সংযুক্তা
কাশ্মীরের (Kashmir) পৌরাণিক কাহিনী এক রূপকথার মতো। বলা হয় আগে কাশ্মীর ছিল এক মস্ত দিঘি, যেখানে এক জলদৈত্য বাস করত। বুদ্ধের আগমনে সে নাকি হিংসা থেকে অব্যহতি নেয়। তারপর কখনও আফগান, মোগল, ডোগরা এভাবেই হস্তান্তর হয়েছে। তখনও যুদ্ধ, এখনও যুদ্ধ, সময় বদলেছে কিন্তু পরিস্থিতি একই আছে। ইংরেজ এল কিন্তু এতটা উত্তরে থেকে রাজপাট সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ল। ডোগরা রাজার হাতে রাজ্য ভার দিয়ে বার্ষিক কর আদায় করতে লাগল: যার মধ্যে কাশ্মীরি শাল থেকে শুরু করে কার্পেটও ছিল। দেশভাগ হল। সেই প্রথম প্রশ্ন উঠল, ‘কাশ্মীর তুমি কার?’ হরি সিং এর জবাব এল স্বায়ত্তশাসন। এ ব্যাপারে ইংরেজ কোনও গতি করতে না পেরে সেই যে ভারত-পাকিস্তানের বোঝাপড়ার ওপর ছেড়ে দিয়ে গেল, আজও সেই বোঝাপড়াই চলছে।
দেশভাগ আর ডোগরা রাজার অত্যাচারে তখন মুসলিম ব্রাদারহুড চাগাড় দিচ্ছে। পাকিস্তান আদিবাসী আফগানের দল পাঠিয়েছে কাশ্মীরি ভাই-বোনেদের উদ্ধার করতে। লুটপাট, রাহাজানির সঙ্গে আর পেরে উঠতে না পেরে হরি সিং অগত্যা নেহেরুর দ্বারস্থ। তাড়ানো হল বহিরাগতদের। কিন্তু যেকোনও মুহূর্তে আবার হামলা হতে পার। তাছাড়া এভাবে বারবার সেনা পাঠানোও মুশকিলের। অতএব রয়ে গেল ভারতীয় সেনাবাহিনী। কিন্তু কাশ্মীরিরা চায় না কারোর অধীনস্থ হতে, এমনকী রাজা হরি সিংও চান না। এরপর লালচকের ঘণ্টা ঘরের সামনে পণ্ডিত নেহরুর সেই বিখ্যাত ভাষণ। কাশ্মীরি যুব সম্প্রদায় কাশ্মীরের (Kashmir) ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ঠিক সময়ে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে।
সরানো তো হয়নি, উপরন্তু আফস্পা জারি হল। কাশ্মীর যতদিন ভারতের সঙ্গে থাকবে, ততদিন পাবে বিশেষ এক মর্যাদা। সংবিধানে ৩৭০ ধারার যোগ হল। শোনা যায়, এই ধারা রচনা করতে গিয়ে বল্লভভাই প্যাটেলকে বহু কসরত করতে হয়েছে। এরপরের ইতিহাস কেবল অধিকার খর্ব, বঞ্চনা আর বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনীতে ভরপুর। কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে শেষ সিদ্ধান্ত নেওয়ার একদিন আগেই নেহরু চোখ বুজেছিলেন। সেই থেকে আজও পুরো দেশ চোখ বুজেই আছে। কত ইতিহাস যা হারিয়ে যাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে, বলা ভাল__বদলে দেওয়া হচ্ছে।
Kashmir: কাশ্মীর! এক বিভাজিত আখ্যান (পঞ্চম পর্ব)
“যা তোমরা শোনো দেখো, সব ঠিক নয়,” প্রৌঢ় বললেন। “জানি,” আমার ছোট্ট উত্তর। “তাহলে কি করছ তোমরা? কেন কিছু করতে পারছ না?” হতাশায় তীব্র গলার স্বর। “কে বলেছে কাশ্মীর (Kashmir) পাকিস্তানে যাবে? পাকিস্তান চাইলেই আমাদের নিয়ে নিতে পারবে?” “তবে এখানে কেন পাকিস্তানের পতাকা ওড়ানো হয়? পাকিস্তানের স্লোগান দেওয়া হয়?” আমার পাল্টা প্রশ্ন। এরপর ঠাট্টার হাসি হেসে বৃদ্ধের উত্তর, “আমাদের কথা সরকার শোনে? আমাদের কি কোনও গুরুত্ব আছে ভারত সরকারের কাছে? কানের সামনে বোমা ফাটালেও ফিরে তাকাবে না। দূর থেকে শুধু পাকিস্তান বলব, পুরো সরকার এখানে উঠে চলে আসবে। তাই ওই পাকিস্তান।”
কথাটা খুব মিথ্যে নয়। বেশ কয়েকজন যুবক, যাদের কেউ কেউ পাথরবাজ বটে, তারাও এই একই কথা বলেছে। সেনা চলে যাক, যাদের পাকিস্তানে যাওয়ার তারাও পাকিস্তানে চলে যাক, কাশ্মীর একটু একা থাকতে চায়। ওরা ভীষণ ক্লান্ত, আর খুন-রক্ত চায় না। একবিংশ শতাব্দীর ছেলে মেয়েরা এখন আর ধর্ম, জাত-পাত নিয়ে মাথা ঘামাতে চাইছে না। যত অন্ধকার ইতিহাস আছে ওরা বদলে ফেলতে চাইছে। আমার আপনার মতোই সুস্থ-রক্তপাতহীন জীবন কাটাতে চাইছে।
এত হারিয়েও তাই কাশ্মীরিয়ত হারায়নি। আমি কাশ্মীরের (Kashmir) যে প্রান্তে যার কাছেই থাকি না কেন, আতিথেয়তার কমতি পাইনি। নিজের মেয়েকে যেমন পরিবার আগলে রাখে, তেমনই আগলে আগলে রাখা হয়েছিল আমায়। লজ্জা-সংকোচে মুচড়ে গেছি। আমি হলে পারতাম? এতো কিছুর পরেও এভাবে পারতাম কোলের কাছে টেনে নিয়ে বসে হেসে হেসে গল্প করতে? শুধু কি খুন আর সরকারের নিন্দে? না, একদম না। বাড়ির গল্প, ছোটরা স্কুলের, কলেজের গল্প, ইয়ার্কি-ঠাট্টা সবকিছুই হয়েছে। হ্যাঁ, এতকিছুর পরও হয়েছে। আমি ভারতীয় জেনেও হয়েছে। হ্যাঁ, সবাই না, কেউ কেউ আমায় ভারতীয় মেয়ে বলে সেখানে। আমার এক হিমাচলী বন্ধু শুনে বলেছিল, “তুই যাস কেন ওখানে? খারাপ লাগে না নিজের দেশের লোক নিজেকে পর আর তোকে আলাদা করে ভারতীয় ডাকছে বলে?” “আমার খারাপ লাগে এক দেশে থেকেও জীবন সংগ্রামের এতটা বৈপরীত্য দেখে।
একজন ভারতীয় হিসেবে কী বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের থেকে ওদের এটাই প্রাপ্য?” বারবার যখন কৌতূহলের বশে জিজ্ঞেস করি আমার জন্য কেন এত আয়োজন? মনে হয় না এ বহিরাগত, ভারত থেকে এসেছে, একে দূর করে দিই? উত্তর বছরের পর বছর একই পেয়েছি, “লড়াই আমাদের ভারত সরকারের সঙ্গে, তোমার দোষ কোথায়? তোমার ক্ষতি করে আমাদের কি লাভ? আক্রোশ অনেক দেখেছি, আমরা চাই না আর কাউকে এরকম দেখতে হোক। এরকম জীবন কাটাতে হোক। “এবারেও তার অন্যথা হয় নি। আমি হলে কি পারতাম প্রতিশোধস্পৃহার ঊর্দ্ধে উঠে এভাবে বুকে জড়িয়ে ধরতে? আর যাওয়ার সময় কপালে উষ্ণতা এঁকে দিয়ে বলতে, “তোমার কথা খুব মনে পড়বে। এটা তোমার বাড়ি। যখন মনে হবে একটা ফোন করে সোজা চলে আসবে, অন্য কোথাও যাওয়ার দরকার নেই।” জানি না কি করতাম। এরকম জীবনই কাটাতে চাই না, বাকি সব কিছু তো পরের কথা।
Kashmir: কাশ্মীর! এক বিভাজিত আখ্যান (তৃতীয় পর্ব)
এতকিছুর পরেও যখন ওরা বলে, “ভারত সরকারের উপরে আমাদের পূর্ণ আস্থা ছিল। সে যে দলই হোক, সরকার মানুষের অধিকারে বিশ্বাস করে। তবে ৫ অগাস্ট ২০২১৯ আমাদের সব বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছে। কাশ্মীরের (Kashmir) সঙ্গে ভারতের দীর্ঘ বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস আবার জয়ী হল। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হল। আচ্ছা, কাশ্মীর কি ভারতের হল না কি ভারত অধিকৃত রাজ্য হল?” বৃদ্ধের প্রশ্নের জবাবে দু’জনেই হেসেছিলাম। উত্তরটা তো আমাদের পরস্পরেরই জানা। যেটা জানা নেই সেটা হল, বিশ্বের ইতিহাসে এমন গৃহবন্দি স্বাধীনতা কে কবে এর আগে পেয়েছে। একটা গণতান্ত্রিক দেশে দেশের মানুষের ভালমন্দ বিচার হচ্ছে মানুষকে আটকে রেখে, তাদের মুখ বন্ধ করে দিয়ে, তাদের রোজগার বন্ধ করে দিয়ে।
কাশ্মীর (Kashmir) এমন একটা জায়গা যেখানে সমস্যা কতটা আছে, বোঝা মুশকিল। তবে সমস্যা যে তৈরি করা হয়ে চলেছে যুগ যুগ ধরে এটা বলা যেতেই পারে। আর জানা নেই ৩৭০ ধারা থেকেও কি লাভ হচ্ছিল আর উঠিয়ে দিয়েও কি লাভ হল। বন্ধ দরজার পিছনে লাভা গনগন করছে। সরকার যদি মনে করে দীর্ঘ বন্দিদশা কাটিয়ে সবাই ক্লান্ত হয়ে কিংবা সরকারের সিদ্ধান্তে খুশি হয়ে হাসি মুখে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসবে, সেটা দিবাস্বপ্ন বা ছেলেমানুষির লক্ষণ। কারণ, আদ্যন্ত শান্ত, ভারত সমর্থক কাশ্মীরীকেও আমি গুমড়ে থাকতে দেখেছি।
Kashmir: কাশ্মীর! এক বিভাজিত আখ্যান (দ্বিতীয় পর্ব)
“ভালো লাগল তুমি এলে।” আমার গৃহকর্তা বললেন, “যা দেখলে সেটাই সত্যি। এই ইতিহাসও নষ্ট করে দেবে ওরা। মানুষ কোনওদিন আর আমাদের সত্যিটা জানতে পারবে না।“ মৃদু হেসে বললেন, “তুমি ফিরে গিয়ে বলবে আমাদের কথা? যা দেখলে তাই-ই বোলো।“
“নিশ্চয়ই বলব।”
“মে গড ব্লেস ইউ (ভগবান তোমার মঙ্গল করুন)।”
সরকারি পরোয়ানায় স্তব্ধ কাশ্মীর (Kashmir) আরও বেশি করে নিস্তব্ধ, নিজস্ব প্রতিবাদের ভাষায়। হরতাল ডেকে নিজেরাই দোকান-পাট বন্ধ করে রেখেছে। যাতে আমার মতো বহিরাগতদের কান এক অনন্ত স্তব্ধতায় ফেটে পড়ে, যাতে প্রশ্নরা ঝাঁক বেঁধে উড়ে আসে, “এখানে কি হচ্ছে?” “কেন হচ্ছে?” “কবে থামবে?” “কি করে থামবে?” প্লেনের জানালা দিয়ে ক্রমশ ক্ষুদ্র হতে থাকা উপত্যকা দেখে মনে হল, এই মূহূর্তে ভূস্বর্গ সমাধান নয়, প্রশ্ন চায়।