পরিযায়ী পাখি, মন ভাল করা একটা বিষয়। পাখি দেখতে আমাদের কত না ভাল লাগে। তবে সভ্যতার ক্রমউন্নয়নে সেই পাখিরাও এখন হারিয়ে যাচ্ছে। আমি, আপনি, আমরা যেমন মাথার উপরে ছাদ ছাড়া একটা দিনও জীবনধারণ করতে পারব না সুষ্ঠুভাবে। ঠিক তেমনই পাখিরাও গাছ ছাড়া বাঁচবে না। এ তথ্য সকলেরই জানা, তবুও প্রতিদিন কত না গাছ কাটা পড়ছে। যত না প্রয়োজনে তার থেকে অনেক বেশি অপ্রয়োজনে। লোভের কাছে প্রতিদিন মাথা নত করছে সভ্যতার শ্রেষ্ঠ প্রাণী মানুষ। লোভের করাল গ্রাসে বিলীন হয়ে যাচ্ছে বনভূমি। নিজের লোকালয়েই দেখুন না, পাঁচ বছর আগে যত গাছপালা ছিল এখন কী আছে? আরও পড়ুন- নিশ্চিন্তে বেড়াতে যান, এই স্মার্ট গ্যাজেট এবার আপনার ফাঁকা বাড়ির খেয়াল রাখবে
আগে লোকজন বাড়ি করলে উঠোনে সবজির বাগান থাকত। একটু বেশি জমি থাকলে তো দু একটা ফলের গাছ, বাড়ির সামনে ফুলের বাগান, সাজানো লন। এখন সেটুকু জমিও বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। গৃহস্থবাড়ির লনের জায়গায় উঠছে হাইরাইজ। যে পাখির ঝাঁক দক্ষিণের ব্যালকনি থেকে প্রতিদিন ঘুম ভাঙাতো। এখন সেখানে কংক্রিটের দেওয়াল। ব্যালকনিটার অর্থই হারিয়ে গিয়েছে। বটানির শিক্ষিকা মধুরিমা ভেবেই পান না, কেন তাঁর শ্বশুরমশাই বাড়ির সামনের জমিটা বিক্রি করলেন। সুন্দর লন, সাজানো ফুল বাগান তো দিব্যি ছিল। জেলা সদরেও তো গাছ কমে যাচ্ছে। সেখানে তাঁদের বাড়িতে কত পাখি এসে বসত। এখন সেসব অতীত। শহর যতো বাড়ছে, ততই কমছে গাছ। আর আশ্রয় হারিয়ে পাখিরাও তত গ্রামের দিকে চলে যাচ্ছে। তাই তো পরবর্তী প্রজন্মকে সেভাবে আর পাখি চেনানোর সুযোগ হয়ে ওঠে না। ওই এক শীতকাল ছাড়া, সেসময় চিড়িয়াখানায় পরিযায়ী পাখি আসে।
হ্যাঁ এই পরিযায়ী পাখিদের জনগণনা বা আদমশুমারী হচ্ছে। শুনে কেমন অবাক হলেন তাইতো, তবে সত্যি সত্যিই এমনটা ঘটছে। আর ঘটনাস্থল তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারী। এই জেলায় হচ্ছে পরিযায়ী পাখিদের আদমশুমারী। ঠিক কত পাখি প্রতিবছর শীতে ভারতে চলে আসছে তাই গবেষণা করা হবে। সেই পাখি কোন প্রজাতির, কোন দেশ থেকে আসছে। মোটামুটি কতটা সময় এখানে থাকছে। বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন একটু একটু করে বাড়ছে গ্রিনহাউস গ্যাস। বরফ গলছে উত্তর মেরুর। ঋতুচক্রের পরিবর্তন এসেছে। সবমিলিয়ে পরিবেশের ভারসাম্যের ক্ষেত্রেও তারতম্য দেখা দিয়েছে। আরও পড়ুন-শুধুমাত্র কাছের মানুষকে প্রিয় মুহূর্ত শেয়ারের সুযোগ দিচ্ছে ইনস্টাগ্রাম, জানেন কীভাবে?
তবুও প্রতিবছর বড় অংশের পরিযায়ী পাখি ভারতে আসছে। সেই সংখ্যারই গণনা হবে এবার। চলতি বছরে গুজরাটের গান্ধীনগরে পরিযায়ী প্রাণীদের নিয়ে ৩০-তম কনফারেন্স হয়েছে। গত ১৫ থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলেছে এই কনফারেন্স। এই কনফারন্সেই জানা যায়, ঋতুচক্রের বদলের চিত্র এতটাই প্রকট যে পরিযায়ী পাখির গতিবিধি জানার কাজ শুরু হয়েছে। এই আদমশুমারীর কাজে বিরাট ভূমিকা নিতে চলেছে ভারত। কেননা কনফারেন্সে পরিযায়ী পাখি গণনার বিভাগে নেতৃত্ব দিচ্ছে দেশ। তিন বছরের জন্য এই পদ এখন ভারতের হাতে। তাই তামিনাড়ুতেই শুরু হচ্ছে পরিযায়ী পাখি গণনার কাজ।
জানা গিয়েছে, কন্যাকুমারীর বন দপ্তর এই আদমশুমারীর কাজ করছে। দুদিনের এই পাখি গণনায় দেখা হবে সারা দেশ কত রকমের পাখি কন্যাকুমারীতে আসছে। একই সঙ্গে সুদূর সাইবেরিয়া থেকেও কত পরিযায়ী পাখি কন্যাকুমারীতে ঋতু যাপনে আসছে। ভারতে অন্তত পাখি গণনার এই কাজ নিঃসন্দেহে ব্যাতিক্রমী। শীতকালে যখন বরফে মুড়ে থাকা সাইবেরিয়া পাখিদের জন্য দুর্গম হয়ে ওঠে তখন প্রাণ বাঁচাতে আগেভাগেই পরিযায়ী পাখির দল ভারতে চলে আসে। এই ঘটনা এখন নয়, বহুদিন থেকেই ঘটে আসছে। ওই পাখিদের কিন্তু কেউ বলে দেয়নি তারা প্রাণ বাঁচাতে কোথায় যাবে। তবে শীতকালের জন্য ভারতকেই উপযুক্ত বাসস্থান ভেবে নিয়েছে পরিযায়ী পাখির দল।
বনবিভাগ সূত্রে জানা গিয়েছে, পাখি গণনার তালিকায় একেবারে উপরে রয়েছে ফ্লেমিংগো। এই পাখি শীতের সময় স্পেন থেকে ভারতে চলে আসে। মধ্য এশিয়ার দেশগুলি থেকে ভারতে আসা পরিযায়ী পাখি হল ক্যানারি ও পিনটেল। এবং আন্টার্কটিকা থেকে আসে পেলিকানের ঝাঁক। গ্রামীণ ভারতের কত ঝিলে পাখির মেলা বসে যায় রীতিমতো। কিছু কিছু জায়গা তো পরিযায়ী পাখির জন্যই পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। তবে কত এমন অজানা ঝিল রয়েছে যেখানে পরিযায়ী পাখির দল ভিড় করে। আধুনিক সভ্যতার লোলুপ দৃষ্টি এখনও তাদের ছুঁতে পারেনি ভাগ্যিস। পাখি গণনা হোক, ঋতুচক্রের বদলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিযায়ী পাখিরা যেন তাদের শীতকালীন আবাস ভুলে না যায়। এই আশাটুকু তো সঞ্চয়ের খাতায় রাখতেই পারি, তাই না।