বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, এই শব্দবন্ধ কানে আসতেই মানবমনে ভেসে ওঠে হাজারো ছবি। বিশ্বলোকের সমস্ত রহস্যকে ঘিরেই যেন তার অবস্থান। রাতের আকাশের দিকে তাকালে দেখবেন কেমন মন্ত্রমুগ্ধের মতো আটকে আছে চোখ। মনের রকেট তখন এক নক্ষত্র থেকে আর এক নক্ষত্রে ছুটে চলেছে। গ্রহ, উপগ্রহ, গ্রহানুপুঞ্জ, সে এক মহা সমারোহ। এই রহস্যলোকের এক সদস্যই আমার আপনার জীবনের আধার, নাম তার পৃথিবী। বিস্ময়াবিষ্ট চোখ ততক্ষণে নিজেকে সইয়ে নিয়েছে। পৃথিবী আহুতি দিচ্ছে, তার গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসছে গলিত লাভা। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে তাকে অভ্যর্থনা ভাবতেই পারি অথবা প্রকৃতির রুদ্র রূপের হুঁশিয়ারি ভাবলেও অত্যুক্তি হবে না।
ঝড় থেমে গেছে, গলিত লাভাকে ততক্ষণে ধারণ করেছে এ ধরিত্রী। অসীম জলরাশি হিমেল পরশ বয়ে নিয়ে আসছে। যেন অনাদিকাল থেকে সেই বহমানতা প্রাণের চিহ্নকে মাতৃ জঠরের মতো আগলে রেখেছে। যার বজ্র নির্ঘোষ ঢেউ সেই তপ্ত লাভাকে কঠিন পর্বতে বদলে দিয়েছে। যার পাদদেশে উচ্ছল কিশোরীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ছে ঢেউ। পাথর সরিয়ে প্রাণের বিকাশ ঘটছে। ধীরে ধীরে লাবণ্যে ভরপুর তন্বী হয়ে উঠল সে। নাম তার প্রকৃতি। পাহাড় থেকে সমুদ্র সব ছুঁয়ে নিজেকে সাজিয়ে তুলল শ্যামলিমায়। ফুলে ফলে ভরপুর পৃথিবীতে এল শ্রেষ্ঠতম জীব মানুষ। এবার তার পালা। আরও পড়ুন-পৃথিবী কবে সুস্থ হবে? এই বৈশাখে স্বপ্ন দেখি…
মহাকাশকে সাক্ষী করে সবুজ শ্যামল প্রকৃতি মায়ের কোলে নিজের স্মাক্ষর রাখল এই দ্বিপদ জীব। তার তো প্রতিদ্বন্দ্বি কম নেই।, সেদিনও ছিল না। ভয়কে জয় করে বিবিধ বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠল সভ্যতা। কালে কালে সে অত্যাধুনিক হয়েছে, শুধু বনের পশুই নয়, যন্ত্রের গলাতেও পরিয়েছে লাগাম। আরও আরও, এই চাই সর্বস্ব দুনিয়াকে মুঠোবন্দি করতে গিয়েই মা-কে যেন কবে সে ভুলতে বসল। যন্ত্রকে আদর করতে গিয়ে নির্বিচারে কাটল গাছ। ভয় পেয়ে পুরনো বাসা ভুলল পরিযায়ী পাখির দল। ডিনামাইট ফাটিয়ে জমাট লাভাকে ছিন্নভিন্ন করে তৈরি হল রাজপথ। সেখানে সাঁই সাঁই ছুটছে গাড়ি। প্রকৃতি মায়ের দমবন্ধ হয়ে আসছে। বিষবাস্প ভেদ করে শ্বাস নিতে পারছে না প্রকৃতি। নদীর জলে ভেসে আসছে সভ্য মানুষের লোভের বিষ। ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে ওজনস্তরকে ঘুঁটি করা হচ্ছে। আর কত সইবে মা?
তবুও সন্তানকে শোধরানোর সুযোগ দিল, প্লেগের আগমনে মানুষ ভয় পেল ঠিকই তবে দমল না। একে একে সার্স, মার্স, ইবোলা। বিবর্তনের আনন্দে মেতেছে মানুষ তাই জীবাণুকেও দাবার বোড়ে বানিয়ে অজানা শত্রুর অপেক্ষা করতে থাকল। আরও পড়ুন- স্মৃতির সরণি বেয়ে পয়লা বৈশাখ
অলক্ষ্যে হাসল প্রকৃতি। জমাট লাভায় ঝাঁপিয়ে পড়া উচ্ছল কিশোরীর হাসি নয়। এর পায়ে প্রযুক্তি বেড়ি। হাতের তেলোয় দগদগে ঘা, যার নাম দূষণ। নাভিমূলে তীব্র ক্ষত, যার পোশাকি নাম ওজনস্তর, দুপায়ে জড়িয়ে আছে সপ্লিন্টার, বুলেটের শেল, নাকে তীব্র বারুদের গন্ধ। মরা পাখি, হাঁতির দাঁত, হরিণের শিং, বাঘের চামড়া। আর পিঠটা আটকে আছে গাছের কাটা গুঁড়িতে। চোখ জ্বলছে, গলায় দলা পাকানো কান্না থুতু হয়ে বেড়িয়ে এল শুধু। তাতেই লকডাউনে গোটা পৃথিবী। করোনাভাইরাস। না থাপ্পড় মারেনি মা, ঘেন্নায় থুতু ফেলেছে। আর তাতেই আমরা হিংসা দ্বেষ ভুলে মৃ্ত্যুর পদধ্বনি গুনছি।
মা-তো, ঠিক কাছে টানবে, শ্যামলিমায় ভরবে পৃথিবী। ভয় যাবে কেটে। শুধু লাঞ্ছিতা মা-কে নবরূপে ফেরাতে হবে। আমরাই পারি___যদি চাই।