মশহ শিহাব
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমিকি ভুলিতে পারি।’ ভাষার জন্য বাঙালির প্রাণ বিসর্জন ৬৮ বছরে পড়ল। সে সময় পাকিস্তান দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল, বর্তমান পাকিস্তান তখন পশ্চিম পাকিস্তান আর বাংলাদেশ ছিল পূর্ব পাকিস্তান। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার যখন ঘোষণা করল, উর্দু হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এর প্রতিবাদে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাজপথে চলে আসে। ‘বাংলা হবে রাষ্ট্রভাষা’ এই দাবিতে প্রতিবাদী ছাত্রদের আন্দোলন থামিয়ে দিতে ঘাতক পুলিশ চালায় গুলি। শহিদ হন সালাম, রফিক, জব্বার, বরকত-সহ আরও অনেকে।
একুশের হত্যার প্রতিবাদে ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারিতেও আবার রাজপথে নামেন শিক্ষক, ছাত্র, রাজনীতিক, শ্রমিক, লেখক-সহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ। আবারও গুলি চালায় পাকিস্তানি পুলিশ বাহিনী। শহিদ হন শফিক, আওয়াল-সহ একদল যুবক। ভাষা আন্দোলনের শহিদদের স্মৃতি অম্লান করে রাখতে ১৯৫২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে গড়ে তোলে শহিদ মিনার। ৬৮-টি বছর ধরে একুশের সকালে ফুলে ফুলে ঢেকে যায় সেই শহিদ মিনার। সেখানে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেই ভাষা শহিদদের স্মরণে শ্রদ্ধা জানানো হয়। বাংলাদেশের কাছে একুশে ফেব্রুয়ারি আসলে জাতীয় শোকদিবস। আর সেই জাতীয় শোকদিবস ২০০০ সাল থেকে গোটা বিশ্বসভায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হয়ে গেল। আরও পড়ুন-সারারাত বাংলা ভাষা উৎসব, অ্যাকাডেমির উঠোনে রইল আমন্ত্রণ…
প্রতিবছর রাত ১২টা বেজে ১ মিনিটে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে ভাষা শহিদদের স্মৃতিতে প্রথম শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। ঠিক একই সময় গোটা বাংলাদেশের সমস্ত শহিদ মিনারে শুরু হয়ে যায় শ্রদ্ধা জ্ঞাপন পর্ব। তবে মধ্যরাতে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের এই অনুষ্ঠান খুব বেশিদিন আগে শুরু হয়নি। বছর ১৫ হবে, বা তারও কিছু বেশি। সঠিক দিনক্ষণ মনে করতে পারছি না। কথায় কথায় গত বছরের কথা মনে পড়ল। এত শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের মধ্যে কখন যে আত্মিক টান ক্ষয়ে যেতে শুরু করেছে বুঝতে পারিনি। তবে মর্মে মর্মে উপলব্ধির সুযোগটা পেয়েই গেলাম। ঠিক এক বছর আগে ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টায় শহিদ মিনার চত্বরে হাজির হয়েছিলাম।রাজধানী ঢাকা থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরের শহর মুন্সীগঞ্জ। সেখানকার কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারটি রয়েছে পুরনো কাছারি চত্বরে। একেবারে শিল্পকলা ভবনের পূর্বদিকে। পৌরভবনও ওই একই এলাকাতে অবস্থিত, রাস্তার উত্তরে।
রাত বারোটা নাগাদ সেখানেই জন প্লাবন। একসঙ্গে এত মানুষ চলে এসেছে শহিদ মিনারে। এমন জন প্লাবন রুখতে প্রশাসন থেকেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বাঁশ বেঁধে প্রবেশ ও বাহির পথ আলাদা করা হয়েছে যাতে কোনওরকম বিশৃঙ্খলা না হয়। এর ফলে হয়তো আগত লোকজনের কিছুটা সুবিধা হলেও শহিদ মিনারে প্রবেশের পথটি একেবারেই সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। ভাষা শহিদের স্মৃতিতে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছে। কিন্তু আচরণে তার বিন্দুমাত্র প্রমাণ পাওয়া গেল না। কাকে ঠেলে কে আগে যাবে, তাই নিয়েই চলছে প্রতিযোগিতা। সবাই সামনের সারিতে দাঁড়াতে চায়। আর ফুল দেওয়ার সময় তো নতুন হুজুগ দেখলাম, সেলফি। হ্যাঁ ঠিকই শুনলেন সেলফি। ২১ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টায় শহিদ মিনার যেন সেলফি জোনে পরিণত হয়েছে। কোথায় যেন ব্যথা অনুভব করলাম। যত না আবেগতাড়ির শ্রদ্ধাঞ্জলি, তার থেকেও অনেক বেশি দেখানোর চেষ্টা। বড় মেকি, মনটা খারাপ হয়ে গেল। আরও পড়ুন-মারণ টিউমার বাদ দিতে মাথায় চলেছে জটিল অস্ত্রোপচার, অপারেশন টেবিলে বেহালা বাজাচ্ছেন রোগিণী
২০ বছর আগে সোশ্যাল মিডিয়া বাংলাদেশকে এভাবে খেয়ে ফেলেনি। সেলফি তো দূর অস্ত। তখনও একুশে ফেব্রুয়ারি আসত। আর বছরভর বাংলা ভাষার এমন উদযাপনের দিনটির জন্য অপেক্ষা করে থাকত বাংলাদেশের মানুষ কই সেদিন তো এমন হুড়োহুড়ি ছিল না। ফেলে আসা ছেলেবেলায় মধ্যরাত নয়, ভোরের অপেক্ষায় মুহূর্ত গুনতাম। পূব আকাশে সূর্যের দেখা মিললেই শুরু হয়ে যেত শহিদ মিনারে যাওয়ার প্রস্তুতি। ঘুমচোখে হাতে হাতে ফুল নিয়ে আট থেকে আশি। গান গাইতে গাইতে গোটা বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে শহিদ মিনারের দিকে। জনস্রোতের মধ্যে থেকে সমবেত কণ্ঠে ভেসে আসছে, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমিকি ভুলিতে পারি।’ বসন্তের ভোরে তখনও শীত যাই যাই করেও রয়ে গিয়েছে। কী এক অসম্ভব ভাললাগায় মনটা ভরে উঠত। পূর্বসূরিদের সেই আত্মত্যাগ মনে করে শ্রদ্ধায় নত হয়ে আসত মাথা।
আজ একুশে নিয়ে কত আলাপ আলোচনা। কিন্তু বাংলা ভাষার উদযাপনে আমরা ভুলেই গিয়েছি সেদিনের বাংলা তারিখটা। ১৯৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারি ছিল বাংলা ৮ ফাল্গুন। আজ সব কেমন উল্টে গেল, যে বাংলাভাষার জন্য বাঙালি একদিন প্রাণ দিয়েছিল। সেই বাংলাভাষার দিবস পালিত হচ্ছে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার মেনে। আজ বেশিরভাগই মনে করতে পারবেন না, সেই দিনের বাংলা তারিখটা। বাংলা সন-ই এখন অচল হয়ে গিয়েছে। গণনার হেরফেরে ৮ ফাল্গুন বারবার ২০ ফেব্রুয়ারি পড়ে যাচ্ছিল। তাই দেশের সরকার বাংলা ক্যালেন্ডারই বদলে দিল। যখন ৮ ফাল্গুনকে ফিরিয়ে আনার সৎ প্রচেষ্টা দেখতে পাচ্ছি, তখন তো একুশের শ্রদ্ধা জ্ঞাপনও মধ্যরাত থেকে ফের ভোরবেলা ফিরতে পারে। সেই যে ঊষাকালে যখন সুয্যিমামা একটু একটু করে আলো ছড়াতে শুরু করে। যার অভ্যর্থনায় ঘুম ভাঙে বাংলার নদী, মাঠঘাটের। তাহলে হয়তো সেলফি প্রেমীদেরও চেতনা ফিরবে, একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু মাতৃভাষা দিবস নয় বাংলাদেশের জাতীয় শোকদিবসও।