ইমানুল হক
“মুণ্ডমালায় ওই হেঁটে যায়
দশ বছরের দেনা
বুড়ি শুধু ডাকে ও বাপু ছেলেরা
কেউ কিছু বলবে না?”
এত ‘দশক’-এর শুধু নয়, শতাব্দীর কথা। শঙ্খ ঘোষ কবেই লিখে গেছেন এই কবিতা৷ জানেন, আমার জানা এক প্রবীণা আছেন, যাঁর ঘুম হচ্ছে না, কারণ জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের ভয়ঙ্কর স্মৃতি মুছে ফেলার বিরুদ্ধে কেউ কিছু তেমন বলছে না, করছে না পশ্চিমবঙ্গে। বোবা দর্শক বেড়ে যাচ্ছে, সবাই নিজেকে নিয়ে চিন্তিত ও ব্যস্ত, সমাজ সংস্কৃতি দেশ খারাপ থাকলে তিনিও যে ভাল থাকবেন না, থাকতে পারবেন না- এই বোধটাই অনুপস্থিত।
শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন,
“তোমার কোনো ধর্ম নেই, শুধু
শিকড় দিয়ে আঁকড়ে ধরা ছাড়া
….
তোমার কোনো ধর্ম নেই, এই শূন্যতাকে ভরিয়ে দেওয়া ছাড়া৷”
‘ত্রিতাল’-এর কথা কি শুধু? এত বহু তালের বহু কালের কণ্ঠ।
শঙ্খ ঘোষের নাম শুনেছি, ১৯৭৬ এ শীতের রাতে। বাবা, দাদা ও দাদার এক বন্ধু এবং বাবার এক অনুগামীর সঙ্গে আলাপে। জরুরি অবস্থা চলছে। গভীর রাতে গোপন বৈঠক। কী করণীয়? বললেন, সব বিয়ে বাড়িতে শঙ্খ ঘোষের কবিতার বই “বাবরের প্রার্থনা” দাও। দিনেশ দাশের “কাস্তে” দিলে সন্দেহ ও ঝামেলা করবে কংগ্রেসের লোকরা, শঙ্খ ঘোষ বুঝবে না। যাঁকে দেওয়া সে ঠিক বুঝবে।
পালা বদলের পর যত আবৃত্তি প্রতিযোগিতা হতো আমাদের এলাকায়, সব জায়গায়, যমুনাবতী সরস্বতী বাঁধা। আমার মনে আছে, সংগঠন করায় মিথ্যা মামলার দায়ে বাবা তখন ফেরার৷ আমি পড়ছিলাম, “হাসপাতালে বলির বাজনা/ আমার ভাই ছিল ফেরার৷” মা ডুকরে কেঁদে উঠেছিলেন। আমার ভাল লাগত, ব্রিগেডের মাঠে হেঁটে গেল দুই যুবক যুবতী শিরস্ত্রাণহীন। ব্রিগেড দেখার পটভূমিটাই বদলে দেন শঙ্খ ঘোষ। আমি আর গায়ক চিকিৎসক ক্ষেত্রমাধব দাস সন্ধ্যাবেলায় কতবার হেঁটেছি ব্রিগেডিয়ার হয়ে, ব্রিগেডের ঘাসে। আরও পড়ুন-অন্য ‘বিন্যাস’-এর লেখক বুদ্ধদেব গুহ
শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে সরাসরি আলাপ ১৯৮৯-এ। অগ্রজ কবি জয়দেব বসুর সঙ্গে। আমার বিশ্বাস ছিল, কবি লেখক সাহিত্যিকরা লেখেন ভাল, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে বোধহয় আলাদা। যা লেখেন, তা করেন না। এড়িয়ে চলায় বিশ্বাস তাই। পরে অশোক মিত্র, শঙ্খ ঘোষ, অমিয় বাগচী, অরুণ মিত্র, অন্নদাশঙ্কর রায়, তরুণ সান্যাল, তপন রায়চৌধুরী, দেবাশিস ভট্টাচার্য্য-সহ বহু লেখক শিল্পী বুদ্ধিজীবীর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছে। দেখেছি, মানুষ হিসেবে এঁরা অনেক মহৎ। শঙ্খ ঘোষ, অশোক মিত্র, শামসুজ্জামান খান, অমিয় বাগচী- এঁরা আমার পিতৃপ্রতিম।
মনে আছে, শঙ্খ ঘোষের বাড়িতে গেলাম রবিবারের এক আড্ডায়। স্যার বলতাম তাঁকে, তখন প্রতি শনিবার কলকাতায় এসে কফি হাউসের আড্ডা, রাতে থেকে পরদিন সকালে শঙ্খ ঘোষের বাড়ি। ওই আড্ডার মান তখন ছিল বেশ উন্নত। আমাদের প্রিয় অধ্যাপক বিজিতকুমার দত্ত, অশ্রুকুমার শিকদারকে দেখেছি ওই আড্ডায় তর্ক-বিতর্কে। আমরা মূলত শ্রোতা। তবে বর্ধমানের পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইতেন। একবার বিজিত বাবুর মুখে আমি কবিতা লিখি শুনে বললেন, একটা কবিতা পড়ো৷ পড়লাম-
প্রতিভাবান বিষয়ক প্রশস্তিমালা
বুদ্ধিহীনেরাই শুধু প্রশ্ন করে অনর্থক
বুদ্ধিমানেরা প্রশ্নও করে না উত্তরও দেয় না
তারাই প্রতিভাবান যারা শুধু ঘাড় নাড়ে।
সেই কবিতা শুনে উনি “বাহ” বলায় লেখার উৎসাহ বাড়ল। ২০১৮ তে এ উনি আমাকে ১৯৯১-এ প্রকাশিত আমার কাব্য গ্রন্থ “বর্শাফলক স্নান করছে” বের করে দেখানোয় আমি চমকে যাই। প্রত্যেকের দেওয়া বই এত যত্ন করে রাখতেন!- শেখার বিষয়। সেদিন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের “কুকুর সম্পর্কে দুটো একটা কথা যা আমি জানি” নিয়ে আড্ডা সরগরম। আমিও একটু মতামত দিলাম সাহস করে। প্রচলিত কথার বিরুদ্ধেই ছিল মতটা, তিনি বললেন, ওই জন্যই তো আলোচনা।
১৯৮৯-এ আমরা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে একটা সংখ্যা করার সিদ্ধান্ত নিই কফি হাউসের আড্ডায়। অঞ্জন মুখোপাধ্যায় আর পার্থ মুখোপাধ্যায়কে সম্পাদক করা হল। সেখানে স্যারের লেখা চাই। দেন। এরপর ২০০১ থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে কিছু লিখলে কয়েকজন স্যারকে গিয়ে রীতিমতো দাগ দিয়ে দিয়ে দেখানো শুরু করে৷ দেখুন, ইমানুল কী লিখছে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে। আরও পড়ুন-Shankha Ghosh:“আমার বলে রইল শুধু, বুকের ভিতর মস্ত ধু ধু”
উনি কিন্তু একটা কথাও বলেননি আমাকে। প্রথম দিকে রাজনীতি নিয়ে আমার মতামত স্যারের তেমন পছন্দ হতো না। স্রোতের বিপরীতে বলছি। কিন্তু ২০০১ থেকে আমার মত মিলতে শুরু করে স্যারের সঙ্গে। সেবার লেনিনের “কী করিতে হইবে” বইটি রাখার অপরাধে শিলিগুড়িতে ২৬ জন নকশাল আন্দোলনের কর্মী গ্রেপ্তার হলেন৷ তিনজন বিবৃতিতে সই করলেন অশোক মিত্র, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ।
২০০২-এ গুজরাট গণহত্যার পর একসঙ্গে বহু কর্মসূচি। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে পয়সা তুলেছেন আমাদের সঙ্গে। ৬ এপ্রিল ২০০২ ধর্মতলায় মেট্রো স্টেশনের সামনে থেকে শুরু। এরপর রাজাবাজার, রিপন স্ট্রিট, মেটিয়াবুরুজ, ভবানীপুর, কলেজ স্ট্রিট, রবীন্দ্রসদন, শ্যামবাজার, খান্না; ৪০ জায়গায় সভা মিছিল করে গণহত্যা-পীড়িতদের জন্য পয়সা তোলা। পয়সার কৌটো রাখা থাকত স্যারের বাড়িতে। আর ব্যানার পোস্টার আমি নিয়ে যেতাম বাগুইআটিতে। আমাদের সঙ্গে মিলে খুচরো পয়সা গুনতেন তিনি। এক লাখ ৩৬ হাজার টাকার খুচরো। ২ পয়সা থেকে পাঁচ টাকা সব আছে। ৫ পয়সা ১০ পয়সা ২০ পয়সা ২৫ পয়সা আট আনাই বেশি। গোনার কত ঝামেলা। স্যারের ভ্রূক্ষেপ নেই। আরও পড়ুন-ফেলে আসা মেয়েবেলা ও মন কেমনের বসন্ত উৎসব
গুজরাট সংহতি সমিতি গড়ে তোলা হয় স্যারের বাড়িতে একাধিক বৈঠক করে। আমি আর সাংবাদিক মধুদা/ বিশ্বজিৎ রায় সবচেয়ে বেশি উদ্যোগ নিই। প্রথমে ঠিক হল, আমি সম্পাদক, প্রতুল মুখোপাধ্যায় কোষাধ্যক্ষ। রবীন্দ্রসদনে একটা নাগরিক সভা হলো চার এপ্রিল মূলত ভাষা ও চেতনা সমিতির ডাকে। সেই সভায় বাংলার প্রায় সমস্ত বুদ্ধিজীবী হাজির হন। সেখান থেকে ফিরে দেবেশ রায় এবং জ্যোতিপ্রকাশ চট্টোপাধ্যায় স্যারকে বললেন, দেবেশ রায় সম্পাদক ও জ্যোতিদা কোষাধ্যক্ষ হতে চান। ইমানুল হক আর বিশ্বজিৎ রায় যুগ্ম সম্পাদক হোক। স্যার ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, মতামত। আমরা বললাম, কাজটা হওয়া জরুরি। পদ নয়। এইসময় অনেক অনেক বড়ো বড়ো কাজ হয়। নাটকের দলগুলো মিলে ফ্যাসিবাদ বিরোধী নাটক তৈরি করে তার সম্পূর্ণ অর্থ তুলে দেওয়া হয় গুজরাট সংহতি সমিতিকে।
সেই সময় “মেফিস্টো” অভিনীত হল। প্রতিটি শো প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ। সুমন মুখোপাধ্যায় পরিচালক। গৌতম হালদার, দেবশংকর হালদার, বিমল চক্রবর্তী-সহ বাংলার বহু বিশিষ্ট অভিনেতা অভিনেত্রী এই নাটকে অভিনয় করেন। কৌশিক সেন করলেন “প্রাচ্য”। এই নাটকেই প্রথম অভিনয় করলেন কৌশিক সেনের পুত্র (তখন শিশু) ঋদ্ধি। চিত্রপরিচালক গৌতম হালদার এগিয়ে এলেন। স্যারের বাড়িতে বৈঠক হল। আমজাদ আলী খান দুই পুত্রকে নিয়ে রবীন্দ্রসদনে বাজালেন। দর্শক পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহ। আমাদের কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত সাধক ও স্রষ্টা কবীর সুমনকে তখন একদল মানুষ ব্যক্তিগত কারণে কোণঠাসা করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। তখন সাদিকুজ্জামান প্রস্তাব দিলেন, কবীর সুমনকে দিয়ে রবীন্দ্রসদনে একটা অনুষ্ঠান করা হোক। উনি একটা পয়সাও নেবেন না। সব টাকাই যাবে গুজরাট ত্রাণে। কয়েকজন আপত্তি তুললেন। আমাদের প্রবল আগ্রহে স্যার বললেন, কবীর সুমন গান গাইবেন, এতো আনন্দের কথা।
রবিবার সকাল ১০ টায় গুজরাট গণহত্যার ত্রাণ সংগ্রহে কবীর সুমনের অনুষ্ঠান। অনেকদিন পর কবীর সুমন অনুষ্ঠান করছেন। রবীন্দ্রসদন কানায় কানায় পূর্ণ। স্যার জানতেন, আমি সহজে আবদার করি না। করলে ছাড়ি না। কবীর সুমনের পর প্রতুল মুখোপাধ্যায়, শুভেন্দু মাইতি, অজিত পাণ্ডে, দোহার, নীলিম গঙ্গোপাধ্যায়, চন্দন বসু-সহ যে শিল্পীরা এতদিন আমাদের সঙ্গে রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়েছেন তাঁদের নিয়ে অনুষ্ঠান। সেখানে স্যারকে রাজি করালাম অনেক কষ্ট করে, আপনি বলবেন। হঠাৎ সভা শুরুর একটু আগে একজন এসে বললেন, অন্য একজন শুরুতে বলবেন। স্যার চুপ করে মেনে নিলেন। আমার ও বিশ্বজিৎদার খুব রাগ হয়ে গেল। তা দেখে স্যার বললেন, “তোমরা এ-নিয়ে কিছু বোলো না৷”
আমি শুধু বললাম, ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দুর্বলতা। উনি স্মিত হাসলেন। বললেন, “কথা দাও, এ-নিয়ে ওদের কিছু বলবে না৷” বললাম না বটে, মানতেও পারলাম না। স্যার গুজরাট সংহতি সমিতির প্রতিটা প্রকাশ্য সভায় থাকতেন, বলতেন না। ঘরোয়া বৈঠকে কিন্তু স্পষ্ট মত জানাতেন। এরপর গুজরাটে টাকা পাঠানো হবে। সিদ্ধান্ত হল, গুজরাট যাওয়া হবে না। টাকা পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আমি তীব্র আপত্তি করলাম। যাক, টাকা ব্যাংক মারফৎ গেল। কিন্তু ভাষা ও চেতনা সমিতির পক্ষ থেকে আমরা গেলাম গুজরাট। স্যারের সম্মতি নিয়ে, মহাশ্বেতা দেবীও গেলেন। তার আগেই গেছেন অশোক দাশগুপ্ত, তপন মিত্র, দিলীপ রায়, রঞ্জন সেনগুপ্ত।
আমরা সেবার হর্ষ মান্দারের উদ্যোগে গোধরা, মেহসানা, শাহ আলম ক্যাম্প ছাড়াও বহু জায়গায় যাই। গোধরায় গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করি। কবি অশোক বাজপেয়ী, অধ্যাপক অপূর্বানন্দ আমাদের সঙ্গে ছিলেন। ওই সময় বরোদার ত্রাণ শিবিরে দেখা হয় নবম শ্রেণির ছাত্রী জাহিরা ও তাঁর ভাইয়ের সঙ্গে। বরোদার বিধায়ক ছিলেন মুসলিম এবং তিনি বিজেপির লোক। কিন্তু কাউকে বাঁচাতে পারেননি। বিশিষ্ট সঙ্গীত সাধক ফৈয়াজ খানের মাজার রাতারাতি গুঁড়িয়ে দিয়ে রাস্তা করে দেওয়া হয়েছে। যাওয়ার আগে বেলডাঙার নজরুল সঙ্ঘ আমাদের মারফৎ ত্রাণ পাঠিয়েছিল। তা আমরা গুজরাটের ত্রাণকর্মীদের হাতে তুলে দিই। সান্ত্বনা সেনগুপ্ত ও অধ্যক্ষ সনৎবাবু মুখ্য ভূমিকা নেন। ফিরে আসার পর স্যার বললেন, “গিয়ে খুব ভাল করেছ৷”
আকাদেমি অফ ফাইন আর্টসের সামনে ফাঁকা জায়গায় সারাদিন পয়লা বৈশাখ উদযাপন করে আসছি ১৯৯৯ থেকে। ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে ঠিক হল, বাংলাদেশের মতো মুখোশ নিয়ে মিছিল হবে। ঢাকার মতো এখানেও সরকারি আর্ট কলেজকে যুক্ত করে। প্রয়াত জয়ন্ত চৌধুরী ও তৎকালীন অধ্যক্ষ কমলেশবাবু এ কাজে যথেষ্ট সাহায্য করেন। এবং আর্ট কলেজের অধ্যাপকমণ্ডলী ও ছাত্র-ছাত্রীরা বিপুল সহায়তা করেন।
বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিল্পী সৈয়দ হাসান ইমাম ও তাঁর স্ত্রী নৃত্যশিল্পী লায়লা হাসান এদেশে থাকার সময় আমাদের কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে ছিলেন। নানা বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর দু’জনে আমাদের একজন হয়ে উঠেছিলেন। বাংলাদেশ থেকে পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীদের যুক্ত করে দেন আমাদের সঙ্গে। বাংলাদেশ সরকারি চারু ও কারুকলা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন ছাত্রছাত্রী মেহেদী, টুটুল এল। ১০ দিন ধরে আমার বাড়িতে থেকে কলকাতার সরকারি আর্ট কলেজের ছাত্রছাত্রীদের মুখোশ বানানো শেখাল। সেই শুরু কাগজ দিয়ে নানা পশু পাখি র মুখোশ কর্মশালা। পরে একটা দুর্গাপূজাও হল মুখোশ ব্যবহার করে। ঠিক হল, এবার সকালে মিছিল হবে সরকারি আর্ট কলেজের সামনে থেকে।
শঙ্খ ঘোষ ও আমি মিলে নাম ঠিক করলাম, বৈশাখী যাত্রা। নববর্ষের সকালে সেই হাঁটা শুরু স্যারের। আমার মা এসেছিলেন সেবার। মায়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলাম। আমাদের সঙ্গে হাঁটছেন শঙ্খ ঘোষ, এ যে আমাদের কত বড়ো পাওয়না৷ শত ঝঞ্ঝাতেও আমরা সেই বৈশাখী শোভাযাত্রা বজায় রাখতে পেরেছি। সারাদিন পয়লা বৈশাখ ও ২০ ফেব্রুয়ারি সারারাত বাংলা ভাষা উৎসব উদযাপন অনুষ্ঠানে শঙ্খ ঘোষ বহুবার এসেছেন। সব বার উদ্বোধন করেননি, কিন্তু এসেছেন। উৎসাহ দিয়েছেন।
২০০৯-এ আয়লার সময় সুন্দরবন বিপর্যস্ত। আমরা মেটিয়াবুরুজের রেডিমেড ব্যবসায়ী সমিতির আলমগীর ফকিরদের সহায়তায় ত্রাণ নিয়ে গেলাম সুন্দরবনে। আমাদের পাশে থাকতে শঙ্খ ঘোষ সেদিন সকাল বেলায় এলেন বিজ্ঞান নগরীর সামনে। ভাষা ও চেতনা সমিতি গুজরাট, সুন্দরবন, হাওড়া, হুগলি, মালদা, রায়গঞ্জ, ইটাহার, কিংবা নেপাল যেখানেই ত্রাণ নিয়ে যাক- স্যারকে প্রণাম করে যেত। ২০০৯-এ আয়লার প্রথম ত্রাণ বিতরণ করে আসার পর স্যারকে জানালাম, সুন্দরবনের বাগবাগানে ৩২০০ মানুষের একটা যৌথ রান্নাঘর শুরু করে এসেছি। ওখানে তিন চারটে গ্রামে নিজেরা রান্না করে খাওয়ার কোনও উপায় নেই। শঙ্খ ঘোষ ছাড়া আরেকজন মানুষ ছিলেন অশোক মিত্র। তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করতাম। অশোক দাশগুপ্ত ও দেবাশিস ভট্টাচার্য সব বিষয়ে আমাদের সহায়তা করতেন।
তখন বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম নিয়ে ‘আমরা ওরা’ জোর ভাগ। ঠিক হল, অশোক মিত্র ও শঙ্খ ঘোষের আহ্বানে ত্রাণ সংগ্রহ হবে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের সামনে থেকে। কাকে ডাকা হবে আর কাকে নয়? আমি সবাইকে ডাকার পক্ষে। শঙ্খ ঘোষও সম্মতি দিলেন। অশোক মিত্র অসুস্থ শরীরে এলেন। নাট্যকার বিভাস চক্রবর্তী ও কবি সুবোধ সরকার তখন দুই শিবিরের অগ্রণী ভূমিকায়। দু’জনে একসঙ্গে কফি হাউসের দোতলায় উঠে কৌটা নিয়ে আয়লা ত্রাণের জন্য অর্থ সংগ্রহ করলেন। সঙ্গে ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত। পরে তৎকালীন কলকাতার মহানাগরিক বিকাশ ভট্টাচার্যকে ত্রাণ সংগ্রহে ডাকা নিয়ে দু একজন আপত্তি করলেন। এবারেও স্যার সহায়। বিকাশ ভট্টাচার্য, কবি শ্রীজাত, বিনায়ক, অধ্যাপক সব্যসাচী দেব, অভীক মজুমদারের সঙ্গে মিলে ত্রাণ সংগ্রহ করলেন।
স্যার সব জায়গায় আছেন। তীব্র রোদ। স্যার ঠায় দাঁড়িয়ে। ছাতা মাথায় দেবেন না। কারণ আমাদের মাথায় ছাতা নেই। তিনি যে আমাদের কাছে কত বড়ো ছাতা ছিলেন বলার নয়। এবারেও খুচরো গোনায় স্যার। বড়বাজারের বাগড়ি মার্কেট থেকে টর্চ, দেশলাই, সাবান, স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনে জমা করা হচ্ছে স্যারের বাড়ি। মশারি শত শত- স্যারের বাড়ি। ভোর পাঁচটার সময় চাল, ডাল, তেল, মশলা কিনে স্যারের বাড়ি থেকে সকালে ওইসব সামগ্রী তুলে দিনের পর দিন গেছি সুন্দরবন। স্যারের দুই নাতনি তখন ছোট, স্যারের সঙ্গে জিনিসপত্র বইতে বিপুল উৎসাহে হাত লাগাত।
একবার সবাই মিলে রান্নাঘর দেখতে এবং সাতজেলিয়া, বড়ো মোল্লাখালি, ছোটো মোল্লাখালি, কুমীরমারীর মতো দুর্গম অঞ্চলে ত্রাণ দিতে যাওয়া হল। সকাল সকাল বের হওয়া। আমরা চাল, ডাল, তেল, নুন কিনে নিয়ে ভোরে স্যারের বাড়িতে এসে বাকি জিনিস নিয়ে চলেছি। সেবার শঙ্খ ঘোষ নিজে চলেছেন আমাদের সঙ্গে। কবি সব্যসাচী দেব, লেখক গৌতম সেনগুপ্ত, কবি দীপঙ্কর, অধ্যাপক লেখক অভীক মজুমদার (সেই কোষাধ্যক্ষ), শিল্পী বিপুল অনু্শ্রী, শান্তনু বেজ, অভিজিৎ-সহ বড় একটা দল মিলে যাওয়া হল। বাগবাগানে দুপুরে যৌথ রান্নাঘরে খাওয়া।
ত্রাণ দেওয়া শেষ হল রাত নটায়। সাতজেলিয়া দুর্গম অঞ্চল। কলকাতা ফিরলাম রাত তিনটেয়। আমি তো স্যারের পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে কাদা। স্যারের কাঁধে মাথা পড়েছে, খেয়াল নেই। ঘরের কাছে এসে বললেন, ওঠো। স্যার কিন্তু একবারও ঘুমোননি। জাগা, জেগে থাকাও একটা ধর্ম। তিনিই তো শিখিয়ে গেছেন।