মহেন্দ্র সিং ধোনি, (MS Dhoni) যাঁর জন্য পাগল হয়ে মাঠের মাঝে চলে গিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন মহিলা অনুরাগী। যিনি ২২ গজে ঝড় তুললে গোটা ঝাড়খণ্ড টিভির পর্দায় চোখ রাখে। পাড়ার খুদে বোলারও স্বপ্ন দেখতে শিখে যায় যাঁর উইকেট কিপিং দেখে। “মাহি মার রহা হ্যায়”, এই শব্দবন্ধ যে কতটা আবেগের ভার বহন করতে পারে, তা প্রত্যেক ক্রিকেটপ্রেমী ভারতীয়কে আলাদা করে জিজ্ঞাসা করলে মহাকাব্য রচনা হয়ে যাবে। তিনি আমাদের ক্যাপ্টেন কুল। সুনামির সামনেও যেন নিরন্তর বয়ে চলা প্যাংগং হ্রদ। দিনের ব্যস্ত সময়ে মুম্বইয়ের শেয়ার মার্কেটে যখন ঝড়ের বেগে সূচক ওঠানামা করে তখনও আরব সাগরের নীল জলের মতো বহমানতা ধরে রাখতে পারেন মহেন্দ্র সিং ধোনি।
২০০৭-এর বিশ্বকাপ ক্রিকেটে হারের বোঝা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরে দেখেছিলেন, প্রিয় অনুরাগীরা তাঁর বাসস্থানকে কালিমালিপ্ত করতে ছাড়েনি। সেদিনই বুঝে গিয়েছিলেন ১১-র বিশ্বকাপ, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জয়ের মুকুট যতই মাথায় থাক না কেন, একবারের হারকেও স্পোর্টসম্যান স্পিরিটে দেখতে নারাজ দেশের অনুরাগীরা। তারা পছন্দের ক্রিকেটারকে ততক্ষণই মাথায় তুলে রাখবে, যতক্ষণ তিনি দেশের জন্য আনন্দের কারিগর থাকছেন। একবার সেখানে দুঃখের ছাপ পড়ল কি না পড়ল, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে পায়ের নিচে পিষে দিতে দ্বিধা করবে না।এহেন দৃশ্য দেখার পর নিজের আবেগেও কেমন দাড়ি টেনে দিয়েছিলেন ধোনি (MS Dhoni)। তাঁকে গ্ল্যামারের আবর্তে বাঁধা যায় না। স্টেটাস সিম্বল ঠিক করতে গেলে মনে হবে, কোনও দূর দেশের নাবিক, যিনি কাপ্তানির সময়টুকু ছাড়া বাকি মুহূর্তগুলোকে সমুদ্রের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে কাটিয়ে দিতে পারেন। সেই সমুদ্রে ঝড় উঠল, না কি বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নজরে এল কিছুতেই যেন কিছু এসে যায় না। এমনই নির্বিকার সেই চাহনি।
অন্য ‘বিন্যাস’-এর লেখক বুদ্ধদেব গুহ
দুটো বিশ্বকাপের রেকর্ড কাঁধে নিয়েও ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়কত্বের শ্লাঘা তাঁকে স্পর্শ করেনি। মাথা ঠাণ্ডা রেখে দল পরিচালনা করতেন। সেই দলে সিনিয়র ক্রিকেটারকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে জুনিয়রকে অবহেলা যেমন করেননি। তেমনই নিজের দায়িত্বের সামনে কখনও তারকা ক্রিকেটারের ইগোকে বড় হতে দেননি। ক্যাপ্টেন কুল (MS Dhoni) এমনই সাধারণভাবে একদিন মেলবোর্নের মাটিতে টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়েছিলেন। আগাম ঘোষণা করে সংবাদ মাধ্যম, আইসিসি, বিসিসিআই কাউকেই কোনওরকম আনুষ্ঠানিকতার সুযোগ দেননি। একইভাবে একদিনের ম্যাচে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকেও অবসর নিয়ে নিলেন। সেই সময়ই সতীর্থরা বুঝে গিয়েছিলেন, ২২ গজ থেকে প্যাভিলিয়নে ফিরে যাওয়া ধোনি একেবারেই অন্য দ্বীপের বাসিন্দা। যতক্ষণ ড্রেসিংরুমে থাকবেন ততক্ষণ সতীর্থদের উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করবেন। ভোকাল টনিক চলবে। কার কোথায় খামতি আছে তা পূরণের পরামর্শ দেবেন। ব্যাস ওইটুকুই, নিজের জীবন নিয়ে কখনও মিডিয়ার বাড়াবাড়ির সুযোগ দেননি।
Abhishek Chatterjee Died: স্বর্গলোকে কলটাইম, বায়না পেলেন অভিষেক
নিজের বায়োপিক যখন চলচ্চিত্র হয়ে জনগণের ড্রয়িংরুমে ঢুকে পড়ল, তখন সবাই জানতে পারলেন, ক্যাপ্টেন কুলের ভিতরেও রয়েছে প্রেমিক পুরুষ। নিজের জীবনকে খোলা খাতার মতো দেখিয়েছেন ধোনি (MS Dhoni)। জীবনের এহেন চড়াই উতড়াই পেরিয়ে যাঁর হাতে বিশ্বকাপ ওঠে তিনি যে বিশাল জলরাশির সামনে স্থিতধী বালুকারাশি হবেন, এতো বলাই বাহুল্য। সিনিয়র ক্রিকেটারদের অবসর গ্রহণ নিয়েও কখনও মাতামাতি করেননি। ভিভিএস লক্ষণ অবসর নিলেন, ফোন করে ক্যাপ্টেনকে সেই খবর জানাতে চেয়েছিলেন। কোনও কারণে ধোনি সেই ফোন রিসিভ করতে পারেননি। তবে পাল্টা কল করে অগ্রজকে আগামী জীবনের শুভেচ্ছাও জানানি।
এসবে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। ধোনি ((MS Dhoni)) একরমই। তিনি জানেন, সময় সবকিছুকেই হেলায় হারিয়ে এগিয়ে যায়। আবেগ দিয়ে বিশ্বজয় হয় না। তাইতো ফুলের বন্যায় ভেসে যেতে চাননি বলে চলতি বছরের আইপিএল টুর্নামেন্ট শুরু দিন দুয়েক আগেই চেন্নাই সুপার কিংসের অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিলেন। সিএসকে-র তরফে এক টুইট বিবৃতিতে বিষয়টি প্রকাশ্যে এল। সবাই যখন হতবাক, ধোনি তখন নির্বিকার। শুধু অধিনায়কত্ব ছাড়েননি, সতীর্থ ক্রিকেটার তথা দীর্ঘদিন CSK-র হয়ে খেলছেন রবীন্দ্র জাদেজাকে অধিনায়কও করে গিয়েছেন। নিজের সেরাটি দিয়ে নিঃশব্দে সরে আসার মতো গুণ তাঁর মধ্যে সবসময় থেকেছে। তাইতো বর্ণাঢ্য আয়োজনে তাঁর অধিনায়কোচিত বিদায়বেলা সাজল না। নিজস্ব ঢঙেই ক্রিকেট কেরিয়ারের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের ইতি টানলেন। অনুরাগীদের নিরাশ তিনি করেন না, ক্যাপ্টেন্সির চাপ কাটিয়ে পড়ন্ত বেলায় হয়তো ঝলসে উঠবে মাহির ব্যাট। বছর ১০-১২ বালক হাঁফাতে হাঁফাতে চৈত্রের সন্ধ্যায় পাড়ার চায়ের ঠেকে জানিয়ে যাবে, “মাহি মার রহা হ্যায়।” পশ্চিমাকাশ রাঙিয়ে তখন ডুবতে চলেছে সূর্যদেব। কনে দেখা আলোয় ধোনির ঘাম চকচকে মুখ যেন সমগ্র ভারতবাসীর প্রতিভু হয়ে সেই গোধূলিলগ্নের দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ, আরও একটা নতুন সকালের অপেক্ষায়।