সংযুক্তা
কাশ্মীর! (Kashmir) প্লেনের চাকা রানওয়ে ছুঁয়েছে, পাইলট তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই মিনিট তিনেক পরে সহযাত্রীদের শ্রীনগরে স্বাগত জানালেন। চিরাচরিত ঘোষণাতে কর্ণপাত না করে সবাই সিটবেল্ট খুলে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত। হঠাৎ হাসির রোল। কী ব্যাপার!
পাইলট ঘোষণা করেছেন, “এবার আপনারা মোবাইল ব্যবহার করতে পারেন।“পাইলটের গলায় অস্বস্তি স্পষ্ট। আড়াই মাস যেখানে যোগাযোগ স্থাপনের সমস্ত রাস্তাই সরকারি নির্দেশে বন্ধ, সেখানে এহেন ঘোষণা হাস্যকর তো বটেই। পাইলটও নিজের ভুল বুঝতে পেরে ভীষণ অস্বস্তিতে পড়েছেন। নইলে কে কবে কোন পাইলটকে আমতা আমতা করে ঘোষণা করতে শুনেছে! গন্তব্যস্থলে পৌঁছে জানতে পেরেছিলাম গত আড়াই মাসে মোবাইল ব্যবহারের ঘোষণা সমস্ত পাইলটই সযত্নে এড়িয়ে গেছেন।
প্লেনের ভিতরের ওই হাসিটা আমার এবারের কাশ্মীর (Kashmir) অভিযানের সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল। কাঁটার মতো বিঁধেছিল প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। যেদিকে তাকাই যার দিকেই তাকাই সর্বত্রই এক প্রশ্ন, “কেমন দেখছ কাশ্মীর? চিনতে পারছ এই কাশ্মীরকে?” জনমানবহীন কাশ্মীর আগে কখনও দেখিনি এমন নয়, তবে এবারের নিস্তব্ধতা যেন অনন্তকালের এক স্তব্ধতা। মানুষের মুখে হাসি লেগে থাকলেও চোখে একরাশ ক্লান্তি, আর সারা শরীরে বিষণ্ণতা ছড়িয়ে আছে। কীরকম হতে পারে নিজের জন্মভূমিতে আড়াই মাসের গৃহবন্দিদশা? আমার অভিজ্ঞতার শুরু।
এবারের কাশ্মীর (Kashmir) যাত্রা বেশ সংশয়পূর্ণ ছিল মূলত তিনটি কারণে। ১) ভারত সরকার যেকোনও সময়ে বহিরাগতদের এয়ারপোর্ট থেকেই বিদায় জানানোর আদেশ জারি করতে পারেন। ২) যাকে খবর দিয়েছিলাম আমায় এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য সে আদৌ পৌঁছাতে পেরেছে কি না। কতো কাঠখড় পুড়িয়ে তাকে আমার আসার খবর পৌঁছাতে পেরেছি সেটা আরেক গল্প। ৩) আড়াই মাস ধরে চলতে থাকা দুর্দশায় এই প্রথম কাশ্মীরিদের মুখোমুখি হতে চলেছি; তাও আবার কাশ্মীরের মাটিতে। তাদের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারব তো? তাদের অভিযোগ-আক্রোশ সামলাতে পারব তো? আমার কাশ্মীরি সহযাত্রী কিছুটা সংকোচ কাটাতে সাহায্য করলেও, আগামী দিনগুলি কীভাবে কাটতে চলেছে তা নিয়ে অবশ্যই চিন্তিত ছিলাম।
যাঁর আমাকে নিতে আসার কথা ছিল তিনি ঠিক সময়েই পৌঁছেছিলেন। প্ল্যাকার্ডে নিজের নামের ভুল বানান দেখে আর শুধরে দিতে ইচ্ছে হয়নি। কত ভুলই তো হয়ে চলেছে, যা কিছু মানুষ বাহাত্তর বছর ধরে শুধরে উঠতে পারেনি, সেখানে আমার নামের বানান শোধরানোটা না হয় তোলা থাক। গাড়িতে উঠে জানলাম আমার শ্রীনগরে থাকা হচ্ছে না, যেতে হবে অনন্তনাগে। অনন্তনাগ! কাশ্মীরের (kashmir) অন্যতম স্পর্শকাতর জেলাগুলোর মধ্যে একটি। যাওয়ার পথে পুলওয়ামা হাইওয়ে যেখানে ২০১৯ এর ১৪ ফেব্রুয়ারির ঘটনার আঁচ সীমান্তের বাইরে পর্যন্ত পৌঁছেছিল৷ ঠিক সেই জায়গাটা দিয়েই আমাদের যেতে হল। আরও পড়ুন-Shankha Ghosh:“আমার বলে রইল শুধু, বুকের ভিতর মস্ত ধু ধু”
অনন্তনাগে পৌঁছে রাস্তার দু’ধারে বেশ কিছু পুরোনো বাড়ি চোখে পড়ল যেগুলোর মূলত জানলার কাচ ভাঙা। আমার সহযাত্রীকে জিজ্ঞেস করতে জানতে পারলাম, এসব কাশ্মীরি পণ্ডিতদের বাড়ি। অবাক হলাম! অনন্তনাগের মতো জায়গায়, যে জায়গা কিনা ১৯৮৯ সালে কুখ্যাত হয়ে উঠেছিল কাশ্মীরি পণ্ডিত নিধন বা তাড়ানোর জন্য৷ যে জায়গা ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার জন্য প্রসিদ্ধ, সেখানে এত বছর পরেও বাড়িগুলো খালি পড়ে আছে! কেউ দখল করেনি! উত্তর এসেছিল, “কেন করবে না! তবে আমরা করিনি, ভারতীয় সেনা করেছে। এই বাড়িগুলোর বেশিরভাগই এখন সেনা ছাউনিতে পরিণত হয়েছে৷” দেখলামও তাই। কিছুক্ষণ থেমে আবারও বললেন, “আমরা জানি বাইরে কী খবর রটেছিল। আমরা পণ্ডিতদের উচ্ছেদ করে তাদের বাড়ি জবরদখল করেছি। পুরোটা যে মিথ্যে সেটা বলব না, তবে যতটা রটেছে, তাঁর কিঞ্চিৎই ঘটেছে৷”
আর কৌতূহল চাপতে পারলাম না, জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, “কাশ্মীরি পণ্ডিতদের সঙ্গে সেদিন কী ঘটেছিল?” উত্তরটা আমার যদিও জানা এবং সেটা প্রচলিত ইতিহাসের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন৷ তবুও উঠল যখন কথা… উনি বললেন, “আপনারা কি ভাবেন আমরা জানি। আমরা ওঁদের প্রাণের পিছনে আদাজল খেয়ে লেগে পড়েছিলাম তাই তো? তাহলে আজও কাশ্মীরে (Kashmir) পণ্ডিতরা থাকছেন কী করে? অবস্থা সেদিনও খারাপ ছিল, আজও খারাপ। জঙ্গি তখনও ছিল আজও আছে৷” প্রশ্ন করলাম, “তবে কয়েক লক্ষ পণ্ডিত যে ভিটেছাড়া হয়েছিলেন, কত পণ্ডিতকে মেরে ফেলা হয়েছিল, সব মিথ্যে?” উত্তর এল, “মিথ্যে কেন হবে! পণ্ডিতরা এখান থেকে চলে গিয়েছিলেন তো, তবে এর পিছনের কারণটা মিথ্যে। ওঁদের বাড়ির প্রতি আমাদের কোনও লোভ ছিল না। ১৯৮৯ তে যা ঘটেছে সেটা সম্পূর্ণই রাজনৈতিক ব্যাপার৷ যাকে ধর্মীয় আঙ্গিকে আপনাদের কাছে তুলে ধরা হয়েছে৷” আরও পড়ুন-COVID-19 Outbreak In Timbuktu: পৃথিবীর শেষপ্রান্ত টিম্বাকটুতে এবার করোনাভাইরাসের থাবা
সর্বপ্রথম যে প্রশ্ন আমার মনে আসে সেটি হল সেনায় মোড়া এক রাজ্যে এই দাঙ্গা আটকানো কতটা অসম্ভব ছিল?(নিরপেক্ষ) ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে কাশ্মীরের (Kashmir) প্রথম সশস্ত্র বিদ্রোহের প্রবর্তক মকবুল ভাট, যিনি কিনা কাশ্মীরের ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’ অর্থাৎ ‘না হিন্দুস্থান, না পাকিস্তান’ এর দাবিতে জম্মু-কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্ট স্থাপন করেছিলেন৷ ভারত সরকার তাঁকে ফাঁসিকাঠে তুলেছিলেন ১৯৮৪ সালে। মকবুল ভাটের মৃত্যুর পর কাশ্মীরে ঠাণ্ডা লড়াই শুরু হয়েছিল৷ যা পরবর্তীকালে গৃহযুদ্ধে পরিণত হয়। সেই ইতিহাস আমার আপনার সকলেরই অল্পবিস্তর জানা। তবে যা জানা নেই তা শুরুর ইতিহাস।
কাশ্মীর (kashmir) তখন ক্ষোভে ফুটছে। মকবুলের শেষকৃত্যে বাড়ির লোককে থাকতে দেওয়া হয়নি। মকবুলের মরদেহ বা তাঁর ব্যবহৃত কোনও জিনিস স্মৃতি হিসেবে বাড়ির লোককে দেওয়া হয়নি। এহেন অবস্থায় বরাবর ভারতের মুখাপেক্ষী পণ্ডিতদের উপরে চোখ পড়ল মকবুল ভাটের উত্তরসূরিদের৷ ইয়াসিন মালিক ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। গোপনে ভারত সরকার বা র’কে খবর পাচার করার সন্দেহে কয়েকজন পণ্ডিত যারা রাজনীতিতেও সক্রিয় ছিলেন, তাঁদের মেরে ফেলা হল। শুরুটা এভাবে রাজনৈতিক খুন দিয়েই হয়েছিল৷ যা দিনে দিনে বহিরাগত শক্তি অর্থাৎ পাকিস্তানের মদতে এবং ভারত সরকারের স্বার্থপর মৌনতার কারণে ইতিহাসে এক ‘কলঙ্কিত অধ্যায়’ হিসেবে জায়গা পেয়েছে।
আজও মুসলিম-পণ্ডিত নির্বিশেষে কাশ্মীরিরা (Kashmir) মনে করেন সেইদিন সরকার চাইলে এই অঘটন ঘটাকে আটকাতে পারত। কিন্তু ইয়াসিন মালিকের থেকেও ভারত সরকার পণ্ডিতদের বেশি ভয় দেখিয়েছিলেন। তাদের বুঝিয়েছিলেন যে, তাঁরা থাকাকালীন এই দাঙ্গা ঠেকানো সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। তাঁরা চলে যাক, তারপর সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে কাশ্মীর (Kashmir) শান্ত করলেই পণ্ডিতরা ফিরে আসতে পারবেন। সব ব্যবস্থা খরচ সরকারের দায়। কেউই যে কথা রাখেনি সেটা আলাদা করে আর বলে দিতে হয় না। সরকার এসেছে, গেছে৷ ইয়াসিন মালিক প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে গেছে৷ চেনাব দিয়ে কত জল গড়িয়ে গেছে, কিন্তু পণ্ডিতদের আর ঘরে ফেরা হয়নি। রাজনীতির স্বার্থে ১৯৮৯-এর ভয়কে ভারতের সরকার (সে যে সরকারই হোক) আজও জনগণের মনে জিইয়ে রেখেছে। আরও পড়ুন-Rituparno Ghosh: ঋতুপর্ণ ঘোষ ও এক ঋতু-ময় চিত্রকল্প
তাই আজও কাশ্মীর নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রশ্নবাণ ধেয়ে আসে ‘পণ্ডিত বিতাড়নের কথাও তবে হোক৷’ একশো বার হোক৷ তবে সেটা সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের মধ্যে ঝামেলা করে নয়৷ সরকারের উপরে চাপ সৃষ্টি করে। হুরিয়তের প্রধান নেতা গিলানিও পণ্ডিতদের পুনর্বাসনের আহ্বান জানিয়েছিলেন৷ তবে ভারত সরকার প্রস্তাবিত পণ্ডিতদের জন্য সম্পূর্ণ আলাদা কলোনিকে খারিজ করে। এতে ভারত সরকারের সুবিধাই হতো। সময় অসময়ে হিন্দু-মুসলিম বৈপরীত্য সারা দেশকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো যেত। আবার বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ক্ষেত্রে স্বাধীন কাশ্মীর (Kashmir) বা পাকিস্তান অন্তর্ভুক্তির দাবি জানানো মুশকিল হয়ে যেত। তাই আজও পণ্ডিত পুনর্বাসন ঠাণ্ডা ঘরেই চাপা পড়ে আছে।
অবশেষে পৌঁছালাম বন্ধুর বাড়ি৷ যেখানে আমার এ যাত্রায় থাকার কথা। এবার আরও অস্বস্তিতে পড়লাম। বারবার মনে হচ্ছিল এঁদের হয়তো বিরক্ত করা হয়ে যাচ্ছে। তখনও বুঝতে পারিনি আগামী সময় কীভাবে কাটতে চলেছে। একের পর এক ঘটে যাওয়া ঘটনায় কেবল অবাক আর অপ্রস্তুত হওয়ার পালা।
ক্রমশ…
2 thoughts on “Kashmir: কাশ্মীর! এক বিভাজিত আখ্যান (প্রথম পর্ব)”
Madhurima
(25th আগস্ট 2021 - 11:37 অপরাহ্ন)খুব ভালো লাগল। কাশ্মীরি পণ্ডিত ও কাশ্মীরের বর্তমান অবস্থা নিয়ে জানা গেছে এবং জানানো খুব প্রয়োজন। সঙ্গে রইলাম।
bongmag
(28th আগস্ট 2021 - 11:36 অপরাহ্ন)ধন্যবাদ, লেখাটি শেয়ার করে আরও অনেককে পড়ার সুযোগ করে দিন৷