শীতের সকালের মিষ্টি রোদ্দুর দেখলেই মনে হয় বেরিয়ে পড়ি। করোনাকালে দূরে কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও সংক্রমণের ভয়টা এমন মানসিক চাপ তৈরি করে রেখেছে যে নিশ্চিন্তের ঘুম বাড়িতেই কাম্য। তাই যাবতীয় কোভিড প্রোটোকল মেনে দিনভর কাছেপিঠে ঘোরাঘুরি করাই যায়। তাইতো আগামী উইকএন্ডেই খাবারদাবার গুছিয়ে বেরিয়ে পড়তে পারেন বাঁশবেড়িয়ার (Bansberia) অনন্ত বাসুদেব মন্দিরের (Ananta Basudeba Temple ) উদ্দেশে।
Ananta Basudeba Temple: ৩৪১ বছরের পুরোনো মন্দির
হুগলী জেলাজুড়ে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তৎকালীন সপ্তগ্রামের একটি হল বংশবাটী বা আজকের বাঁশবেড়িয়া (Bansberia)। এখানেই রয়েছে পোড়া মাটির টেরাকোটা কাজের অনন্ত বাসুদেবের মন্দির (Ananta Basudeba Temple ) । ৩৪১ বছর আগে বাঁশবেড়িয়ার (Bansberia) রাজা রামেশ্বর দত্তরায় এই বিষ্ণুমন্দিরটি তৈরি করান।
বাঁশবেড়িয়ায় (Bansberia) ইটের তৈরি এই বিষ্ণুমন্দিরের গায়ে রয়েছে বাংলার টেরাকোটার অনন্যসাধারণ কাজ। রামেশ্বর দত্ত রায়ের জমিদারি প্রসঙ্গে চলে আসে তৎকালীন কোম্পানির শাসন, নবাবি আমল-সহ অনেক কিছুই। জমিদার রামেশ্বর দত্তের আদিবাড়ি বর্ধমানের পাটুলিতে। সেই সময় দিল্লির মসনদে রয়েছেন মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব। কোম্পানির শাসন তখনও জাঁকিয়ে বসতে পারেনি। বঙ্গদেশের জমিদাররা তখন নানারকম অজুহাতে মুঘল সম্রাটের রাজস্ব জমা দিতে গড়িমসি করতেন। এনিয়ে বঙ্গদেশের জমিদারদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমছিল আওরঙ্গজেবের মনে।
রামেশ্বর দত্ত রায় ছিলেন ব্যাতিক্রম। তিনি যথা সময়ে ছোট ছোট পড়শি জমিদারদের রীতিমতো ভয় দেখিয়ে রাজস্ব আদায় করে মুঘল রাজকোষে জমা দিলেন। সময়মতো রাজস্ব পেয়ে বেজায় খুশি আওরঙ্গজেব। রামেশ্বর দত্ত রায়কে আজকের বাঁশবেড়িয়া (Bansberia) তথা সেদিনের বংশবাটীর ৪০১ বিঘা নিস্কর জমি জায়গির দিলেন। সঙ্গে ১২ টি পরগনা, পঞ্চ পর্চা খিলাত ও বংশপরম্পরায় যাতে তাঁরা রাজা উপাধি ভোগ করতে পারেন তারজন্য সনদও লিখে দিলেন।
নতুন জমিদারি পেয়ে পাটুলি থেকে বাঁশবেড়িয়াতে চলে এলেন রামেশ্বর দত্ত রায়। ধীরে ধীরে বংশবাটী বর্ধিষ্ণু গ্রামের চেহারা পেল। তৈরি হল রাজবাড়ি। ১৬৭৯ সাল নাগাদ পরম ভাগবত রামেশ্বর দত্ত রায় বংশবাটীতে বিষ্ণু মন্দির তৈরি করালেন। ইটের তৈরি এই মন্দিরের গায়ে পোড়ামাটির টেরাকোটা কাজ আজও দর্শণার্থীদের চোখ টানে। উঁচু ভিত্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত এই মন্দিরটি লম্বায় ৩৫ ফুট ৮ ইঞ্চি ও চওড়ায় ৩২ ফুট ৪ ইঞ্চি। মন্দিরের শিখরটি আট কোণ বিশিষ্ট। চার কোণাকৃতি মন্দিরের তিনদিকে রয়েছে অলিন্দ। উত্তর দক্ষিণ ও পূর্বদিকের এই অলিন্দে রয়েছে তিনটি করে খিলান। আরও পড়ুন-ওল্ড সেমেট্রি ও দার্জিলিংয়ের ইতিকথা
বাঁশবেড়িয়ার (Bansberia) এই অনন্ত বাসুদেব মন্দিরের (Ananta Basudeba Temple ) পূর্বদিকে কোনও প্রবেশদ্বার নেই। বরং সেই দেওয়ালে অজানা শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় আমরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে দেখতে পাই। মন্দিরের স্তম্ভে কৃষ্ণের গিরি গোবর্ধন ধারণ, দেবাসুর যুদ্ধ, যুদ্ধের মধ্যে নারায়ণের আবির্ভাব। গোপিনীদের সঙ্গে কৃষ্ণ, সংকীর্তন, কৃষ্ণের কংসবধ। যশোদার দধি মন্থন, অশোক বনের মধ্যে সীতাকে সঙ্গে নিয়ে চলেছেন হনুমান। মন্দির গাত্রে টেরাকোটায় ফুটে উঠেছে এমনই অনন্য সব দৃশ্য।
কালের গর্ভে অনন্ত বাসুদেব মন্দিরের (Ananta Basudeba Temple ) দেওয়ালের সেই শিল্পকর্ম অনেকটাই মলিন হয়েছে। জায়গায় জায়গায় ভেঙেছে। তবুও তার শিল্প সৌন্দর্যকে কোনও অংশেই কম বলা চলবে না। ১৯০২ সালে বাঁশবেড়িয়ায় এই অনন্ত বাসুদেব মন্দির (Ananta Basudeba Temple ) পরিদর্শনে আসেন বঙ্গদেশের তৎকালীন ছোটলাট জন উডবার্ন। মন্দির গাত্রের টেরাকোটার শিল্পকর্মে তিনি মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন। মন্দিরের এক একেকটি ইটে যে কারুকাজ রয়েছে, তার ছবি তুলে যদি বাড়িতে বাঁধিয়ে রাখা যায় তাহলে সেই ঘরের শোভা কয়েক গুণ বেড়ে যাবে।
Ananta Basudeba Temple: অনন্ত বাসুদেব মন্দির ও রবীন্দ্রনাথ
অনন্ত বাসুদেব মন্দিরের (Ananta Basudeba Temple ) শিল্পকলায় মুগ্ধ ছিলেন রবীন্দ্রনাথও। তাঁর নির্দেশ পেয়ে প্রিয় ছাত্র তথা প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসু শান্তিনিকেতন থেকে এক মাসের জন্য বাঁশবেড়িয়াতে এসেছিলেন। অনন্ত বাসুদেব মন্দিরের (Ananta Basudeba Temple ) গায়ে থাকা টেরাকোটার কাজের যে সমস্ত নিদর্শন রয়েছে তার কপি করে নিয়ে যান তিনি।
এই মন্দির তৈরির প্রায় ১২১ বছর পরে পাশেই রামেশ্বর দত্তরায়ের প্রপৌত্র তথা গোবিন্দদেবের পুত্র নৃসিংহদেব মাতৃমন্দিরের শুভারম্ভ করেন। পরে তা বাঁশবেড়িয়ার (Bansberia) হংসেশ্বরী মন্দির নামে সবিশেষ পরিচিতি লাভ করে। যদিও জীবদ্দশায় মন্দিরের নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি নৃসিংহদেব। বছর ভর হংসেশ্বরী মন্দিরে দর্শণার্থীদের ভিড় লেগে থাকে। একই চৌহদ্দিতে রয়েছে অনন্ত বাসুদেবের মন্দিরটি।
বাঁশবেড়িয়াতে (Bansberia) পুজো দিতে আসা দর্শণার্থীরা বহু প্রাচীন এই অনন্ত বাসুদেবের মন্দিরটি দেখে এখনও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান। সেই রাজাও আজ নেই, নেই কোনও রাজপাট। তবে সেদিনের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে অনন্ত বাসুদেবের এই মন্দির Ananta Basudeba Temple । মন্দিরে এক সময় পূজিত হতেন অষ্টধাতুর বাসুদেব মূর্তি। বহুকাল আগে তা চুরি গেলে পাথরের বাসুদেব মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে ফের পুজো শুরু হয়। চার হাত বিশিষ্ট মূর্তির হাতে রয়েছে শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম। মূর্তির বাম কোণে নারায়ণ ও ডান কোণে লক্ষ্মী। আরও পড়ুন-Rituparno Ghosh: ঋতুপর্ণ ঘোষ ও এক ঋতু-ময় চিত্রকল্প
বয়স বাড়লে রোগ জ্বরা বাসা বাঁধবে। বাঁশবেড়িয়ায় ৩৪১ বছরের অনন্ত বাসুদেবের মন্দিরের (Ananta Basudeba Temple ) গায়ে পড়েছে বয়সের ছাপ। এখন মন্দিরটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ।
শীতের দুপুরে মন ভাল করা একটা ঐতিহাসিক ভ্রমণ সারতে চাইলে চলে আসুন হুগলির বাঁশবেড়িয়ায়। ট্রেনে চড়ে ব্যান্ডেল থেকে চার কিলোমিটার দূরের বাঁশবেড়িয়ায় (Bansberia) আসা যায়। হাওড়া থেকে সোজাও আসতে পারেন। তবে ট্রেনের সংখ্যা কম। রাত্রিবাসের জন্য এখানে রয়েছে বাঁশবেড়িয়া পুরসভার অতিথিশালা। কাটোয়া লাইনের বাঁশবেড়িয়া (Bansberia) স্টেশনে নেমে অটো টোটো সহযোগে চলে আসুন আপনার গন্তব্যে। হলফ করে বলতে পারি শতাব্দী প্রাচীন ইতিহাসের সঙ্গে দিনটা বেশ কাটবে।