ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে কলকাতার বসুবাড়ির অবদান অনস্বীকার্য। শুধু নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুই নন, মেজদাদা শরৎচন্দ্র বসু বাঙালির গর্ব। পারিবারিক কারণে সামনে থেকে বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ না দিলেও ছোটভাই সুভাষকে সবসময় দেশের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে গিয়েছেন। একেবারে ফাদার ফিগার বলতে যা বোঝায় শরৎচন্দ্র বসু নেতাজির কাছে তাইই ছিলেন। কৈশোর যৌবনে দাদা শরৎ বসুর সহযোগিতা পেয়েছেন। আর যেসময় ব্রিটিশ রাজের চোখে ভয়ঙ্কর প্রতিপন্ন হয়ে গেলেন সেই সময় সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সাহায্য করেন আদরের ভাইপো শিশির বসু। মেজদাদা শরৎচন্দ্র বসুর ছেলে। এলগিন রোডের বাড়িতে ব্রিটিশ পুলিশ নেতাজিকে নজরবন্দি করে রেখেছিল, এ তথ্য আজ সকলেরই জানা। সেই নজরবন্দি অবস্থাতেই একদিন উধাও হয়ে গেলেন সুভাষ বসু। সৌজন্যে ভাইপো শিশির বসু। কাকাকে ব্রিটিশ পুলিশের রাঙা চোখ এড়িয়ে নিরাপদ দূরত্বে সেদিন পৌঁছে দিয়েছিলেন শিশির বসু।
এত পুরনো অথচ সবসময়ের জন্যই প্রাসঙ্গিক বিষয় কেন আলোচনা হচ্ছে, তানিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। আলোচনার কারণ শ্রীমতী কৃষ্ণা বসু, তিনি শিশির বসুর স্ত্রী। আজ চলে গেলেন কৃষ্ণা বসু। শনিবার সকাল দশটা বেজে ২০ মিনিটে ইএমবাইপাস লাগোয়া একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর। ছেলে সুগত বসু ও সুমন্ত্র বসু শেষ সময়ে মায়ের পাশেই ছিলেন। বয়সে স্বামী শিশির বসুর থেকে ১০ বছরের ছোট ছিলেন কৃষ্ণা বসু। ১৯৩০ সালের ২৬ ডিসেম্বর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ করেছেন। সিটি কলেজে ৪০ বছর ইংরেজির অধ্যাপিকা ছিলেন। আট বছর ধরে সামলেছেন অধ্যক্ষের দায়িত্ব। ঢাকার বাসিন্দা চারুচন্দ্র চৌধুরী ও ছায়াদেবী চৌধুরাণীর মেয়ে কৃষ্ণার সঙ্গে কলকাতার বসু পরিবারের ছেলে বিশিষ্ট চিকিৎসক শিশির বসুর বিয়ে ঠিক হয়। সালটা ১৯৫৫, ওই বছরের ৯ ডিসেম্বর চারহাত এক হয়ে যায়। তারপর থেকে কলকাতাই কৃষ্ণা বসুর ধ্যানজ্ঞান হয়ে ওঠে। যদিও অনেক আগেই এমএ পড়তে ঢাকা থেকে কলকাতায় চলে এসেছিলেন কৃষ্ণা চৌধুরী।
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কোল আলো করে জন্ম নেয় শরৎ বসুর বড় নাতি, নাম রাখা হল সুগত। সুগত বসু মায়ের মতোই যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল সাংসদ ছিলেন। এরপর মেয়ে শর্মিলা ও ছোটছেলে সুমন্ত্র বসুর জন্ম হল। শিক্ষাবিদ রাজনীতিবিদ সাহিত্যিক কৃষ্ণা বসু সকলের কাছেই দারুণ আদরণীয়। তিনি তো বটগাছের মতো ছিলেন। তাঁর সঙ্গে সমাজ সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা করে স্বস্তি পেতেন অমর্ত্য সেন। সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় সেরা বাঙালির পুরস্কার নিয়েছিলেন কৃষ্ণা বসুর হাত থেকে। আরও পড়ুন-স্মৃতিটুকু থাক…
তাঁর মৃত্যুতে একটা যুগের অবসান হল। বসুবাড়ি নিয়ে বাঙালির কৌতূহলের শেষ নেই। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু যে কী ছিলেন তা আজও সঠিকভাবে মূল্যায়ন হয়নি। ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে বঙ্গসন্তানের এই স্বাধীনতা যুদ্ধ কালে কালে বিশ্বজুড়ে আলোচিত হবে। তিনি তো অধরা, মিথ হয়ে গিয়েছেন। সেই যে অন্তর্ধানের পথে গেলেন, তারপর থেকেই সারা বিশ্ব তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। রহস্যে মোড়া মানুষটির স্বজনদের নিয়েও বাঙালির আবেগ চিরন্তন। ভাইপো শিশির বসুর কাছের মানুষ ছিলেন ছোটকাকা। তাইতো ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকেও ছাড়েননি, প্রেসিডেন্সি জেল, লালকেল্লা, লাহোরের কেল্লা কোথায় না কোথায় তাঁকে বন্দি হতে হয়েছে। আসলে বসুবাড়ির সদস্যদের বুদ্ধিকে ভয় পেত ইংরেজ শাসক। ব্রিটিশ চলে গিয়েছে দেশ স্বাধীন হয়েছে। একটু একটু করে সময়ের প্রলেপে স্বাধীনতা ইতিহাসের আন্দোলনে ধুলো পড়েছে। বছর ঘুরে শুধু ১৫ আগস্ট, ২ অক্টোবর ২৩ জানুয়ারি এলে, ক্যালেন্ডারের লালদাগ মনে করিয়ে দেয় এঁরা ছিলেন। আরও পড়ুন-একটা বৃষ্টি দিন ও ভাল-বাসার নবনীতা
তেমনই কৃষ্ণা বসুকে দেখলেও তেমন অনুভূতি হত। সাংবাদিকতার সূত্রে বেশ কয়েকবার সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছে। ব্যক্তিগত স্তরে আলাপ থাকলেও বয়সের ভারে তেমন মনে রাখতে পারতেন না। দেখা হলে পরিচয় দিতে হত, চিনতে পারলেই মৃদু হেসে কুশল জিজ্ঞাসা করতেন। সামনে থেকে দেখলে পরম শান্তিতে ভরে যেত মন, ব্যক্তিত্ব, সৌন্দর্য, শিক্ষা ও রাজনীতির এমন অপূর্ব মিশেল খুব একটা চোখে পড়ে না। স্বামী শিশির কুমার বসুর সঙ্গে তাঁর প্রেমের বিয়ে। কাকা নেতাজির গল্প তো হামেশাই শুনতেন স্বামীর মুখে। নেতাজিকে ছুঁয়ে থাকার মানুষগুলো আগেই চলে গেছেন। কৃষ্ণা বসুর প্রয়াণের সঙ্গে সঙ্গেই অন্তরালে চলে গেল একটা যুগ।
এলগিন রোডের বসুবাড়িতে বিষন্নতার সুর, প্রয়াত কৃষ্ণা বসু
Facebook Comments Box