‘সাত বিবির কবর’ বা ‘সাত সাহেবের বিবির গোর’। লোকমুখে এই নামেই পরিচিত সপ্তদশ শতাব্দীর ওলন্দাজ মহিলা সুস্যানা অ্যান্না মারিয়া ভারকার্কের (Susanna anna maria varkark) স্মৃতি সৌধ। হুগলি জেলার সমৃদ্ধ ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় দখল করে আছেন এই সুস্যানা আন্না মারিয়া। তাঁর স্বামী পিটার ব্রুইস ছিলেন চুঁচুড়ার ডাচ কুঠির প্রধান প্রশাসনিক কর্তা। হঠাৎ করে সুস্যানা আন্না মারিয়া কীকরে ভারতে চলে এলেন, জানতে আমাদের ফিরতে হবে সপ্তদশ শতকে। নেদারল্যান্ডের ছোট্ট শহর তিয়েল, ১৭৪৩ সালে সেখানেই সুস্যানার (Susanna anna maria varkark) জন্ম। এরপর ১৭৫৯ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে পিটার ব্রুইসকে বিয়ে করে ভারতে চলে আসেন ওলন্দাজ সুস্যানা। ততদিনে হুগলি নদী লাগোয়া চুঁচুড়া শহর ডাচদের দূর্গ নগরীতে পরিণত হয়েছে।
Susanna anna maria varkark: সুস্যানার ভারতে আগমন
১৬৪৫ সাল নাগাদ মুঘল সম্রাট শাহজাহানের ফরমান পেয়ে চুঁচুড়াতে ব্যবসা বাণিজ্য শুরু করে এই ডাচ বা ওলন্দাজরা। আগে এখানে পর্তুগিজদের কলোনি ছিল। তবে মুঘলদের সঙ্গে তাদের তেমন বনিবনা না থাকায় অচিরেই ওলন্দাজদের ভাগ্যে শিঁকে ছেঁড়ে। এর আগে ইরানে যখন ওলন্দাজরা মশলার ব্যবসা করত তখনই সেখানে বাংলার কাপড়ের চাহিদা তারা লক্ষ্য করে। এরপর হুগলি নদীর পারে বাণিজ্যের সুযোগ পেয়ে ২০ বছরের মধ্যেই গোটা চুচুঁড়ার ভোল বদলে দেয়। ততদিনে পিটারকে বিয়ে করে কলকাতায় চলে এসেছেন সুস্যানা আন্না মারিয়া (Susanna anna maria varkark)। তাঁদের প্রথম সন্তান সুস্যানা জ্যাকোবাকে ১৭৬১ সালে কলকাতার মিশন চার্চ থেকে ব্যাপটাইজ করা হয়।
এরপরেও পিটার ও সুস্যানার (Susanna anna maria varkark) আরও এক মেয়ে ও ছেলে জন্মায়। ছেলে লুই ও মেয়ে অ্যানা। পিটার ব্রুইস ১৭৬৪ সালে দক্ষতার পরিচয় দিয়ে কাশিমবাজারের ওলন্দাজ কুঠির দ্বিতীয় পদাধিকারীর দায়িত্ব পান। এর আগে ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজ দৌল্লার পরাজয় বঙ্গদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিপত্তি বাড়িয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে ওলন্দাজদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন নবাবরা। স্বাভাবিকভাবেই তখন চুঁচুড়া সহ বাংলার সমস্ত সেটলমেন্টেই বেশ কোণঠাসা ওলন্দাজরা। ১৭৫৯ সালে বিদেরার যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে ডাচদের নিদারুণ পরাজয় ঘটেছে। একপ্রকার বাধ্য করল ব্রিটিশদের আনুগত্য মেনে নিতে। আরও পড়ুন-Bansberia: চলুন যাই দেখে আসি, বাঁশবেড়িয়ার ৩৪১ বছরের অনন্ত বাসুদেব মন্দির
এদিকে ১৭৬৪-র পর কোনও এক সময় চুঁচুড়ার ওলন্দাজ কুঠির প্রশাসক হয়ে এলেন পিটার ব্রুইস। চন্দননগরে তখন ফরাসিদের প্রতাপ। চন্দননগর থেকে চুঁচুড়া আসার পথে জিটিরোডের ধারে রাস্তার ডানদিকেই ছিল ৬০ বিঘা জমির উপরে এক অট্টালিকা। গোটা চত্বরটার নাম আয়েশবাগ। এই আয়েশবাগে থাকতেন সুস্যানা আন্না মারিয়া (Susanna anna maria varkark)। এদিকে ১৭৮০ সাল নাগাদ ইউরোপে ডাচদের সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধ বাধলে সেই ঢেউ এসে পড়ে হুগলি নদীর এপারেও। ১৭৮২ সালে বাংলার সমস্ত ডাচ নগরী ও সম্পত্তি সাময়িকভাবে বাজেয়াপ্ত করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।
এর পরের বছর আচমকাই মারা যান পিটার ব্রুইস। তখন সুস্যানার বয়স ৪০বছর। ব্রুইসের মৃত্যুর ১২ বছর পর ১৭৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ইংরেজ ব্যবসায়ী থমাস ইয়েটসকে বিয়ে করেন সুস্যানা (Susanna anna maria varkark) । কলকাতার সেন্ট জন্স চার্চে ধুমধামের সঙ্গে সেই বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল। ততদিনে গঙ্গা দিয়ে বয়ে গিয়েছে অনেক জল। তবে থমাসের সঙ্গে সুস্যানা আন্না মারিয়ার বৈবাহিক জীবন সুখের হয়নি। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়।
Susanna anna maria varkark: আয়েশবাগ ও সুস্যানা
সে সময় আয়েশবাগে থাকতেন সুস্যানা (Susanna anna maria varkark)। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ততদিনে একটু একটু করে চুঁচুড়াকে অধীনে আনতে ব্যস্ত। ওলন্দাজদের আলগা মুঠো থেকে খসে যাচ্ছে সাধের বাণিজ্যনগরী। এমন সময় ১৮০৫ সালে যেন মৃত্যুর পদধ্বনি শুনলেন সুস্যানা। ছেলে লুই, জোহানেস ম্যুলার নামের এক পরিচিত ও তৎকালীন চুঁচু়ড়ার শেষ ওলন্দাজ গভর্নর ড্যানিয়েল অ্যান্থনি ওভার বেকের উপস্থিতিতে একটি উইল করলেন তিনি। তাতে স্পষ্ট বলা হল, বাড়ি, ৬টা ঘোড়া ও একটি ফিটন গাড়ি ছেলে লুইকে দিচ্ছেন সুস্যানা আন্না মারিয়া (Susanna anna maria varkark)।
Susanna anna maria varkark: সুস্যানার সমাধি
একই সঙ্গে দুটি ইচ্ছের কথাও জানান তিনি। আয়েশবাগের মাটিতেই যেন তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। তাঁর মৃত্যুর পর এই ৬০ বিঘা জমি যেন ওলন্দাজ ও ইংরেজদের কবরখানা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এর ঠিক চার বছর পর ১৮০৯ সালে সুস্যানা আন্না মারিয়ার (Susanna anna maria varkark) জীবনাবসান হয়। প্রথম ইচ্ছে মাফিক আয়েশবাগের উত্তর পশ্চিমকোণে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।
সেখানেই গড়ে ওঠে অষ্টভুজাকৃতি গম্বুজের স্মৃতি সৌধ। দোতলা এই স্মৃতি সৌধটি কাশিমবাজারের ওলন্দাজ তামেরাস ক্যান্টার ভিশের সমাধির অনুকরণে তৈরি। সমাধিস্থলটিতে রয়েছে চার দিকে চার খিলান বিশিষ্ট প্রবেশ পথ। উপরে গম্বুজ। দুটি তলার স্থাপত্য একই রকম। প্রতিটি প্রবেশদ্বারের দুপাশে দুটি করে গ্রিক স্থাপত্যের অনুকরণে স্তম্ভ রয়েছে। ২১১ বছর পরেও কার্ণিশের নকশা নজর কেড়ে নেয়।
সুস্যানা আন্না মারিয়া (Susanna anna maria varkark) মৃত্যুর চার বছর আগে ৪ হাজার টাকা দিয়ে একটি ট্রাস্টও তৈরি করিয়েছিলেন। নির্দেশ ছিল সেই ট্রাস্টের টাকায় প্রতিবছর তাঁর সমাধির রক্ষণাবেক্ষণ হবে। পাশিপাশি দুই স্বামী পিটার ব্রুইস ও থমাস ইয়েটসের সমাধিও রক্ষণাবেক্ষণ করবে সেই ট্রাস্ট। উদ্বৃত্ত টাকা খরচ করা হবে চুঁচুড়া গরিব দুঃখীদের উন্নয়নে। বলা বাহুল্য, চুঁচুড়ার ডাচ সিমেট্রিতে সমাধিস্থ রয়েছেন ওলন্দাজ প্রশাসক পিটার ব্রুইস ও ইংরেজ ব্যবসায়ী থমাস ইয়েটস। ষোড়শ শতকের কোনও এক সময় এই খবরখানা তৈরি হয়েছিল। বর্তমানে চুঁচুড়ার ফুলপুকুর রোডে নিঃসঙ্গ কাল যাপন করে চলেছে প্রায় ৪০০ বছরের বেশি পুরোনো এই গোরস্থান।
এখানে প্রায় ৪৫টির মতো সমাধি এখনও অক্ষত রয়েছে। যার মধ্যে সবথেকে পুরোনো সমাধিটি ১৭৪৩ সালের। কর্নেলিস ডে জং নামের এক ওলন্দাজ সেখানে শায়িত রয়েছেন। রয়েছে চুঁচুড়ার শেষ ওলন্দাজ গভর্নর ড্যানিয়েল অ্যান্থনি ওভারবেকের সমাধিও। তাঁর মৃত্যু হয় ১৮৪০ সালে। তবে ১৮৪৭ সালে শেষবারের মতো এই কবরখানায় নেমেছিল জনৈকা এমা ড্রাপা-র কফিন। চুঁচুড়ার ওলন্দাজ শাসনের ইতিহাস ঘুমিয়ে থাকা এই সমাধি দেখভালের দায়িত্ব ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের হাতে থাকলেও ডিসেম্বরের শেষ বিকেলে সে নিঃসঙ্গই। সমাজ বিরোধীদের দৌড়াত্মে ডাচ সিমেট্রি এখন সাধারণের অগম্য হয়ে উঠেছে। সন্ধ্যা নামলেই সেখানে নানারকম অসামাজিক কাজকর্ম চলে বলে অভিযোগ। আরও পড়ুন-Hanseswari Temple: ইতিকথায় হংসেশ্বরী মন্দির ও রাজা নৃসিংহদেব
সুস্যানা আন্না মারিয়া ভারকার্কের (Susanna anna maria varkark) সমাধি তৈরি হয়েছিল ১৮২৪ সালের পরে। ১৮২৪-এ ইন্দো ডাচ চুক্তির কারণে ওলন্দাজরা হুগলি চুচুঁড়ার ব্যবসা বাণিজ্য কুঠি সবকিছু ইংরেজদের ছেড়ে দিয়ে বাটাভিয়ায় ফিরে যায়। ১৮৩৩ সাল নাগাদ ইংরেজদের আয়েশবাগের দিকে নজর পড়ে। ততদিনে সুস্যানা আন্না মারিয়ার সমাধিতে তৈরি হয়েছে স্মৃতিসৌধ। তবে আয়েশবাগের জমিতে কবরখানা হয়নি। ইংরেজরা সেই জমি বিক্রি করে দেয়। যদিও দেশ স্বাধীন হওয়ার অনেকগুলো বছর পরে রাজ্যের মন্ত্রী নরেন দে আয়েশবাগের জমি পুনরুদ্ধারের ব্যবস্থা করেছিলেন।
এখন সুস্যানা আন্না মারিয়ার (Susanna anna maria varkark) সাধের আয়েশবাগের নাম এখন নন্দীপুকুর। সরকারি অধীনে থাকা ওই জমিতে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের নামে একটি স্টেডিয়াম তৈরি হচ্ছে। সুস্যানা আন্না মারিয়ার সমাধি দেখতে হলে যদি চন্দননগর থেকে আসেন তাহলে জিটি রোড ধরে চুঁচুড়া আসার পথে তালডাঙা মোড়ের পরেই ডান হাতে দেখবেন সেই স্মৃতিসৌধ। একইভাবে চুঁচুড়ার খাদিনা মোড় থেকে জিটিরোড ধরে চন্দননগর যাওয়ার পথে বাঁ হাতে পড়বে সুস্যানা আন্না মারিয়ার সমাধি (Susanna anna maria varkark)। প্রায় ৩০০ বছরের ইতিহাস বুকে নিয়ে সবুজ প্রান্তরে একাকি দিনযাপন করছে।