হুগলি জেলার বাঁশবেড়িয়াতে রয়েছে ১৩টি চূড়া বিশিষ্ট হংসেশ্বরী মন্দির(Hanseswari Temple)। রাজা রামেশ্বর দত্ত রায়ের উত্তর পুরুষ তথা প্রপৌত্র নৃসিংহদেব (Nrisingha Deb Roy) এই হংসেশ্বরী মন্দির নির্মাণ শুরু করিয়েছিলেন। তবে তাঁর জীবদ্দশায় মন্দির সম্পূর্ণ হয়নি। নৃসিংহদেবের প্রয়াণের পর তাঁর ছোটরানি শংকরী হংসেশ্বরী মন্দিরের(Hanseswari Temple)নির্মাণ সম্পূর্ণ করান।
রামেশ্বর দত্ত রায় নির্মিত অনন্ত বাসুদেবের মন্দির লাগোয়া এই হংসেশ্বরী মন্দিরের (Hanseswari Temple)অবস্থান। নৃসিংহদেবের (Nrisingha Deb Roy) জন্মের তিনমাস আগেই অকালে চলে গেলেন রাজা গোবিন্দদেব। বাংলা বিহার ওড়িশায় তখন নবাবি শাসন চলছে। এমতাবস্থায় বংশবাটীর রাজহীন রাজপাট ঘোর সংকটে। নিয়মানুসারে মুর্শিদাবাদের নবাব আলিবর্দী খাঁ গোবিন্দদেবের সম্পত্তি আশপাশের ছোটোখাটো জমিদারদের মধ্যে ভাগ করে দিলেন।
অকালে বিধবা হংসেশ্বরীদেবী (Hanseswari Temple)। বেশ কষ্ট করেই বড় করলেন ছেলে নৃসিংহদেবকে (Nrisingha Deb Roy)। পলাশির যুদ্ধের পর বাংলার নবাবি শাসনের অবলুপ্তি ঘটে। বাংলায় তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্ব। এদিকে নৃসিংহদেব মাকে কথা দিয়েছিলেন বাবা গোবিন্দদেবের সম্পত্তি তিনি পুনরুদ্ধার করবেন। সেই মতো বাংলার প্রথম গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের কাছে নিজের জমিদারি ফিরে পাওয়ার আবেদন করেন নৃসিংহদেব। এভাবেই ২৪ পরগনার জমিদারির কিছুটা ফিরে পান।
এরপর বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রশাসনিক পদের প্রধান হয়ে এলেন লর্ড কর্ণওয়ালিস। পিতৃ সম্পত্তি ফিরে পেতে কর্ণওয়ালিসের শরণাপন্ন হন নৃসিংহদেব (Nrisingha Deb Roy) । জানতে পারেন, হারানো সম্পত্তি ফিরে পেতে হলে লন্ডনের বোর্ড অফ ডিরেক্টর্সে আবেদন করতে হবে। যার খরচ ছিল সেই সময়ে সাত লক্ষ টাকা। একে নিদারুণ অর্থকষ্ট, তায় মাকে দেওয়া কথা। রাজকোষে তখন চার লক্ষ টাকা রয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে কাশীতে চলে যান নৃসিংহদেব (Nrisingha Deb Roy) । সাতলক্ষ টাকা হলেই তিনি বাড়িতে ফিরবেন। এদিকে বড়রাণী মহামায়া রাজা নৃসিংহদেবকে না জানিয়েই নিজের অলঙ্কার বিক্রি করে সাতলক্ষ টাকা জোগাড় করে ফেলেন। তখন পর্যন্ত হংসেশ্বরী মন্দির (Hanseswari Temple)। নিয়ে কোনও পরিকল্পনা ছিল না।
Hanseswari Temple: হংসেশ্বরীর মন্দির নির্মাণের ইতিহাস
কাশিতে রাজা নৃসিংহদেব (Nrisingha Deb Roy) প্রায় সন্ন্যাস জীবন যাপন করছেন। সঙ্গে চলছে তন্ত্রসাধনার কাজ। পিতৃ সম্পত্তি কী করে ফিরে পাওয়া যায় এমন চিন্তাও মাথা থেক সরাতে পারছেন না নৃসিংহদেব। এদিকে কএকদিন ঘুমের মধ্যে জগজ্জননীর দর্শন পেলেন তিনি। মা হংসেশ্বরীদেবীকেই (Hanseswari Temple)। যেন দেখলেন নৃসিংহদেব। সম্পত্তি উদ্ধারের কথা তাঁর মাথায় এল না।
পরের দিন সকালেই ঠিক করলেন বংশবাটীতে ফিরবেন। আর রাজকোষের জমা অর্থ দিয়ে তৈরি করাবেন মাতৃমন্দির, দেবী হংসেশ্বরীর মন্দির Hanseswari Temple)। এরপর চুনার থেকে সাত নৌকো চুনাপাথর নিয়ে ফিরলেন বংশবাটীতে। ১৭৯৯ সালের এক পুণ্যলগ্নে শুরু হল মন্দির তৈরির কাজ। সেদিন ভাগ্যদেবী অলক্ষ্যেই হেসেছিলেন।
মন্দির । অসমাপ্ত রেখে ১৮০২ সালে পরলোকে যাত্রা করলেন রাজা নৃসিংহদেব (Nrisingha Deb Roy)। এরপর রানি শংকরী একা হাতে স্বামীর অসমাপ্ত কাজ সম্পূর্ণ করেন। নানা প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ১৮১৪ সালে হংসেশ্বরীর মন্দির (Hanseswari Temple)। তৈরি হল। শোনা যায়, মন্দিরের নান্দনিক কারুকাজের জন্য রাজস্থানের জয়পুর থেকে আনা হয়েছিল শিল্পীদের। বাংলার অন্য কোনও মন্দিরের স্থাপত্যের সঙ্গে হংসেশ্বরী মন্দিরকে । মেলানো যাবে না।
Hanseswari Temple: মন্দিরের নির্মাণ শৈলী
উত্তর রাজস্থানের শেখাওয়াতি হাভেলি নির্মান শৈলীর নিদর্শন এই হংসেশ্বরীর মন্দির (Hanseswari Temple)। সেই সময় মন্দিরটি নির্মাণ করতে খরচ হয়েছিল ৫ লক্ষ টাকা। দক্ষিণমুখী হংসেশ্বরী মন্দিরের। উচ্চতা ৭০ ফুট। তান্ত্রিক মতে নির্মিত এই মন্দিরে আট কোণে আটটি মধ্যভাগে চারটি ও কেন্দ্রে একটি। সবমিলিয়ে মোট ১৩টি রত্ন বা চূড়া রয়েছে। মোচাকৃতি প্রতিটি রত্ন প্রস্ফুটিত পদ্ম যেন।
তন্ত্র মতে মানুষের দেহে ইড়া, পিঙ্গলা, বজ্রাক্ষ, সুষুম্না ও চিত্রিণী সহ মোট পাঁচটি প্রধান নাড়ী রয়েছে। এই পাঁচ নাড়ীই হংসেশ্বরী মন্দিরের (Hanseswari Temple)। পাঁচতলা। দেবী প্রতিমাটি নীলবর্ণের। দেবীর বামহাতে খড়গ ও নরমুন্ড, এবং ডানহাতে অভয়মুদ্রা ও শঙ্খ। দেবীর প্রধান বাৎসরিক পুজো হয় কার্ত্তিক অমাবাস্যায় দীপান্বিতা তিথিতে। বছরে ৩৬৪ দিন দেবীর শান্তমূর্তি, কিন্তু দীপান্বিতা অমাবস্যার একটি রাতের জন্য দেবীর এলোকেশী রূপ।
সেদিন সন্ধ্যারতির পর দেবীর মুখে পরিয়ে দেওয়া হয় রূপোর মুখোশ ও সোনার জিভ। ফুল-অলঙ্কারে সেদিন দেবীর অঙ্গে রাজবেশ। বছরের এই একটি দিন দেবী হংসেশ্বরীর । তান্ত্রিক মতে পুজো হয়।
এমনিতে হংসেশ্বরী মন্দিরে (Hanseswari Temple)। নিত্যপুজো ও ভোগ নিবেদনের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রত্যেকটি অমাবস্যা ও স্নানযাত্রায় দেবীর বিশেষ পুজো হয়। ১৮১৪ সালে নৃসিংহদেবের অবর্তমানে রানি শঙ্করীর তত্ত্বাবধানে হংসেশ্বরীর মন্দির । পূর্ণ রূপ পায়।
এরপর ১৮২০ সাল নাগাদ দেবীর অলঙ্কার চুরি যায়। পরবর্তিতে মন্দিরের (Hanseswari Temple)। দায়িত্ব ভারতীয় পূরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের অধীনে চলে যায়। দেবীমূর্তি, মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ, গয়নাগাটি দেখভালের দায়িত্ব সেই সময় থেকে এখনও রাজবাড়ির সদস্যদের উপরেই রয়েছে।
নিমকাঠে নির্মিত হংসেশ্বরী দেবীর (Hanseswari Temple)। মূর্তির অঙ্গরাগ হয় প্রতি ১২ বছর অন্তর। সেদিনের বংশবাটী আর আজকের বাঁশবেড়িয়াতে অনেক তফাত। ব্রিটিশ নেই, নেই বাংলার জমিদারদের প্রতাপও। আর রাজত্ব তো কতকাল হয়ে গেল অতীত হয়েছে। তবে আজকের বাঁশবেড়িয়ায় রাজা নৃসিংহদেবের অষ্টম বংশধরেরা বর্তমান। মন্দির। লাগোয়া এলাকাতে রয়েছে সেই বাড়ি।
Hanseswari Temple: হংসেশ্বরী মন্দির ও সেদিনের রাজপাট
পুরোনো রাজবাড়ি এখন শুধু ইতিহাস। এই মুহূর্তে রাজ নৃসিংহদেবের (Nrisingha Deb Roy) উত্তরাধিকারীদের ছোট তরফের বাসভবনটি বহাল তবিয়তেই রয়েছে। তবে মেজো ও বড় তরফের বাড়ি শুধু পলেস্তারা খসে পড়ে ইটের দেওয়াল পরিণত হয়েছে। বড় তরফের বাড়ির একাংশে এখন স্থানীয়দের কেউ কেউ আস্তানা করে নিয়েছেন। বাকিটা অব্যবহারে পরিত্যক্ত।
হংসেশ্বরী মন্দিরে (Hanseswari Temple)। যেতে হলে রাজবাড়ির চত্বরের প্রবেশদ্বার আপনার সামনেই পড়বে। শত ওঠাপড়ার সাক্ষী ষোড়শ শতকে তৈরি বাঁশবেড়িয়ার রাজবাড়ির তোড়নের মাথা এখনও সোজা। তবে ভিতরে পা বাড়ালে নহবত খানার ধ্বংসাবশেষ চোখে পড়বে। পায়ে পায়ে যেন ইতিহাস উঁকি মারছে, ভগ্নপ্রায় ইটের পাঁজায় কত অব্যক্ত কথা। সেদিনের সেসব রাজকীয় মুহূর্তের বোবা কাহিনী বহন করে চলেছে এই নির্মাণ।
শোনা যায়, রাজা রামেশ্বর দত্ত রায়ের বিশ্বস্ত পাঠান সেনারা এই রাজবাড়ির নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন। সেইসব সেনাদের বংশধরেরা এখনও এখানেই বসবাস করেন। সপ্তাহান্তের ছুটিতে ইতিহাসের সাক্ষী হতে চান? তাহলে চলে আসুন হুগলি জেলার বাঁশবেড়িয়াতে। বাংলার প্রাচীন ইতিহাস ও মন্দির স্থাপত্যের সাহচর্যে দিনটা বেশ কাটবে। আরও পড়ুন-Bansberia: চলুন যাই দেখে আসি, বাঁশবেড়িয়ার ৩৪১ বছরের অনন্ত বাসুদেব মন্দির
সড়ক পথে হংসেশ্বরী মন্দিরে (Hanseswari Temple)। আসতে চান? কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে ধরে সেখানে ঈশ্বর গুপ্ত সেতুতে চলে আসুন। তারপর গঙ্গা পেরিয়ে বাঁদিকে পাবেন হংসেশ্বরী মন্দিরে যাওয়ার রাস্তা। বালি থেকে দিল্লি রোড ধরে চলে আসুন মগরা। সেখান থেকে ৬ নম্বর রাজ্য সড়ক যোগে বাঁশবেড়িয়ার ঝুলনিয়া মোড়ে আসুন। তারপর সামনেই পেয়ে যাবেন কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে। ঈশ্বর গুপ্ত সেতুতে ওঠার ঠিক আগে ডানদিকেই আপনার সেদিনের গন্তব্য হংসেশ্বরী মন্দিরে (Hanseswari Temple)। যাওয়ার রাস্তা।
ট্রেনে চড়ে হংসেশ্বরী মন্দিরে (Hanseswari Temple)। আসতে চাইলে ব্যান্ডেল স্টেশনে নেমে সেখান থেকে অটো টোটো পেয়ে যাবেন। একইভাবে হাওড়া থেকে কাটোয়া লাইনের ট্রেন ধরে চলে আসুন বাঁশবেড়িয়া স্টেশনে। সেখান থেকেও হংসেশ্বরী মন্দিরে । যাওয়ার অটো টোটো পাবেন।
এছাড়া শিয়ালদা মেন শাখার যেকোনও ট্রেন ধরে নৈহাটিতে নেমে। স্টিমার যোগে গঙ্গা পেরিয়ে চলে আসুন চুঁচুড়ায়। এখান থেকেও অটো বা টোটোতে পৌঁছে যেতে পারেন হংসেশ্বরীর মন্দিরে (Hanseswari Temple)। ।