মারকাটারি রোদ্দুর মাখা বসন্তের দিনও এমন অন্ধকারে ঝুম মেরে থাকবে তা আগে থেকে জানা ছিল না। মানুষ পোড়া গন্ধ এখনও থিতোয়নি। শয়ন স্বপনে নিশি জাগরণে নিত্য অশান্তি যেন তাড়া করে ফিরছে। চৈত্রের দাবদাহে সেঁকে ওঠার আগে ওই সকালটাই যা মধুময়। বৃহস্পতিবার তো আবার মেঘের ফাঁকে রোদ্দুরের দেখা মিলেছিল। সকালবেলা এমন আকাশ দেখে পড়শিরা বলতে শুরু করেছিলেন অশনি বোধহয় পথভুলে বাংলায় ফিরছে। এই বসন্তে ফের ভিজতে হবে। তবে সেই জল যে কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশ বাদ দিয়ে চোখের কোণ বেয়ে ঝরবে আঁচ করতে পারিনি।
মৃত্যু বড্ড ভারী শব্দ হলেও মাঝে মাঝে মনে হয়, ফাঁকি দেওয়ার বড় সুযোগ এর থেকে আর কিছু নেই। এমন দর্শনমাখা আদ্যন্ত বাস্তব শব্দঠাঁই যা ১২-র কিশোরীকেও এক ধাক্কায় একুশের তরুণীতে বদলে দেয়। কিম্বা বছর ১৮-র টগবগে তরুণ হয়ে যায় চল্লিশের মধ্য বয়স্ক। মৃত্যুর এমন ভার। অতিমারি থেকে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, গত কয়েক বছরে মৃত্যুকে আমরা বার বার আলগোছে ছুঁয়ে গেছি। কখনও সে চাঁপ চাঁপ রক্ত রেখে গেছে মনে। কখনও নিকষ অন্ধকার, সময়ের যাঁতাকলে আমি তুমি এগিয়ে পিছিয়ে গেলেও মত্যু থেকেছে অবিচল।
Bhagat Singh: ব্রিটিশ রাজের কারাগারে আমৃত্যু স্বাধীন স্ফুলিঙ্গের নাম ভগৎ সিং
হাজারো যন্ত্রণা, না পাওয়া, দুঃখ, বিষাদ, হাসি, কান্না, তিক্ততা, মধুর মাঝেও মৃত্যুর কথা মনে হলে কেমন নিজের মধ্যে একলা হয়ে পড়ি। কঠিন এক চিলতে রাস্তা, রংটা ধূসর না কি পল্লী বাংলার সাঁঝের বেলার কালো, ঠিক ধরতে পারি না। একা হেঁটে চলেছি, অনিশ্চিতের দিকে। দু’পাশ থেকে সরে সরে যাচ্ছে, ফ্লাশ। যেন টিনসেল টাউন থেকে চাঁদে এসে পড়েছি। যেখানে কিছু হারানোর নেই, শুধু অনুভূতি কেমন যেন তামাটে মেরে গেছে। বুদ্ধির ধার কমলে যা হয় আর কি।
আজ ফের স্বর্গলোকে হইচই পড়বে, মর্ত্যে উইকেট পড়লেই যে তাদের আনন্দ আর ধরে না। দলভারী করায় স্বর্গবাসীরা মর্ত্যলোককে বলে বলে গোল দেবে। যম একবার খাতা দেখে পৈতৃক নামটা সই করিয়ে নিলেই হল। তারপর আর কোনও দায় নেই। কে আমার, আর আমি কার। কর্মই জীবন, এই যেমন ঢেঁকির কথাই ধরো না কেন। তার ইহকাল পরকাল ঝরঝরে হয়ে গেলেও ধান ভানার কাজ থেকে রেহাই মেলেনি। টলিপাড়া থেকে সেই যে কতগুলো সাহেব বিবি এলেন তাঁরা যেন জমিয়ে আসর কচ্চেন। গায়ে গতরে খেটে ঢেঁকি শুধু খাবার সাপ্লাই দিয়ে চলেছেন। বাবু বিবিরা স্বাস্থ্য সচেতন, ঢেঁকি ছাঁটা চাল ছাড়া খান না। চিত্রগুপ্ত নাকি কোন গয়লার পো’কে ধরে এনেছে। গানের গলা সাধার আগে এক কাপ গরম দুধ না হলে গীতশ্রীর চলছিল না। সৌমিত্রবাবু আবার লাস্ট লিয়রের পার্ট করার আগে কড়া দুধ চা ভালবাসেন।
কাকে ছেড়ে কার কথা বলি। কটা দিন লতাজিকে নিয়ে সবাই এমন আদিখ্যেতা দেখাল যে তাপসের কথা কারো মনেই এল না। আরে আগেভাগে এন্ট্রি নিলেও সে যে সবার থেকে ছোট আদরের ধন, তা ভুলে গেলে চলে? সে, যে যা ভুলছে ভুলুক এতদিনে কাঁধেকাঁধ দিয়ে গল্প করার মতো একটা সঙ্গী জুটেছে। এই বুড়োবুড়িদের ঠেকে নাহলে কোণঠাসা হয়েই থাকতে হয়।
World Tuberculosis Day 2022: প্রতি লক্ষে আক্রান্ত ১৮৭ জন, বিশ্ব যক্ষ্মা দিবসে সচেতন হোন
গুন গুন ফিসফিস স্বরে ঘুমটা উধাও। ধরমরিয়ে উঠে বসে চক কচলেও ব্যাপারটা পরিষ্কার হল না। এ কোথায় এসে পড়লাম বাবা। আশপাশে সংযুক্তাকে দেখছি না। মেয়েটা তো এই ভর সকালে বিছানা ছেড়ে ওঠে না। কে যেন পাঠ মুখস্থ করছেন, স্বাতীলেখা দেবী! লতা মঙ্গেশকর চা খাচ্ছেন? মাথাটা এবার সত্যিই ভোঁ ভোঁ করতে লাগল। বুকের বা’দিকটা চিনচিন করছে কি, স্লিপারটাই বা কোথায় গেল। ধূর ছাই, কিছুই আজকাল মনে থাকে না।
আরে করছেন কি! পা মাটিতেই রাখুন, ব্যথাট্যাথা নেই বুক ভরে শ্বাস নিন। দেখবেন সব উধাও। তবে আগে শ্রীমানের নাম খানা এখানে লিখুন দিকি, সইসাবুদ চুকলে তবে আমার কাজ কমে। বুড়ো তো হয়েছি নাকি! এত ধকল আর সইবে কেন। তোমার মতো তো আর সাততাড়াতাড়ি দায়িত্ব ছেড়ে পালাতে পারব না। সে যাকগে, কল টাইমের কথা ভেবে দুঃখ করতে হবে না। ও লীনাদেবীর থেকে ঢের ভাল লিখিয়ে এখানে আচেন। থাকো সবে তো এলে আসতে যেতে পরিচয় হবে। নতুন জুটি হলে সিনেমায় ভাল রোলও পাবে। তবে তার আগে নিজের মুন্সিয়ানা দেখাও দিকি। নাহলে কিন্তু লবডঙ্কা।
এই যা! তুমি বলে ফেললুম, তা তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে। তোমাদের তবু যম ডাকে। আর আমি তো যমের কাছেই থাকি কি না। তাই আর নেমন্তন্ন পাইনে। কিছু মনে কোরো না বাবা। ও অলপ্পেয়ে গয়লা ছেলেটাকে একগ্লাস দুধ দিতে বলেছি।খেয়ে নাও শোকের পাথর বুক থেকে নামুক। এবার তো স্বর্গ লোকের পালা। তা বাবা তোমায় মিঠু বলি, নাকি অভিষেক? ঘরের ছেলের মতোই থাকো কেমন।
সাঁঝের অন্ধকার যে কখন উধাও হয়েছে বুঝতে পারিনি। সামনে দিগন্ত যেন মাটি ছুয়ে মিলিয়ে গেছে, তল খুঁজে পাচ্ছি না। অনেকদিন পর তাপসকে দেখলাম, রোগভোগে জর্জরিত নয়, একেবারে দৌড়ঝাঁপ করা পেটানো শরীর। নিমের দাঁতন মুখে কাঁধে গামছা ঝুলিয়ে পুকুর ঘাটের দিকে যাচ্ছে। মাটির দাওয়ায় উদাত্ত কণ্ঠে আফ্রিকা আওড়াচ্ছেন সৌমিত্রবাবু। রমাপ্রসাদ বণিক পেয়েছি পেয়েছি বলে লালখাতা খানি বগলদাবা করে কোথায় যেন চলে গেলেন। পুকুর লাগোয়া দোলনায় বসে উদাস দৃষ্টিতে আকাশ দেখছেন সুচিত্রা মিত্র। তবে কি মেগার সেটে ঢুকে পড়লাম! পীযূষ গাঙ্গুলি সামনে দিয়ে যেতে যেতে একবার অপাঙ্গে দেখে নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, কেও সুজন নাকি! পুকুর পার থেকে ভেসে আসছে মধুরও ধ্বনি বাজে…