সংযুক্তা
১৯৯০ সাল থেকে আপামর দেশবাসী শুনছে কাশ্মীরি পণ্ডিতরা উপত্যকায় ফিরবে। মাঝে কংগ্রেস, বিজেপি কোনও দলের সরকারই বাদ যায়নি যে মসনদে চড়ে বসেনি। ভোট ফুরোলে আর পণ্ডিতেদের কথা কেউ ভাবে না। মোদি সরকার ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি ঘটালেন তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে- ১) “কাশ্মীরিরা গরীব, সেখানে উন্নয়ন হবে।” আদ্যন্ত মিথ্যে কথা। কাশ্মীর আমার ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় (বিশেষত উত্তরপ্রদেশ, বিহার) যথেষ্ট বিত্তবান, শিক্ষা-সংস্কৃতি, অর্থ সবদিক থেকেই। উত্তরপ্রদেশ বিহার, পাঞ্জাবের লোক ওখানে চাকরি করতে যায়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছিলেন কাশ্মীরের কথা, কিন্তু কল্পনা করছিলেন বিহার-উত্তরপ্রদেশকে৷ তাই চোখ ফেটে জল এসেছিল। এই প্রথম কাশ্মীরে একজন ভিখারি চোখে পড়ল, যে আবার কাশ্মীরি নয়। দেশের অর্থনীতির যা হাল, কাল কাশ্মীরি ভিখারি দেখলেও অবাক হব না। Kashmir: কাশ্মীর! এক বিভাজিত আখ্যান (প্রথম পর্ব)
২) “জমি অধিগ্রহণ তথা বাণিজ্য ও বিনিয়োগ৷” বক্তব্য হল, কাশ্মীরের জমি কিনতে পারা যায় না বলে নাকি ওখানে বিনিয়োগ হয় না। আবারও একটা আদ্যন্ত ভুল তথ্য। হ্যাঁ, ৩৫-এর ‘এ’ ধারা অনুযায়ী মাটিতে পড়ে থাকা কাশ্মীরের গাছের একটি পাতার উপরেও আমার আপনার কোনও অধিকার নেই৷ কিন্তু তার জন্য বিনিয়োগ বন্ধ নেই। এত হোটেল, ফুড চেন, বস্ত্র এসব চলে পার্টনারশিপে। আপনি জমি লিজ নিয়েও ব্যবসা করতে পারেন। এতদিন তাই-ই করেছে সবাই। অন্যান্য রাজ্যেও তো কম-বেশি এরকমই হয়৷ ডাল লেকের পাশে যে তাজ হোটেল বছরের পর বছর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে, সেটা টাটা সংস্থা কীভাবে করেছে? কি অসুবিধা হচ্ছে তাদের? জিওর টাওয়ার বসেছে, টাটা কম্যুনিকেশন অফিস খুলেছে, এগুলো হল কীভাবে? প্রশ্ন করবেন, এক দেশে থেকে জমি, গাছের পাতার উপরে আমাদের কেন অধিকার থাকবে না? তাহলে যান এই একই প্রশ্ন নাগাল্যান্ড, হিমাচল, অসম, মণিপুর, অরুণাচল এদের সকলকে গিয়ে করুন।
অরুণাচল নিয়ে চীনও তো কবে থেকে ভারতের রাতের ঘুম নষ্ট করছে৷ কই একটি বক্তৃতাতেও তো তার সুরাহা দূর, উল্লেখ পর্যন্ত নেই! দুই দেশের মহারথী দোলনায় দুলে গল্প করলেও না। তবে কেন শুধু কাশ্মীর? আসলে কাশ্মীর হল বাড়ির বউ বা মেয়ের মতো, ভারতের প্রেস্টিজ। পড়শি কে? না, এক ধসে পড়া রাষ্ট্র। পেশীশক্তি বা ক্ষমতা প্রদর্শন তো আসবেই। শুনুন, সমানে সমানে লড়াই হয়, কথাটা আসলে ভুল। আসলে অসমশক্তির মধ্যে লড়াই হয়। নইলে ভাবুন না, এক প্রস্থ কাশ্মীর যে চীনে আছে, যার লোভ এতটাই বেশী যে বারেবারে অরুণাচলে ঢুকে পড়ে সেখানে এত দিনে একটাও সার্জিক্যাল স্ট্রাইক হল না কেন? উল্টে কোলাকুলি, বিচে ঘোরা, সব হল৷ আর ওদিকে আপনি ‘চিনা দ্রব্য বর্জন করুন,’ ফেসবুকে স্টেটাস দিয়ে বসে আছেন। আর সম্প্রতি তো চিনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও পোক্ত হয়েছে।
তা যাই হোক, এক মধ্যে আরেকটা কারণ হল মেয়েরা বহিরাগতদের বিয়ে করলে সম্পত্তির ভাগ পাবে না। বা যে ছেলেরা বহিরাগত মেয়েদের বিয়ে করবে তারাও স্বামীর সম্পত্তির ভাগ পাবে না। বেশ বুঝলাম, যে সত্যিই অন্যায়। কিন্তু তার জন্য দশ লক্ষ লোককে বাড়িতে আটক করে রাখতে হবে? তিন তালাক বিলের মতো এখানেও কি মেয়েদের জন্য ৩৫-এর “A” ধারায় একটা সংশোধনী বিল আনা যেত না? Kashmir: কাশ্মীর! এক বিভাজিত আখ্যান (দ্বিতীয় পর্ব)
৩) “জঙ্গি দমন ও কাশ্মীরি হিন্দুদের প্রত্যাবর্তন৷” তাই! এভাবে হবে বলছেন? সরকার কি আশা করছেন যে কিশোর যুবকদের স্রেফ ‘হামলা করতে পারে’ ভেবে জেলে ভরেছেন, যেখানে যুবক-যুবতী ছাড়াও বাচ্চা বুড়ো কেউই বাদ যায়নি তারা কোনও এক তথাকথিত স্বঘোষিত স্বাধীনতা সংগ্রামীর মতো জেলে বসে মুচলেকা দেবে যে তারা এমন কিছু আর কখনও করবে না? বিশ্বাস করুন, এত কিছুর পরেও কেউ এমন মুচলেকা দেয়নি। কাশ্মীরের ইতিহাসে তা নেই। যারা আত্মসমর্পণ করেছিল তারা পাকিস্তানের বুজরুকি ধরতে পেরে করেছিল। এরা এখন জেলে, এরা কেন সংশোধনাগারে? কি সংশোধন করবে এরা? মিছিল করেছে বলে? বর্তমানে পয়তাল্লিশ হাজার বন্দিদের মধ্যে যাদের পাথর দূর অস্ত, মিছিলে হাঁটার বয়স হয়নি বা শারীরিক ক্ষমতা নেই এত সবের পর তারা কী সংশোধন করে বেরোবে?
ভারতের আইন অনুযায়ী, পুলিশের খাতায় নাম উঠলে সরকারি চাকরি ভুলে যান, কোথাও কোথাও বেসরকারি ক্ষেত্রেও চাকরি দেওয়া হয় না। ওই আট বছর, ১৯ বছরের ছেলে মেয়েদের কী ভবিষ্যৎ? এরাই যখন হতাশায় গর্জে উঠবে তখন জঙ্গি তকমা সেঁটে যাবে নামের সঙ্গে। ঠিক বলেছিলেন, কাশ্মীর একটা জঙ্গি তৈরির কারখানা, তবে কারখানার মালিক বা কারিগর কিন্তু অন্য কেউ। আর রইল পণ্ডিতদের কথা! ওঁরা হতাশ। ফিরতে সকলেই চান, তবে এই মূল্যে নয়। ভিটেমাটি ছেড়ে আসা কাশ্মীরি পণ্ডিত পেশায় প্রখ্যাত লেখক৷ তিনি লিখেছেন, “অনেক কষ্ট করে নিজেদের ফেলে আসা জমির দলিলপত্র উদ্ধার করেছিলাম। কাল ড্রয়ার থেকে সেগুলি বের করে নাড়াচাড়া করলাম। আর বোধহয় কোনও কাজেই আসবে না। যে ধারা এতদিন আমাদের সংরক্ষণ এবং নিরাপত্তার জন্য ছিল, আজ সেটাও নেই। আজ আমাদের জমি কেনাবেচাও হবে৷” Kashmir: কাশ্মীর! এক বিভাজিত আখ্যান (তৃতীয় পর্ব)
সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতির তালিকায় রয়েছেন কাশ্মীরি পণ্ডিত৷ কাশ্মীরিদের ক্ষমতা খর্ব করে ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি তিনিও মেনে নিতে পারেননি। মানেনি আরও অনেকেই। কাশ্মীরি পণ্ডিত তথা কংগ্রেস সাংসদ ৩৭০-এর অবলুপ্তিতে আক্ষেপ করে বলেছেন, “এই করে কেবল প্রচার হল, পণ্ডিতদের কোনও লাভ হল না৷” তাঁকে আপনারা কংগ্রেসি হওয়ার দায়ে খারিজ করতে পারেন, কিন্তু আর বাকিদের! বিতাড়িত হওয়ার অনেক আগে থেকে কাশ্মীরি পণ্ডিতরাই প্রথম জমি সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছিলেন৷ Kashmir: কাশ্মীর! এক বিভাজিত আখ্যান (চতুর্থ পর্ব)
যতই লাদাখি সাংসদের ঝাঁঝালো বক্তৃতা শুনে বাহবা দিন না কেন, ওদিকে কিন্তু লাদাখও এখন জমি সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে ফেলেছে। লাভের লাভ কিছুই হচ্ছে না। সেই রাজনীতিই চলছে। শূন্য থেকে শুরু করে শূন্যতেই শেষ হচ্ছে। এখনও সরকার তার পরিকল্পনার কথা জানাতে পারেনি। কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা তুলে নেওয়ার নেপথ্যে কী উদ্দেশ্য, এবং তার যথাযথ ব্যাখ্যা দেশের শীর্ষ আদালতকে এখনও দিয়ে উঠতে পারেনি কেন্দ্র। উপত্যকায় প্রকাশ্যে মৃত্যু কমলেও বন্ধ দরজার পিছনে চিকিৎসার অভাবে সেখানে মানুষ অহরহ মরছে। সরকার পরিকল্পনাহীন, ভীত, সেই পাইলটের মতো; যিনি ঘোষণা তো করে দিয়েছেন, তারপর থেকে কেবলই হোঁচট খাচ্ছেন। তাইতো বলে, “ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না৷”