এবং রূপকথা
মেঘ পিওনের ব্যাগের ভিতরে সত্যিই আজ তারা তারা কাগজ জমেছে। এই দিস্তা বোঝাই মন খারাপ এখন কোথায় রাখি। ঋতুপর্ণ (Rituparno Ghosh) নেই, দেখতে দেখতে সাতটা বছর। ৩০ মে দিনটা যখন বছর ঘুরে আসে, তখনও হিসেব কষি। আসলে মনকে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করি। আমার জাঙ্ক জুয়েলারি থেকে শখের স্কার্ফ, যেটা মাঝে মাঝে মাথাতেও পাগড়ির কায়দায় বাঁধার চেষ্টা করি। পাঞ্জাবীর সঙ্গে ধোতি প্যান্ট গলায় বিডসের হার। সবেতেই মিশে আছে আমার ঋতুপর্ণ।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যখন কাজলে চোখ সাজিয়ে তুলি তখনও কাঁধের পাশে সরে যায় তাঁর অবয়ব। সত্যিই কী দেখলাম? নাকি মনের ভুল! কাজল পেন্সিল হাতেই ধরা, চোখটা কাঁধের পিছনে কী যেন খুঁজে ফিরছে। সন্দেহ তাঁর পছন্দ নয়, তাই অনুভবে ফিরে এলেন। সঙ্গে সেই ভুবন ভোলানো হাসি। না পরিবর্তনের ঋতুপর্ণ ঘোষ নয়, উনিশে এপ্রিলের ঋতুপর্ণ (Rituparno Ghosh) । যাঁকে আমি কখনওই ছবি ভাবতে পারিনি। আসলে প্রয়োজন হয়নি, স্রোতের বাইরের চালচলনে নিজেকে খুঁজে পাই, যারমধ্যে নিশিদিন ঋতুপর্ণ মিশে থাকে। আরও পড়ুন-Sonajharia Minz: জেএনইউ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা সোনাঝরিয়া মিনজ এখন স্বাধীন ভারতের প্রথম আদিবাসী মহিলা উপাচার্য
আমি তো আজকাল বছর ৫৭-র ঝকঝকে ঋতুপর্ণকেও দেখি। সাত বছরে তিনি আরও অনেক বেশি পরিণত। করিবরগার সিলিং দেওয়া পুরনো বাড়িতে আমার বাসা। আমার জানলায় যখন বেনেবউ খেলা করে বেড়ায়, তখন যেন দেখতে পাই ঋতু বসে আছেন, জানলা লাগোয়া এক ইজি চেয়ারে। সামনের বেতের মোড়ায় ঘুরছে বেনেবউ।
ঋতুর সযত্নে লালিত জুলফিতে সামান্য পাক ধরেছে, চোখে রিমলেস চশমা। পরণে ঘিয়া রঙা পাঞ্জাবি। যার গলা ও বুকের কাছে কিংখাপ মোটিফের কাজ। গলায় সোনাঝুরি বিজের একটা হার প্রায় চার ভাঁজ করে পরে আছেন। ঘিয়া রঙের উপরে সোনালী সূতোর নকশার সঙ্গে মিলেমিশে টুকটুকে লাল রঙের হার যেন বর্ষায় টইটম্বুর তিস্তা। আর কিংখাপ মোটিফ ডুয়ার্সের জঙ্গল। ডানহাতের তর্জনী গালে ছুঁইয়ে বুড়ো আঙুল চিবুকে খেলা করছে। ঋতু বলছেন, ‘আমি “ফেমিনিস্ট” নই বরং “উইমেনিস্ট” ফিল্মমেকার।’ আরও পড়ুন–“রোগ তো শরীরের হয়েছে, আমি আনন্দে আছি”
এই নিরন্তর বিদ্বেষ আর অসৌজন্যের বাতবরণে ঋতুপর্ণকে বড় দরকার ছিল। মন খারাপের বিকেলগুলোয় চোখ চলে যায় আয়নায়। দৃষ্টি খুঁজে ফেরে তাঁকে, বলতে ইচ্ছে করে একবার এসে দেখুন আপনার সাধের ভাষা আজ কত বিপন্ন। আম বাঙালি সেদিনও ঋতুপর্ণকে ভাল চোখে নেয়নি। তাই বলে ত্যাগ করার সাহসও দেখায়নি। সম্পর্কের জটিলতা নিয়ে যে খেলাটা তিনি ১৯ শে এপ্রিল থেকে শুরু করেছিলেন চোখের বালি-তে তার এক বৈপ্লবিক নিদর্শন দেখতে পাই। গা ভর্তি গয়নায় বিধবা বিনোদিনী, সমাজের চিরাচরিত চোখরাঙানিকে পাত্তা না দিয়ে যে নিষিদ্ধ ভাললাগায় নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছে। সেবার কালীপুজোর সময় বাড়ির অগোচরে প্রায় লুকিয়ে দেখা আমার প্রথম সিনেমা ‘চোখের বালি’।
গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের মনেও তৎকালীন বাঙালি বিধবাদের জীবনকথা নিয়ে প্রশ্ন জেগেছিল, তাইতো বঙ্গদর্শন পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে লিখলেন ‘চোখের বালি’। ১৯০৩ সালে বই আকারে সেই সামাজিক উপন্যাস প্রকাশিত হয়। আর ঠিক এক শতাব্দি পরে ২০০৩ এ ‘চোখের বালি’-র চলচ্চিত্রায়ন করলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ (Rituparno Ghosh)। রাইমা সেনকে আমরা নতুনভাবে দেখতে পেলাম ঋতুপর্ণের সিনেমায়। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় শুধু গ্রাম বাংলা মাতানো নায়কের বাইরেও যে একটা সত্ত্বাকে লালন করেন, তা দেখালেন ঋতু। শহুরে বাঙালি নতুন করে প্রসেনজিৎকে চেনার সুযোগ পেল ঋতুপর্ণের ছবিতে। যা টলিপাড়ার চিরপরিচিত বুম্বার ফিল্মিকেরিয়ারে নয়া দীগন্তের সূচনা, তাতে সন্দেহ নেই।কবজিতে চোট নিয়ে বিনা পারিশ্রমিকে অভিনয়, প্রতিশ্রুতি ও ভালবাসার নাম ইরফান খান
আসলে ঋতুপর্ণ (Rituparno Ghosh) ম্যাজিক জানেন, ১৯৯২ থেকে ২০১৩__এই ১৯টা বছরের জার্নিতে সৃজনশীলতায় ভর করে বাংলা বিজ্ঞাপনকে শুধু নয়, বাংলা ছবির জগৎকেও একটা ভিন্নমাত্রায় পৌঁছে দিয়েছেন। সংক্ষিপ্ত সৃজনকালে যা মণিমুক্ত ছড়িয়ে গিয়েছেন তাই নিয়েই চর্চা করি। আসলে মানুষটাকে চেনার চেষ্টা করি। পুরুষ নারীর যে দ্বন্দ্ব তিনি নিজের মধ্যে বারবার অনুভব করেছেন, তাই ফুটিয়ে তুলেছেন চলচ্চিত্রের অঙ্গনে। তবে সৃজনে কোনও খামতি ছিল না, বাধা গতের বাইরে বেরনো সিনেমা দেখে হল থেকে বেরিয়ে বাঙালি চোখ কোঁচকানোর সাহস পায়নি। তবে কখনওসখনও লোকচক্ষুর আড়ালে একেবারে একান্তে থেকে ভাবুক বাঙালি এমন বৈচিত্রময় ভাবনার ফসলের কারিগরকে বাহবা দিতে নিশ্চয় কার্পন্য করেনি।
ঋতু নিজেই কত বৈচিত্রময়, কখনও গ্রীষ্মের গা জ্বলিয়ে দেওয়া রোদ্দুর, তো কখনও ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। অথবা উদ্দাম কালবৈশাখী। ঘ্যানঘেনে বর্ষার শেষে যখন নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভেসে যায়, তখনই ঝিকমিকিয়ে ঋতু জানান দেয় মা আসছে। বাঙালি সমস্ত অভিমান ভুলে ফের তাকে ভালবাসতে শুরু করে। জীবনের ৫০টা বসন্ত কাটানোর পর প্রায় অধরা হেমন্তের বিকেলে কখনও ছাদে দাঁড়িয়ে যদি ফেলে আসা দিনগুলিকে তুচ্ছ জ্ঞান করার সাহস দেখাতে ইচ্ছে করে, তাহলে ঋতুপর্ণর (Rituparno Ghosh) ‘আবহমান’ আপনাকে দেখতেই হবে।
প্রকৃতি প্রেম খুঁজতে ঋতুর (Rituparno Ghosh) সৃজনে ডুব দেওয়ার দরকার নেই। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের যাঁরা অংশীদার সেইসব মানুষগুলোর ভিতরেও একটা অন্য মানুষ বসবাস করে। তাঁদের খুঁজতে ঋতুপর্ণর (Rituparno Ghosh) কাজ দেখা উচিত। মন না মানলেও পরিবার নামক ভেলাটাকে টিকিয়ে রাখতে সংসার সমুদ্রে যাঁরা ঢিল ছোঁড়েন না। মন কী ছাই এতকিছু বোঝে, আকবরের সভা থেকে সিরাজের মোতিঝিল, বাকিংহাম প্যালেস থেকে বুর্জ-খলিফা, সবেতেই তার অবাধ বিচরণ। সে কী করে বুঝবে মায়েদের নতুন করে প্রেমে পড়তে নেই। বাবাদের অনেক দায়। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ এক জায়গায় বলেছেন, যেদিন থেকে মানুষ প্রেমে পড়তে ভুলে যায়, সেদিন থেকেই তার বুড়িয়ে যাওয়ার শুরু।
মাঘের কনকনানি শীতে কখনও ভোরবেলা মাইল খানেক হেঁটে খেজুরের রস পান করেছেন? এটাও এক ধরনের প্রেম। সে যে সত্ত্বার মতোই আধারহীন। যে আধারে রাখবে তেমনই তার চেহারা হবে। তাইতো ফাগুন এলে পলাশ রাঙানো শান্তিনিকেতনে আমার মন ছুটে যায়। ঋতুপর্ণর (Rituparno Ghosh ) মধ্যে আমি শীত গ্রীষ্ম বর্ষার মতো বসন্তকেও দেখতে পাই। ঋতুপর্ণ ঘোষের লেখা, তিনি কলম ধরলে পাঠক বুঁদ হয়ে পড়ে। আর ক্যামেরার পিছনে চোখ রাখলেই আমরা প্রিমিয়ারের দিনটাকে ক্যালেন্ডারে লালকালিতে বুলিয়ে রাখি।
তিতলি দেখতে বসে কেন জানি না বার বার মনে পড়ছিল সম-র কথা, বুদ্ধদেব গুহর উপন্যাস। একই মানুষের প্রেমে পড়েছে মা মেয়ে। এই সোশ্যাল মিডিয়ার দুনিয়ায় তিতলি-র সমালোচকের অভাব হত না। কেউ মায়ের চরিত্র চিত্রণে ব্যস্ত হয়ে পড়ত, কেউ বা মেয়ের। মননশীল বাঙালি ঋতুপর্ণকে (Rituparno Ghosh) কতটা আজ স্মৃতিতে রেখেছেন আর কতটা বাস্তবে তা বিতর্কের বিষয়। তবে আমার দৈনন্দিনতায় তিনি রয়েই গিয়েছেন।
২০১২-র বসন্ত উৎসব মনে পড়ে। ‘ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল লাগল যে দোল’, আশ্রমে তখন প্রভাতফেরী শুরু হয়েছে। পাঠভবনের খুদেরা নাচতে নাচতে এগিয়ে চলেছে। সামনে থেকে সেই দৃশ্যকে লেন্সবন্দি করতে তৎপর সিনেম্যাটোগ্রাফার। পাশে নিজস্ব ছন্দে বিরাজমান সুদর্শন মানুষটি ঋতুপর্ণ ঘোষ (Rituparno Ghosh) । রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ঋতুর ডকু ড্রামা ‘জীবনস্মৃতি’। সেই শুটিংয়ে শান্তিনিকেতনেই শেষবারের মতো কর্মমুখর ঋতুপর্ণকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। কে জানত পরের বার তিনি শেষ ফাগুন দেখবেন।
মানুষের মনোজগতের অনেক জটিল সমীকরণকে কী এক সহজ ভাষায় সিনেমার পর্দায় ফুটিয়ে তুলতেন ঋতুপর্ণ। যা পাহাড় প্রমাণ সম্মানের বোঝা ঘাড়ে করে ফেরা মধ্যবিত্ত বাঙালিকেও কখনও কষ্ট করে বুঝতে হয়নি। বাংলা ভাষার প্রতি এমন প্রেম আর কোনও পরিচালকের মধ্যে দেখিনি। ২০১১-র বইমেলায় অনুষ্ঠিত কলকাতা লিটারারি মিটে অতিথি হয়ে এসেছেন সাহিত্যিক মহাশ্বেতাদেবী। সেদিন উপস্থাপকের ভূমিকায় ছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ (Rituparno Ghosh) ।
শৈশবে পাঠভবনে পড়েছেন মহাশ্বেতাদেবী, সেই সময় খুব কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর। তবে শিশু মহাশ্বেতা সেদিন কবিগুরুর মাহাত্ম্য বোঝেননি। বোঝার কথাও নয়। সেদিনের সেসব শিশুসুলভ স্মৃতি সাহিত্যিক তাঁর মনের মণিকোঠায় আগলে রেখেছিলেন, তারই দুএকটি ঝাঁপি খুলে বেরিয়ে এলেছিল বইমেলার সেই সাহিত্য সন্ধ্যায়। গুরুদেবকে নিয়ে বলছেন পছন্দের সাহিত্যিক সমাজকর্মী। তাঁর সঙ্গে সঙ্গত করছেন ভীষণ প্রিয় পরিচালক ঋতুপর্ণ (Rituparno Ghosh) । এই আনন্দসন্ধ্যা আমার সাংবাদিক জীবনের এক পরম পাওয়া।
ঋতুপর্ণ ঘোষ (Rituparno Ghosh) কখনও মহিলা বা পুরুষের মনস্তত্ত্বে নিজেকে বাঁধেননি। তাইতো কৌশিক গাঙ্গুলির ছবি ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’-তে দর্শক অন্য ঋতুপর্ণকে দেখার সুযোগ পেল। একটা সময় যাত্রাতে পুরুষরাই নারী সেজে অভিনয় করতেন। সেই সময়কার অভিনেতা চপল ভাদুড়ির চরিত্র অবলম্বনেই ঋতুপর্ণকে (Rituparno Ghosh) বাছা হল। সেখানে একটা জায়গায় ঋতুর (Rituparno Ghosh) সংলাপ যেন তাঁর জীবনচরিতকেই দিকনির্দেশ করে। ছবিতে ঋতু বলছেন, ‘মেয়েরা আলাদা, ছেলেরা আলাদা আর আমরা আলাদা।’ নিজেও পুরুষ বা নারীর কোনওটিই হতে চাননি। এরমধ্যবর্তী সত্ত্বাতেই ছিল তাঁর বাস।
বয়স যত বেড়েছে ঋতুপর্ণের (Rituparno Ghosh) সৃজন প্রতিভা ততই বাক পরিবর্তন করে নতুন কিনারা খুঁজে নিয়েছে। বাংলা সিনেমা পেয়েছে বুদ্ধিদীপ্ত ভাষা, চোখা চোখা সংলাপ। বাঙালি বিধবাকে রঙীন কাপড় থেকে শুরু করে গয়নায় সাজিয়েছেন ঋতু। তাঁর ছবিতে নিষিদ্ধ আকঙ্খায় সুখ খুঁজে নিয়েছে সেই নারী। সবেতেই ঋতু সাবলীল। বাঙালিও তাঁকে তাঁর মতো করেই ভালবেসেছে। তাই ঋতু (Rituparno Ghosh) বলেছেন ‘এ শহর (কলকাতা) আমাকে গ্রহণ করতে পারে না, আবার ফেলে দিতেও পারে না।’
এই অশান্ত সময়ে বাংলা ছবির ঋতুপর্ণ ঘোষকে (Rituparno Ghosh) বড় প্রয়োজন ছিল। বলিউডকে টলিপাড়ায় নিয়ে এসেছিলেন তিনি। বুদ্ধিদীপ্ত বাংলাছবির বাণিজ্যিকীকরণ ঋতুপর্ণ (Rituparno Ghosh) ভালোই জানতেন। যখন অবসরে ‘আংরেজি মিডিয়াম’, বা ‘পিকু’ দেখা শেষ করি, তখন ফের নতুন করে ঋতুর (Rituparno Ghosh) না থাকা আমায় রক্তাক্ত করে।
বলেছিলেন, ‘সত্যি যদি পরলোক বলে কিছু থাকে, তবে একদিন সন্ধেবেলা, পায়ে হেঁটে পৌঁছব সেখানে।’ সাতটা বছর হয়ে গেল ঋতু কী সেখানে পৌঁছলেন? এই খবর আজ আর আমায় কেউ এনে দেবে না। প্রতিদিন একটু একটু করে তাঁর না থাকার অনুভব আমার মধ্যে ঋতুপর্ণকে (Rituparno Ghosh) Sonajharia Minz: ঝাড়খণ্ডের সোনাঝরিয়া মিনজ এখন স্বাধীন ভারতের প্রথম আদিবাসী মহিলা উপাচার্যজাগিয়ে রাখে।