চন্দননগর নামটা শুনলেই দুটো তিনটে জিনিস প্রথমেই মনে আসে, এক ফরাসী কলোনি, দুই জগদ্ধাত্রী পুজো, তিন আলোকসজ্জা। জগদ্ধাত্রী পুজোর জন্য সুবিখ্যাত হুগলি জেলার গঙ্গার পাড়ের এই শহর। তবে বিখ্যাত হওয়ার পিছনেও রয়েছে একটা লম্বা চওড়া ইতিহাস। একবার সেই ইতিহাসের অঙ্গনে চোখ রাখি। লোকমুখে প্রচারিত আছে যে ফরাসী সরকারের দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী এই পুজোর প্রবর্তক| এ কথা বহুল প্রচলিত যে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র আর ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর মধ্যে সখ্যতা ছিল| এক বার কৃষ্ণচন্দ্রের বাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজো দেখে পরের বছর ইন্দ্রনারায়ণ চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জ চালপট্টির নিচুপট্টিতে জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা করেন, এটিও চন্দননগরের আদি পুজো বলে পরিচিত| এখনও পর্যন্ত পুরুষানুক্রমে দেওয়ান চৌধুরীদের উত্তরপুরুষের নামে এই পুজোর সংকল্প হয়| তাই অনেকেই মনে করেন, ইন্দ্রনারায়ণের মাধ্যমে কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজো চন্দননগরে প্রবেশ করেছিল|
যদিও এ কাহিনি নিয়ে মতান্তর আছে| কেননা ইন্দ্রনারায়ণের মৃত্যু হয়েছিল ১৭৫৬ সালে| এদিকে ১৭৫৬-তে কৃষ্ণনগরে পুজোর প্রচলন হয়েছিল কি না তা নিয়ে দ্বিমত আছে| অন্যমত হল- লক্ষ্মীগঞ্জ বাজারের তৎকালীন চালের ব্যবসায়ীদের মধ্যে কেউ কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজো দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে এই পুজোর প্রচলন করেন| ১৭৯০ সালে সর্বজনীন বা বারোয়ারি পদ্ধতিতে এই পুজোর প্রারম্ভ হয়| যদিও কাপড়ে পট্টির ব্যবসায়ীরা বলেন আনুমানিক ১৭৬০সাল থেকে এই পুজো হয়ে আসছে, এটা যদি সত্যি বলে ধরে নেওয়া হয় তাহলে চালপট্টির থেকে এখানকার পুজো পুরনো| আরও একটি জনশ্রুতি আছে, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের দেওয়ান দাতারাম শূরের হাত ধরে এই অঞ্চলে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন ঘটে| দাতারামের বাড়ি ছিল ভদ্রেশ্বরের গৌরহাটি অঞ্চলে| এখানেই আনুমানিক ১৭৬২-র কাছাকাছি সময় দাতারামের বিধবা মেয়ে তাঁর বাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু করেছিলেন| গবেষকদের মতে এ পুজোতেও কৃষ্ণচন্দ্রের অনুদান ছিল| পরে পুজোটি স্থানান্তরিত হয় শিবতলা অঞ্চলে| পরবর্তী কালে মূলত আর্থিক কারণে পুজোটি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে গৌরহাটি অঞ্চলের বাসিন্দারা পুজোর দায়িত্ব নেন, সেই পুজোই আজ তেঁতুলতলার পুজো বলে প্রসিদ্ধ।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চন্দননগরের আলোকসজ্জা, জগদ্ধাত্রীপুজো এলে তার প্রমাণ হাতেনাতে মেলে। আবাসন থেকে পুজো প্যান্ডেল, পাড়ার গলি থেকে শুরু করে রাজপথ সবই প্রায় আলোয় মুড়ে থাকে। এইসময় লক্ষ লক্ষ মানুষের আগমন ঘটে চন্দননগরে| আনুমানিক ২৫০ বছর ধরে এই পুজোর ব্যবস্থাপনা, জাঁকজমক, ভক্ত বা দর্শক সমাগম, সব কিছুই পরিবর্তিত হয়েছে| এই পুজোর বহু বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রতিমার উচ্চতা ও ডাকের সাজের উল্লেখ করতেই হয়| তবে প্রথম থেকেই মায়ের মুখমণ্ডলের উচ্চতা ভূমি থেকে প্রায় ৪.৫ মিটার আর চালচিত্রের উচ্চতা এর দ্বিগুণ অর্থাৎ প্রায় ৯ মিটার হতো কি না, এনিয়ে সংশয় আছে। আগে হয়ত এমন প্রতিমা অল্প সংখ্যক সর্বজনীন পুজোয় হতো, এখন সেই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে| অল্প দু-একটা প্রতিমার ডাকের সাজে রং চোখে পড়ে, প্রায় সব প্রতিমারই সাজ, চালচিত্র সহ শুভ্র| শুক্লা ষষ্ঠী থেকেই দশমীর প্রতিমা নিরঞ্জনের শোভাযাত্রার দিন পর্যন্ত কয়েক লক্ষ দর্শক সমাগম হয় চন্দননগরে| সেই শুরুর দিন থেকে আজও অমলিন চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো, যা আলোকমালায় শহর সাজিয়ে আপনাকে অভ্যর্থনার অপেক্ষায় মুহূর্ত গুনছে। তাই দেরি না করে চলুন ঘুরে আসি।
ছবি সৌজন্য : সায়ান বারুলী, হুগলি
প্রতিমা : ফটকগোড়া জগদ্ধাত্রী