্যাজিক শেখা। এইভাবে জ্যান্ত মুরগির মাথা দাঁত দিয়ে ছিঁড়তে একসময় ভানু অভ্যস্ত হয়ে গেল। তাতে প্রভাব পড়ল তার স্বাভাবিক জীবনে। রান্না মাংস সে আর কিছুতেই মুখে তুলতে পারে না। রান্না করা মুরগির মাংস দেখলেই তার গা ঘিন ঘিন করে। প্রায় দু’বছর সে ম্যাজিক শো-তে কাজ করেছিল। কিন্তু সমস্যাটা শুরু হল গত পুজোর সময় থেকে। পুজোর সময় প্রায় প্রতিদিনের শো-তেই এই নর রাক্ষস খেলা থাকত। যে কারণে ভিড় ও জমত বেশি। ফলে প্রায় দিনই ভানুকে একটা করে জ্যান্ত মুরগির মাথা ছিঁড়তে হতো।
দুর্গাপুজো থেকে কালীপুজোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বার নর রাক্ষস সাজতে হলো ভানুকে। কালীপুজোর পর থেকেই ভানুর শরীরে সমস্যাটা দেখা দিল। ওর খাবারের রুচিটা একদম কমে গিয়েছিল। কোনও কিছুই আর খেতে ভাল লাগে না। একদিন ও নিজেকে খুব ভাল করে লক্ষ্য করে দেখে, যে সময় সে নর রাক্ষস সাজে তখন মুরগির মাথা ছেঁড়ার পর তার মুখে লেগে থাকা রক্ত জিভ দিয়ে চেটেপুটে নিতে বেশ ভাল লাগে। স্বাদ ও পায় সে। তখন থেকে শুরু হয়ে গেল এই অদ্ভুত ভাললাগা। তারপর থেকে নররাক্ষস সাজলেই ও মুরগির রক্ত বেশ কিছুটা করে খেয়ে দেখে। আলাদা একটা স্বাদ আছে এর। আলাদা একটা গন্ধ। যা রান্না করা খাবারে কখনও পায়নি। তারপর থেকেই ভানু নর রাক্ষস সাজার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকত। কিন্তু মাসে দু থেকে তিনবার হয়তো নর রাক্ষস সাজার সুযোগ আসে। তাতে ভানুর মন ভরে না। পেট ও ভরে না। আরও পড়ুন-ক্যানভাসে বৃষ্টির রাত, প্রহর জাগে ১৪ ফেব্রুয়ারি
সে কারণে প্রায় দিন রাতে শোয়ের জন্য পোষা মুরগির বাক্স থেকে একটা করে মুরগি বের করে ভানু তার মাথা ছিঁড়ে রক্ত খেতে থাকে। ওদিকে এভাবে মুরগি চুরি যেতে দেখে অতুলপ্রসাদের মনে সন্দেহ জাগে। একদিন তিনি নিজেই বসলেন পাহারায়। লুকিয়ে রইলেন মুরগি চোর ধরার অপেক্ষায়। হঠাৎ দেখতে পেলেন অন্ধকারের মধ্যে চাদরমুড়ি দেওয়া একটা লোক খাঁচা থেকে মুরগি বের করে নিচ্ছে। লোকটা তাঁবু থেকে বেরিয়ে হাঁটা দেয় মাঠের দিকে। তারপর মাঠের বসেই দাঁত দিয়ে মুরগির মাথা ছিঁড়ে তার রক্ত মাংস খাচ্ছে। জ্যোৎস্নার আলোতে অতুলপ্রসাদ এই নররূপী রাক্ষসকে দেখে ভয় পেয়ে যান। চাঁদের আলোয় সেই রাতে ভানুর চোখ-মুখের হিংস্রতা দেখেছিলেন তিনি।
পরেরদিনই ভানুকে ডেকে অতুলপ্রসাদ তার মাইনেপত্র দিলেন সব মিটিয়ে। বললেন, এখানে আর কাজ করার দরকার নেই। ভানু এভাবে তাড়িয়ে দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে অতুলপ্রসাদ বলেন ভানুর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সে পাগল হয়ে গেছে। ভানু বাড়ি ফিরে আসে। আজ এভাবে পোষা টিয়ার রক্ত খাওয়ার পর ভাবে, সে কী সত্যিই পাগল হয়ে গেছে? নাকি রক্তের স্বাদ তার ভিতরের রাক্ষসটাকে জাগিয়ে তুলেছে!