মোঃআব্দুল্লাহ আলমামুন (বাংলাদেশ)
যখন শুরু করেছি কিছু লিখব বলে, তখন আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা আর ক্রমাগত ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। এই বৃষ্টির নাম দিলাম শরতের বৃষ্টি বিলাস। বাঙালির জীবন মানসে এক অনন্য জায়গা জুড়ে আছে এই শরৎকাল। কাশের বনে লাগে দোলা, নীল আকাশজুড়ে সাদা মেঘের ভেলা৷ শরৎ এলেই কানে আসে ঢাকের বাদ্যি৷ দুর্গা মায়ের (Durga Puja ) আগমনী ডাক। ধর্মতত্ত্বের আঙিনা ছাড়িয়ে সেই কতকাল আগেই বঙ্গজীবনের সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে উঠেছে এই দুর্গাপুজো।
বিষয়টা একটু স্পষ্ট করেই বলি। আমার কাছে দুর্গাপুজো (Durga Puja ) বাঙালির চিরন্তন ঐতিহ্যের ধারক। যেখানে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে দুর্গাপুজো একটি সার্বজনীন উৎসবের জায়গা নিয়েছে৷ এই লেখার মাধ্যমে বাঙালির দুর্গোৎসবকে আমি আমার অভিজ্ঞতার নিরিখে একটু তুলে ধরব। কেননা দুই বাংলার দুর্গাপুজোকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। প্রথমে আসি বাংলাদেশের দুর্গাপুজোর আলোচনায়৷ Durga Puja: সেকাল বনাম একাল-বঙ্গদেশে দুর্গাপুজোর সাতকাহন
শৈশব থেকেই দুর্গোৎসবকে (Durga Puja ) কখনওই অন্যের উৎসব মানে অন্য ধর্মের উৎসব বলে মনে হয়নি। আমাদের বসতবাড়ির কয়েক ঘর পরেই ছিল হিন্দু বাড়ি। তাঁরা প্রায় সকলেই নিম্ন মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত বলা চলে। একই পাড়ায় বসবাস করার জন্য সবাই পরিবারের মতো থাকতাম৷ দেখেছি পাড়ার সকলে মিলে চাঁদা তুলে দুর্গাপুজোর আয়োজন করা হত৷ এখানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পাশাপাশি মুসলিমদের উৎসাহ বড় কম ছিল না। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে গ্রামের সকলেই সেই পুজোয় অংশ নিতেন৷
আর্থিকভাবে সচ্ছল বাসিন্দারা পুজোর কাজ যাতে সু্ন্দরভাবে হয়, সেজন্য টাকা দিতেন৷ সম্পন্ন চাষির বাড়ি থেকে আসত ধান বা গম, ডাল৷ যেহেতু সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পুজোর আয়োজন, তাই সকলেই সানন্দে পাত পেড়ে ভোগ খেত৷ সকাল বিকেল পুজোর চারদিন মণ্ডপে (Durga Puja ) ছিল আমাদের অবাধ যাতায়াত। শুধুমাত্র মায়ের শর্ত, স্কুলের হোম ওয়ার্ক শেষ করে যাও। আর আমরাও কোনমতে হোম ওয়ার্ক শেষ করেই ছুটে যেতাম মণ্ডপে। দ্বারকানাথের লোলা
দশমী এলে বিসর্জনের বেদনায় আমার চোখেও জল আসত৷ এক্ষেত্রে বাকিদের কাঁদতে দেখে আমিও কেঁদে ফেলতাম৷ এই কান্নার মধ্যে মিশে থাকত চারদিনের অফুরান আনন্দ হঠাৎ ফুরিয়ে যাওয়ার দুঃখ৷ আমাদের আব্বু সেসময় ভাইবোনদের নিয়ে গ্রামের পুজো পরিক্রমায় (Durga Puja ) বেরোতেন৷ আব্বুর সঙ্গে গেলে আলাদা খাতির যত্ন পেতাম। আমার আব্বু এলাকার একজন জনপ্রিয় শিক্ষক।
এরপর ভালভাবে লেখাপড়ার করার জন্য আমরা দরিরামপুর থেকে ময়মনসিংহ শহরে চলে গেলাম। এখানে বলে রাখি দরিরামপুর একটি বিখ্যাত জায়গা। কাজী নজরুল ইসলাম প্রথম আসানসোল থেকে আমাদের গ্রাম দরিরামপুরেই এসেছিলেন। এখানে তিনি তৎকালীন দরিরামপুর হাইস্কুলে এক বছর পড়াশোনাও করেন৷ যদিও পরবর্তীতে তিনি অনেকবার তৎকালীন পূর্ববঙ্গ ও বর্তমান বাংলাদেশে এসেছেন। লাঞ্ছিত “অরণ্যের অধিকার”, লালগড়ের পথে মহাশ্বেতা
যাই হোক ময়মনসিংহে এসে দুর্গাপুজোতে (Durga Puja ) পেলাম নতুনত্ব। গ্রামের সরল সাদাসিধে দুর্গোৎসবের যে আয়োজন দেখেছিলাম৷ ময়মনসিংহে ঠিক তার বিপরীত৷ পুজোকে কেন্দ্র করে ঝরে পড়ছে গ্ল্যামার। আলোকসজ্জা, শব্দ প্রক্ষেপন, প্যান্ডেল ইত্যাদিতে পেলাম নানা বৈচিত্র্য। বাঙালির ভক্তির বৈচিত্র ধরা পড়ল অনন্য এক মুগ্ধতায়।
আমাদের ময়মনসিংহে সম্প্রীতির বন্ধন অনেক বেশি। হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে যে সাম্প্রদায়িক সমন্বয় দেখা যায় তাতে এখানকার মানুষ কখনওই মনে করে না হিন্দু মুসলিম আলাদা। সর্বোপরি এখানে আমরা নিজেদের বাঙালি হিসেবেই পরিচয় দিতে বেশি আরাম বোধ করি। এখানে আমি আরাম শব্দটি ব্যবহার করেছি, আমি বলতে পারতাম ভাল বোধ করি বা ভাল লাগে৷ কিন্তু আমি বলেছি আরাম বোধ করি। কারণ আরাম মানুষ সেটাতেই পায় যেখানে তার ভাললাগা ও শান্তি পাশাপাশি বিরাজ করে। যদিও বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দুদের উপর নানা অত্যাচারের খবর পাওয়া যায়, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে।
২০১৩ সালে কলকাতা এলাম জুলাই এর শেষে৷ রবীন্দ্রভারতীতে ভর্তি হয়েই বাড়ি নিলাম নৈনান পাড়া লেনে। বিরাট প্যান্ডেল বানাতে দেখলাম বিভিন্ন জায়গায়৷ আমার বাসা থেকেই খুব কাছে ঘোষপাড়া মাঠে দেখলাম বিশাল মণ্ডপ। আমার দেখা পূর্বের সকল অভিজ্ঞতাকে ছাড়িয়ে গেল কলকাতার পুজো (Durga Puja )। বিভিন্ন থিমভিত্তিক মণ্ডপ আমাকে দিল এক নতুন অভিজ্ঞতা। বাড়ি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়ার পথে অসংখ্য এরকম মণ্ডপ দেখেছি। আমাকে রীতিমত অবাক করত।
বন্ধুদের সঙ্গে একদিন কুমোরটুলিতে গিয়ে মনটা ভরে গেল। শ্যামবাজার মেট্রো থেকে নেমে মায়ের ঘাট হয়ে আমি, তৃণা, প্রিয়াঙ্কা, চন্দ্র, তথাগত তনুশ্রী, ঋত্বিকা, পলি, সবাই মিলে কুমোরটুলিতে গেলাম। তখনো বুঝিনি দুর্গা মায়ের কত রূপ হতে পারে। কুমোরটুলিতে বিভিন্ন আঙ্গিকের দুর্গামূর্তি (Durga Puja ) আমার অদেখা জগতে ও অজানার রাজ্যে দিল নতুন অভিজ্ঞতা।
কদিন পরে দেখলাম ট্রাকে করে কৈলাস থেকে দুর্গা মায়ের নিজের বাপের বাড়িতে আগমন। জমকালো মণ্ডপ সাজিয়ে মেয়ের অপেক্ষায় গোটা রাজ্য। পুজো (Durga Puja ) শুরুর সঙ্গে সঙ্গে আলোর মালায় সেজে ওঠা বিভিন্ন তোরণ কলকাতাকে করে দেয় আলোক নগরী। কত বিচিত্র রূপের, বিচিত্র ভাবের সেসব আলোকসজ্জা!
২০১৬ সালে চলে এলাম শান্তিনিকেতনে৷ বিশ্বভারতীর সংগীত ভবনে গবেষণার উদ্দেশ্যে ভর্তি হলাম৷ এবার শান্তিনিকেতনে দুর্গাপুজোকে (Durga Puja ) পেলাম আলাদা এক আঙ্গিকে। এখানে একটা বিষয় খেয়াল করলাম, কলকাতার মানুষ যেমন বারো মাসে তেরো পার্বণ পালন করে, সেই তুলনায় শান্তিনিকেতনের মানুষের এত ঘনঘটা নেই। শান্তিনিকেতনে তাই খুব বেশি পুজো আমার দেখা হয়নি।
করোনা পূর্ববর্তী সময়ে ২০১৮-২০১৯ সালের টোটো ভাড়া করে আমরা কয়েকজন বাংলাদেশি মিলে দুর্গাপুজো পরিক্রমায় বেরিয়েছিলাম৷ তবে শান্তিনিকেতনে এসে কলকাতার পুজোকে খুব মিস করতাম। আসলে দুর্গাপুজোর (Durga Puja ) এসেন্স পেতে হলে কলকাতাতে আসতেই হবে৷ এখানে ভক্ত পাবে তার আরাধ্যকে বিভিন্ন ও বহুমাত্রিক রূপে। ২০২০ সাল গেল লকডাউনে, দেখা হয়নি কোন পুজো। এখন ২০২১ সালে মা দুর্গার রূপ দর্শনের অপেক্ষায় আছি।
2 thoughts on “Durga Puja : দুই বাংলার দুর্গাপুজো”
Prianty Chakroborty
(9th অক্টোবর 2021 - 9:10 পূর্বাহ্ন)অনেক সুন্দর লেখনি ভাইয়া❤️
bongmag
(9th অক্টোবর 2021 - 11:11 অপরাহ্ন)ধন্যবাদ