হাসির মল্লিক
শনিবারের এক মদিরাময় সন্ধ্যায় ফরাসি বন্ধু কোঁত-কে সঙ্গে নিয়ে প্রিন্স দ্বারকানাথ এসেছেন প্যারিসের মাবিয়ে গার্ডেনে৷ সন্ধে হতে না হতেই আলো ঝলমলে সেই গার্ডেনে ইতিমধ্যে এসে পৌঁছেছেন ফরাসি সমাজের নানা উচুঁ কেতার মানুষজন৷ বাগানের নানাদিকে সরকারি রক্ষীরাও পাহারায় মজুত৷
দ্বারকানাথ বন্ধুকে বললেন, কোথায় কুইন পেমেরো? কিজন হাজির করলেন পেমেরোকে৷ কিন্তু তিনি তো ডানাকাটা ফরাসি সুন্দরী মোটেও নন৷ বরঞ্চ তাঁকে দেখতে কুৎসিতই বলা যায়; তার উপরে পরিধানে কালো রাতপোশাক৷ এই সময় পুলিশ ও পেমেরোর হাতে দ্বারকানাথের সঙ্গী কিছু টাকা গুঁজে দিতেই নাচ শুরু হল৷ দেখতে খারাপ হলেও কুইন পেমেরো খাসা নাচেন৷ তাঁর নাচ দেখে বাবু দ্বারকানাথের মনে হল, নর্তকী মেয়েটির শরীরে কোনও হাড়গোড় নেই৷
নাচ দেখতে ব্যস্ত দ্বারকানাথ৷ তাঁকে ঘিরে ধরেছে ফরাসি লাস্যময়ীদের দল৷ তাদের কেউ কেউ ভারতীয় রাজার গায়ে, মাথায়, পাগড়িতে হাত বোলাচ্ছে, কেউ রাজার গায়ের দামি পশমিনা শালে আঙুল বুলিয়ে ঢলাঢলি করছে৷ ঠিক এ সময়ে এক লাস্যময়ী দ্বারকানাথের আঙুল থেকে খুলে নিতে গেল হিরের আংটি৷ সতর্ক দ্বারকানাথ হেঁকে উঠলেন, খবর্দার!
ঠিক এ সময়েই ওই সুন্দরীদের জটলার ভিতর থেকে আর একজন সুন্দরী ‘ভারতীয় ভাষায়’ দ্বারকানাথকে কিছু বললেন৷ তা শুনেই দ্বারকানাথ একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, কে এই মেয়েটি? তিনি জানালেন, ইনিই তো মিসেস জেমস৷ উনি কিছুদিন কলকাতায় ছিলেন৷ বিখ্যাত বারঙ্গনা! উনি এখন লোলা মঁতেজ৷ বিয়ে করেছিলেন জেমসকে৷
একথায় দ্বারকানাথের মনে পড়ে গেল, গভর্নর জেনারেল লর্ড অকল্যান্ডের বোন এমিলি ইডেনের সঙ্গে পরিচিতির সূত্রে তাঁর তৈরি করা বেলগাছিয়া ভিলার সুদৃশ্য বাগানবাড়িতে একরাত্রি এক নবদম্পতি ‘বাসর’ কাটিয়েছিল৷ এই কি সেই মিসেস জেমস? সেই এখন লোলা? যিনি কাকার সঙ্গে বিলেত থেকে সিমলায় এসেছিলেন! পরে বিয়ে হয়েছিল এক সিভিলিয়নের সঙ্গে?
দ্বারকানাথ মিসেস জেমসকে তাঁর সঙ্গে হোটেলে দেখা করতে বললেন৷ পরেরদিনই রবিবার সকালে মিসেস জেমস বাবু দ্বারকানাথের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন৷ “প্লাস ভাঁদোম”-এর হোটেল “দ্য রিন”-এ, কিন্তু সকালে দেখা হয়নি৷ দ্বারকানাথ ঘুরতে চলে গিয়েছিলেন ভার্সাইয়ে৷ ওখান থেকে ফিরে দ্বারকানাথ খেতে বসেছেন, সঙ্গে আছেন সদ্য ভারত থেকে আসা এক জেনারেল ও বন্ধু কোঁত৷ কোঁতের (কোঁত ফ্যুইয়ে দ্য কঁশ) আত্মকথা “জুর্নাল দ্যাঁ অক্টোজেন”-এ কোঁত লিখেছেন, সেসময় আবার মিসেস জেমস আসেন৷ তাঁকে পাশের ঘরে বসিয়ে, খাওয়া শেষ করে দ্বারকানাথ জেনারেল বন্ধুকে নিয়ে যখন সেই ঘরে ঢোকেন, তখনই মিসেস জেমস দ্বারকানাথের সঙ্গে সেই জেনারেলকে দেখে অজ্ঞান হয়ে যান৷ জ্ঞান ফেরানোর পর জানা গেল, ভারত থেকে আসা ওই জেনারেল জেমসের কাকা৷
জ্ঞান ফিরলে লোলাকে দ্বারকানাথ বললেন, কলকাতায় তোমাকে কত ভাল অবস্থায় দেখেছি৷ আজ এখানে এই অবস্থায় তোমাকে দেখব ভাবিনি৷ ঠিক করেছি, তোমাকে আমি ও জেনারেল মিলে বছরে ১৫ হাজার ফ্রাঁর একটি পেনশন দেবো; যদি তুমি তোমার এ জীবন ছেড়ে দাও৷ “যতদিন তুমি প্রকৃতিস্থ থাকবে, সংযত থাকবে”, টাকাটা নিয়মিত তোমার লাফিতের বাড়িতে জমা পড়বে, কিন্তু কেলেঙ্কারির খবর হলেই পেনশন বন্ধ হয়ে যাবে৷ বলো তুমি রাজি কি না? আরও পড়ুন-Haji Muhammad Mohsin: দানবীর হাজি মহম্মদ মহসীন ও ইমামবাড়া
লোলা কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে বললেন, “না না, আমি চাই না লক্ষ্মীমেয়ে হয়ে থাকতে, আমি পেনশন চাই না, আমি যেমন রানি আছি, তেমনই রানি হয়ে থাকব-৷” বলেই একখানা দামি শাল বিছানা থেকে টেনে নিয়ে গায়ে জড়িয়ে চলে গেলেন দ্বারকানাথের হোটেল থেকে৷ কোঁত জানিয়েছেন, লোলা সেই দামি শাল আর ফেরত দেননি৷ ([দ্বারকনাথ ঠাকুর] ডক্টর কৃষ্ণ কৃপালনী)
এ ঘটনা ঘটে দ্বারকানাথের প্যারিস সফরের দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৮৪৫-৪৬ সালে৷ সেবার তিনি ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত ফ্রান্সে ছিলেন৷ প্রথমবার ছিলেন মাত্র একপক্ষ কাল৷ সেই স্বল্প সময়ে ফ্রান্সকে আর কতটুকু দেখেছেন! দ্বারকানাথের দ্বিতীয়বারের প্যারিস সফরে যেমন ম্যাক্সমুলারের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়, তেমনই কোঁতের সঙ্গেও৷ দ্বিতীয়বারের প্যারিস ভ্রমণকালে ছেলে নগেন্দ্রনাথ ও ভাগ্নে নবীনচন্দ্রকে আর সঙ্গে আনেননি৷ তাঁদের বিলেতেই রেখে এসেছিলেন৷
দ্বারকানাথের এই পর্যায়ের প্যারিস ভ্রমণে দেদার খরচ ও ফূর্তির খবর রীতিমতো বিলেতের কাগজে খবর হয়ে ওঠে৷ প্যারিসে এসে একটা গোটা হোটেল ভাড়া নিয়েছেন৷ লটারির আসর বসিয়েছেন, পার্টি দিচ্ছেন, সুন্দরীদের দেদার হস্তে কাশ্মীরি শাল বিলোচ্ছেন, এমনকী, ডুয়েল পর্যন্তও লড়েছেন৷ সেসময় “কোর্ট জার্নাল” নামের বিলিতি খবরের কাগজে দ্বারকানাথের এ পর্যায়ের ভ্রমণকে আরব্য রজনীর গল্পতুল্য হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে৷ আরও পড়ুন-Susanna anna maria varkark: চুঁচুড়ার ওলন্দাজ ইতিহাসের স্মারক সুস্যানা আন্না মারিয়ার ভারকার্কের সমাধি
“বেঙ্গল হরকরা”-র লন্ডনের প্রতিনিধি “লিটারারি হেরল্ড”-র এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দ্বারকানাথের সে জীবন ছিল রূপকথার মতোই৷ তিনি ছিলেন, ভারতীয় ব্যাংকার৷ আমরা জানি, দ্বারকানাথ বিদেশে আসার জন্য সাধের বাগানবাড়ির সব ছবি ও আসবাবপত্র বিক্রি করে দিয়েছিলেন, তাঁর বিদেশ ভ্রমণের খরচ মেটাতে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে প্রতিমাসে দেশ থেকে একলক্ষ টাকা পাঠাতে হতো৷ এহেন রূপকথার রাজার পেনশন প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সুন্দরী লোলা, ঘটনাটি আশ্চর্যজনক বৈকি৷
লোলার জীবন নানান উত্থান-পতনে ঘেরা৷ দ্বারকানাথের সঙ্গে লোলার কাহিনীটি সুনীল গঙ্গ্যোপাধ্যায়ের “সেই সময়”-এ নেই৷ কৃষ্ণ কৃপালনী তাঁর বইতে উল্লেখ করেছেন৷ রাধাপ্রসাদ গুপ্ত লোলার কিছুটা পরিচয় দিয়েছিলেন৷ লোলা মঁতেজ বা লোলা মন্টেজ ছিলেন, আইরিশ৷ শৈশবে কাকার সঙ্গে সিমলা হয়ে কলকাতায় চলে আসেন৷ পরে কলকাতায় লোলার বিয়ে হয় জেমসের সঙ্গে৷ জেমস ছিলেন পেশায় লেফটেন্যান্ট৷ কলকাতায় থাকাকালীন জেমস ও লোলার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়৷ এর কিছুদিন পর অন্য এক মহিলার সঙ্গে ফের গাঁটছড়া বাঁধেন জেমস৷
এই সুযোগে ডিভোর্সি লোলাকে ইলোপ করে মাদ্রিদে পাড়ি দেয় এক ইংরেজ৷ সেখান থেকে ঘুরতে ঘুরতে প্যারিসে এসে থিতু হন লোলা৷ খেয়ে পরে তো বেঁচে থাকতে হবে, তাই নাচকেই পেশা হিসেবে বেছে নিলেন তিনি৷ তবে তাতে যখন সুরাহা করতে পারলেন না, তখন থিয়েটারে অভিনয় শুরু করলেন৷ এখানেও বিধি বাম, দর্শক লোলার অভিনয়কে স্বাগত জানাল না৷ এসব কথা তো আর পেট শোনে না৷ রুটি রুজির টানে অবশেষে ‘গণিকাবৃত্তি’কেই সাদরে বরণ করলেন লোলা৷ আরও পড়ুন-শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের প্রথম জন্মদিন পালিত হয় ১১০ বছর আগে
ভাগ্যদেবী যেন এতদিনে তাঁকে সঠিক দিশা দেখিয়েছেন৷ অর্থকষ্ট নিমেষে উধাও, লোলার জীবনধারাই পাল্টে গেল৷ এরপর মিউনিখে গিয়ে রাজা লুইয়ের মন ভুলিয়ে দিতে লোলা বেশি সময় নেননি৷ মোহগ্রস্ত লুই, লোলার নতুন নামকরণ করলেন, “সেনরো দ্য ব্যারি”৷ উপরি পাওনা হিসেবে মিলল ল্যান্ডসফেল্ড-এর “কাউন্টেস” উপাধি৷ এমনকী, লোলার আভিজাত্যের অংশীদার করতে ব্যাভেরিয়ার অভিজাত পরিবারের সেরা সুন্দরীদের প্রতিকৃতির মিউজিয়ামে তাঁর ছবি টাঙিয়ে দেওয়া হল৷
ততদিনে লোলার সৌন্দর্যের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে পশ্চিমের বিভিন্ন দেশে৷ স্বভাবতই সেই খ্যাতিকে কাজে লাগিয়ে দেশবিদেশের নামী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ালেন লোলা৷ তাঁর রূপেগুণে মোহিত করে দিয়েছিলেন রাশিয়ার নিকোলাসকে৷ সম্পর্ক হয়েছিল বালজাকের সঙ্গেও৷ ব্যাভেরিয়ার রাজা প্রথম লুডাভিসের অঙ্কশায়িনী থেকে মূল পরামর্শদাত্রী, সেই লোলা-ই৷ এই সময় দেশ পরিচালনাতেও নিজের দক্ষতা দেখিয়েছেন আইরিশ সুন্দরী৷
লোলা মঁতেজ বা লোলা মন্টেজের প্রকৃত নাম মারিয়া ডোলারেস এলিজা রোজানা গিলবার্ট৷ ১৮২১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি আয়ার্ল্যান্ডে তাঁর জন্ম হয়৷ রাধাপ্রসাদ গুপ্তের তথ্যমতে ১৮৪১ সালে ২৩ বছর বয়সে কলকাতায় আসেন লোলা৷ এরপর ১৮৪৬ সালে প্যারিসে দ্বারকানাথের সঙ্গে তাঁর পুনরায় সাক্ষাৎ হয়৷ ১৮৬১-র ১৭ জানুয়ারি, মাত্র ৩৯ বছর বয়সে মার্কিন মুলুকে এই অগুন্তি ওঠাপড়ায় সাজানো বর্ণময় জীবনের খোলস ছেড়ে মৃত্যুলোকে পাড়ি দেন লোলা৷ নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে লোলাকে সমাধিস্থ করা হয়৷ আরও পড়ুন-ওল্ড সেমেট্রি ও দার্জিলিংয়ের ইতিকথা
সময়ে দৌড়ের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া মনুষ্য জীবনের কর্ম নয়৷ দেখতে দেখতে ২০০ বছরের ঘরে পৌঁছে গেল লোলা মন্টেজের জন্মলগ্ন৷ বিশ শতকের গোড়াতেই ইংরেজি ও ফরাসি সাহিত্যে জায়গা করে নিয়েছে লোলা মঁতেজের জীবনচরিত৷ জার্মান ও ফরাসি চলচ্চিত্র জগতে এক অতিপরিচিত নাম লোলা মঁতেজ৷ ১৯২২ সালে জার্মান ভাষায় লোলাকে নিয়ে তৈরি হওয়া প্রথম চলচ্চিত্র “লোলা মন্টেজ, দ্য কিংস ড্যান্সার”৷ “স্পাইডার ড্যান্সে”র জন্য আজও নাচের রানি হয়ে আছেন লোলা৷ এই খ্যাতির আলো থেকে সরতে চাননি, তাইতো হেলায় প্রত্যাখ্যান করতে পেরেছিলেন দ্বারকানাথের পেনশন প্রস্তাব৷
কাশ্মীরি শাল নিয়ে সেই রাতে প্যারিসের হোটেল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আর কোনওদিনই লোলা- দ্বারকানাথের পারস্পরিক সাক্ষাৎ ঘটেনি৷ অন্যদিকে বিদেশ ভ্রমণ সেরে দ্বারকানাথের আর দেশে ফেরা হল না৷ প্যারিসেই অসুস্থ হয়ে পড়লে ইংল্যান্ডে ফিরে যান তিনি৷ সেখানে ১৮৪৭-এর ১ অগাস্ট ঠাকুর বাড়ির রাজা মর্ত্যলোকের যাত্রায় ইতি টেনে অমৃতের সন্ধানে পাড়ি দেন৷