“কেউ বলুক না বলুক তুমি সব জানো।
ছোট কথা, বড় কথা, ছোট দুঃখ, বড় বেদনা
এসব ছাড়িয়ে মস্ত এক হাসির পাহাড়।
সেই পাহাড়ে ঘর বাঁধব তোমার সঙ্গেই
লোকে বলুক না বলুক, তুমি জানো।”
এই এক ছত্র যে কবে থেকে আমার মননকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়েছে, মনে পড়ে না। শান্তিনিকেতন আমার আবাল্য সখা। জন্ম থেকেই আপাত শান্ত গ্রাম্য জনপদ যেন পিছু টানে। আসলে লাল মাটির দেশে জন্ম তো, গুরুদেব যে শুধু আদর্শগত নয়, জন্মগত ভাবেই আত্মজন, অভিভাবক। তাইতো পুতুলবাটি নিয়ে খেলার সময়েই বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয়। আর রবির দেশেই নবনীতা দেবসেনের লেখনির সঙ্গে পরিচিতি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কোনও সুতীব্র নারীবাদের পরিচয় না দিয়েও যিনি মহিলাদের স্বতন্ত্র উপস্থিতির নজির রাখতে পারেন, তিনিই নবনীতা দেবসেন। কি সহজ সুন্দর শব্দ চয়ন, কোনও দ্বিধা ছাড়াই যেন একই সঙ্গে স্কলারের পড়ার টেবিল থেকে আঁচলে হলুদের দাগ লেগে থাকা গৃহিনীর বইয়ের তাকে স্বচ্ছন্দে বিচরণ করেন। প্রিয় কবি সাহিত্যিকদের ঘিরে অনুরাগী পাঠককুলের একটা ভিড় সবসময় চোখে পড়ে। তবে নবনীতা দেবসেনের পাঠক যেন তাঁর স্বজন, তাইতো বাইরে কোথাও যেতে গেলে দেখবেন বিমানবন্দর থেকে রেল স্টেশন একটা ভিড় তাঁকে ঘিরে রেখেছে। সেই ভিড়ে কোনও উন্মাদনা নেই, তীব্র ভাললাগার আকুতি আছে। সেই মায়ার বাঁধন ছেড়ে কবিকে বের করে আনা তাঁর সঙ্গীদের কাছে কতোটা কষ্টকর হতো সেটা সত্যিই আলোচ্য।
সেই ৭৩ সালে অর্থনীতিবিদ স্বামী অমর্ত্য সেনের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছে। তবে বাহ্যিক দূরত্ব বাড়ালেও আজীবন অমর্ত্য সেনের প্রতি শ্রদ্ধার ভাব একটুও কমেনি। নিজের মুখে কখনও কখনও বলতেন, যে অমর্ত্যের সঙ্গে তাঁর সুখের ঘরকন্না শুরু হয়েছিল সেই অমর্ত্যের সঙ্গে বিচ্ছেদ তো হয়নি। কবি নরেন দেব ও রাধারাণী দেবের একমাত্র সন্তান নবনীতা, তিনি যে একদিন সাহিত্যের আকাশে নক্ষত্র হবেন তাতো জানা কথা। যাদবপুরের কৃতিছাত্রী বিদেশের মাটিতেও নিজের জাত চেনালেন। তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপিকা নবনীতাকে যাঁরা ক্লাসরুমে পেয়েছেন, তাঁদের ভাগ্য সত্যিই ঈর্ষণীয়। ইলিয়াড ওডিসির আলোচনায় স্বচ্ছন্দ নবনীতা অবলীলায় ভারতীয় মহাকাব্যিক চরিত্রের ব্যাখ্যা দিতেন একেবারে নিজের মতো করে। ছাত্রছাত্রীরা বুঝতেই পারত না কখন সময় কেটে গিয়েছে। লাল টিপের হাসিখুশি মহিলার মুখে লেগে শিশুর সরল হাসি, ক্লাস রুমে তাঁর সামনে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বসে আছে ছাত্রছাত্রীরা। ১৩ বছরের দাম্পত্যে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা কবিকে বাহ্যিকভাবে স্পর্শ করতে পারেনি, মননে ছুঁয়েছিল। যার প্রতিফলন তাঁর লেখনিতে বার বার এসেছে। ভাল-বাসা, আক্ষরিক অর্থেই সাহিত্য, সংবেদনশীলতার খনি ছিল, বিচ্ছেদের পর থেকে আজীবন মেয়ে নন্দনা ও অন্তারাকে নিয়ে সেখানেই বাস করেছেন। সেই ভাল-বাসাতেই গান শুনতে শুনতে না ফেরার দেশে চলে গেলেন। সবার জন্য সেবাড়ির দরজা খোলা ছিল। একবার তাঁর কোনও পাঠক যদি ফোন নম্বর জোগাড় করে ফেলতেন, তাহলে একদিন ভাল-বাসার বৈঠক খানায় দুষ্প্রাপ্য বইয়ের ভিড়ে দেখা যেত তাঁকে। সামনে বসে শিশুর হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছেন নবনীতা দেবসেন। পাঠকরা ফোন করলে খুশি হতেন। নতুন কবি, সাহিত্যিকদের নিয়ে তাঁর উৎসাহ ছিল দেখার মতো।
রাজনীতির নাড়িনক্ষত্র সম্পর্কে নবনীতার জ্ঞান অসাধারণ। বর্তমান রাজনৈতিক পরিকাঠামো তাঁকে যন্ত্রণা দিত, তবে মেরুদণ্ড সোজা রেখেই নিজের মতামত ব্যক্ত করতে কখনও পিছপা হননি, প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে তাঁর আগ্রহ সেভাবে দেখা না গেলেও সব খোঁজখবরই রাখতেন। বেশ কিছু বছর ধরে বৈদ্যুতিন চেয়ার তাঁর সঙ্গী হয়ে গিয়েছিল। ২০১১-র বইমেলার লিটারারি মিটে নবনীতা দেবসেনের সঙ্গে শেষ দেখা। সেসময়ও তাঁকে হাঁটতে দেখেছি। কষ্ট হলেও চওড়া হাসি কখনও সেই যন্ত্রণাকে বড় হতে দেয়নি। সমস্ত যন্ত্রণা ভারকে সরিয়ে রেখে জীবনকে কীভাবে যাপন করতে হয় তা নবনীতা দেবসেন শিখিয়েছেন। তাঁর রম্যরচনা থেকে কবিতা, গল্প থেকে উপন্যাস, এক একটা বই যেন এক একটা শেখার স্তর। ছত্রে ছত্রে যেন পাঠকের জীবনের অনুরণন বর্তমান। মাত্র কয়েকদিন আগেই ফেসবুকের টাইমলাইনে ‘অলরাইট কামেন ফাইট! কামেন ফাইট!’ আর সঙ্গে সেই হাসি মুখ। বছর খানেক আগের চিনচিনে ব্যথাটা ফের ফিরে এসেছিল। কিন্তু মন তো এতকিছু মানে না, এত সহজে কি কেউ চলে যেতে পারেন। যিনি কিনা মৃত্যু যন্ত্রণাকেও নিজের মতো করে যাপন করেন।
ক্যানসার তাঁকে দমাতে পারেনি, শরীরটাকে শুধু ক্ষয়ে যেতে দিয়েছে। মনটা একেবারে ১৬ বছরের কিশোরীর মতোই ফুরফুরে ছিল। জীবন সায়াহ্নে এসে নিজের লেখাতেই তাঁর প্রমাণ রেখেছেন। দিনক্ষণ পাঁজি দেখেই তিনি যেতে চেয়েছেন, তাঁর অসুস্থতা নিয়ে পাঠককুলের হাহাকারকে ফুৎকারে উড়িয়েছেন। নশ্বর শরীরটা হয়তো থাকবে না, তবে মনটা যে ভাল-বাসাতেই আটকে থাকবে তা বলাই বাহুল্য। আসলে তিনিও বলতে চেয়েছেন কবির মৃত্যু হয় না, লেখনির মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকেন। পাঠকের স্মৃতিচারণে বার বার ফিরে আসেন। যেমন ‘আরোগ্য’ কবিতায় নবনীতা ভাল মানুষদের ফিরিয়ে আনতে চেয়েছেন। এই বৃষ্টি দিনের সকালে কফির কাপ নিয়ে জানলায় বসি, বাইরে অবিরল বৃষ্টির ফোঁটা মাধবীতলার শরীর ছুঁয়ে জানলার কাঁচে আলপনা আঁকছে। আর বইয়ের পাতায় জীবন্ত নবনীতা সেই হাসিমুখে, কে বলে এই প্রভাতে নেই তিনি!