প্রয়াত প্রণব মুখোপাধ্যায় (Pranab Mukherjee Dies)। মৃত্যুর সঙ্গে টানা ২১ দিনের পাঞ্জা লড়াইয়ের ইতি। ৩১ আগস্ট সন্ধ্যায় পৃথিবী ছেড়ে অমৃতলোকে যাত্রা করলেন কীর্ণাহারের ছোট্ট খাট্টো চেহারার বুদ্ধিদীপ্ত মানুষটি। বীরভূমের এই অখ্যাত গ্রাম যাঁর আলোয় আলোকিত ছিল এতদিন, ভাদ্র সন্ধ্যায় সেখানে আজ দুঃখের পাহাড় নেমে এসেছে। ভারতীয় রাজনীতির আপাদমস্তক ভদ্রলোক বলতে এই মানুষটিকেই বোঝায়। নিরন্তর চিৎকার, বেলাগাম মন্তব্য না করেও রাজনীতিতে শুধু টিকে থাকাই নয়, পরম যত্নে দেশের উন্নতিসাধনে চাণক্যের ভূমিকা নিয়েছেন বারবার। বেশকিছু দিন আগেও কেন্দ্রের জনবিরোধী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তাঁর সংযত মন্তব্য বর্তমান রাজনৈতিক পরিধিকে স্মরণ করাবে।
গত ৯ আগস্ট রাতে দিল্লির রাজাজি মার্গের বাড়ির বাথরুমে অচৈতন্য হয়ে পড়ে যান প্রণব মুখোপাধ্যায় (Pranab Mukherjee Dies)। পরের দিনই তাঁকে দিল্লির আর্মি রিসার্চ অ্যান্ড রেফারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকরা জানান, পড়ে গিয়ে মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়েছেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি। মাথায় রক্তের ক্লট জমাট বেঁধে আছে। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তা সরাতে হবে। সেই সময় প্রণববাবুর করোনাভাইরাস টেস্টও করা হয়। রিপোর্ট এলে জানা যায় কোভিডে আক্রান্ত এই প্রবীণ রাজনীতিক। আরও পড়ুন-Dr Sivaramakrishna Iyer Padmavati: প্রয়াত ভারতের হৃদরোগের চিকিৎসার গডমাদার ডাক্তার শিবরামাকৃষ্ণা আইয়ার পদ্মাবতী
Pranab Mukherjee Dies, করোনা থাবা গেড়েছিল প্রণববাবুর শরীরে
এর পর প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির টুইটার হ্যান্ডল থেকে জানানো হয় করোনা আক্রান্ত প্রণব মুখোপাধ্যায় (Pranab Mukherjee Dies)। প্রণব মুখোপাধ্যায়। এমনকী শেষ কয়েকদিনে যে বা যাঁরা তাঁর সংস্পর্শে এসেছেন তাঁদের কোয়ারেন্টাইনে থাকার পরামর্শও দেওয়া হয়। তারপর হয় মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার। না ভারতীয় অর্থনীতির চাণক্যের আর জ্ঞান ফেরেনি। অস্ত্রোপচারের পরেই কোমায় চলে যান প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি। দিল্লির সেনা হাসপাতালের তরফে মেডিক্যাল বুলেটিনে সেই খবর প্রকাশ পেতেই পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে প্রণব অনুরাগীরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তাঁর আরোগ্য কামনায় রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে শুরু হয় পুজো, যজ্ঞ, নামাজ, দোয়া। জন্মভূমি কীর্ণাহারেও এর ব্যাতিক্রম হয়নি।
তবে দিন যত এগিয়েছে ততই কোমাচ্ছন্ন হয়েছেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি। সম্প্রতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের (Pranab Mukherjee Dies) মৃত্যুর গুজবও রটে যায়। আচমকা এই দুঃসংবাদে কিছুটা বিহ্বল হয়ে পড়লেও তা সামলে নিয়ে ছেলে অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় টুইটারে ক্ষোভ উগরে দিয়ে লেখেন, ভারতীয় মিডিয়া ভুয়ো খবরের কারখানা হয়ে উঠেছে। মেয়ে শর্মিষ্ঠাও সাংবাদিকদের একহাত নেন। তিনি টুইটে রীতিমতো অনুরোধ করেন, বার বার বাবার খবর জানতে চেয়ে যেন তাঁর ফোন নম্বর এনগেজ করে রাখা না হয়। কেননা হাসপাতালের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতে হচ্ছে নিয়মিত। আরও পড়ুন-Rituparno Ghosh: ঋতুপর্ণ ঘোষ ও এক ঋতু-ময় চিত্রকল্প
Pranab Mukherjee Dies, ছেলের কাছে কাঁঠাল খেতে চেয়েছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়
এই দুর্ঘটনার মাস খানেক আগেই কাঁঠাল খেতে চেয়েছিলেন অশীতিপর প্রণব মুখোপাধ্যায় (Pranab Mukherjee Dies)। সেই সময় কলকাতায় ছিলেন ছেলে অভিজিৎ। বাবার আবদার শুনে গ্রাম থেকে কাঁঠাল আনিয়ে তা দিল্লিতে পাঠানোর বন্দোবস্তও করেন তিনি। এদিকে ফুসফুসে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় মাঝের কয়েকদিন ভেন্টিলেশনেও ঠিকমতো সাড়া দিচ্ছিলেন না প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি। তবে শনিবার থেকে তাঁর শারীরিক অবস্থার উন্নতি হতে থাকে। যদিও তাঁকে ভেন্টিলেশন সাপোর্টেই রাখা হয়েছিল। রবিবার বিকেলের বাবার শারীরিক উন্নতির খবর টুইটে জানান প্রাক্তন সাংসদ অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়। তবে রাত থেকে ফের অসুস্থতা বাড়তে থাকে।
With great sadness, the nation receives the news of the unfortunate demise of our former President Shri Pranab Mukherjee.
I join the country in paying homage to him.
My deepest condolences to the bereaved family and friends. pic.twitter.com/zyouvsmb3V
— Rahul Gandhi (@RahulGandhi) August 31, 2020
প্রণব মুখোপাধ্যায়ের (Pranab Mukherjee Dies) ফুসফুসের সংক্রমণ ছড়িয়ে যাওয়ায় বিপদ বাড়তে থাকে। তিনি সেপটিক শকে চলে যান। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির শারীরিক অবস্থা উদ্বেগজনক হতেই মেডিক্যাল বুলেটিনে সেনা হাসপাতালের চিকিৎসকরা তা প্রকাশ করেন। ছেলে অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় টুইট বার্তায় বাবার মৃত্যুর খবর দিয়ে লেখেন, “দিল্লির সেনা হাসপাতালের চিকিৎসকদের সমস্ত প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে আমারা বাবা শ্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের (Pranab Mukherjee Dies) জীবনাবসান হয়েছে। হাসপাতালের চিকিৎসক, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষজন যাঁরা বাবার জন্য দোয়া চেয়েছেন প্রার্থনা করেছেন সবাইকে আমার ধন্যবাদ জানাই।” আরও পড়ুন-এলগিন রোডের বসুবাড়িতে বিষন্নতার সুর, প্রয়াত কৃষ্ণা বসু
With a Heavy Heart , this is to inform you that my father Shri #PranabMukherjee has just passed away inspite of the best efforts of Doctors of RR Hospital & prayers ,duas & prarthanas from people throughout India !
I thank all of You 🙏— Abhijit Mukherjee (@ABHIJIT_LS) August 31, 2020
১৯৩৫-এর ১১ ডিসেম্বর প্রণব মুখোপাধ্যায়ের (Pranab Mukherjee Dies) জন্ম হয়। সোমবার বিকেল পাঁচটা বেজে ৪৬ মিনিটে ৮৪ বছর বয়সে দিল্লির আর্মি রিসার্চ অ্যান্ড রেফারেল হসপাতালে নিভে গেল তাঁর জীবন প্রদীপ। রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন স্ত্রী বিয়োগের যন্ত্রণা পেতে হয়েছে তাঁকে। ২০১৫ সালের ১৮ আগস্ট প্রয়াত হন স্ত্রী শুভ্রা মুখোপাধ্যায়। ছেলে অভিজিৎ কংগ্রেসের প্রাক্তন সাংসদ। আর মেয়ে শর্মিষ্ঠা মুখার্জি দিল্লি কংগ্রেসের মুখপাত্র। গত ২০১২-র ২৫ জুলাই রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ নেন প্রণববাবু। ২০১৭-র ২৫ জুলাই পর্যন্ত ছিলেন ওই পদে। ২০১৯ সালে ভারতের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ‘ভারতরত্ন’ পান কীর্ণাহারের ভূমিপুত্র। আরও পড়ুন-একটা বৃষ্টি দিন ও ভাল-বাসার নবনীতা
Pranab Mukherjee Dies, রাষ্ট্রপতি ভবনে একবার মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিলেন তিনি
প্রণব মুখোপাধ্যায় (Pranab Mukherjee Dies) দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থতায় ভুগছিলেন। প্রায় ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ডায়াবেটিস তাঁকে কষ্ট দিয়ে যাচ্ছিল। রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন ২০১৪ সালে হৃদরোগ তাঁর শরীরে থাবা বসায়। রাষ্ট্রপতি ভবনের লাইব্রেরি থেকে খেতে যাওয়ার পথে মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। আশপাশে থাকা নিরাপত্তারক্ষীরাই তাঁর পতন আটকে দেন। সেই সময় থেকেই বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ নরেশ ত্রেহানের চিকিৎসাধীন ছিলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি।
কীর্ণাহারের থেকে দেশের অর্থনীতির পটভূমি বদলে দিতে এসেছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায় (Pranab Mukherjee Dies)। অর্থনীতির অধ্যাপক থেকে দেশের ২ বারের অর্থমন্ত্রী। একবার যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মসনদে ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন। আর একবার মনমোহন সিং যখন প্রধানমন্ত্রী হন। নেহরু তনয়া মিস্টার ডিপেন্ডেবলের উপরে ভরসা করতেন। তাই প্রথম ইউপিএ সরকারের সময় সোনিয়া গান্ধী প্রণববাবুকেই ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আসনের জন্য বেছে নিয়েছিলেন। তবে রাজনীতির শক্ত কাঠামোর সঙ্গে বুদ্ধি দিয়ে লড়লেও এক দিকে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ এবং অস্ত্রোপচার, তার উপর করোনা সংক্রমণ— জোড়া ধাক্কা সামলাতে পারলেন না তিনি। হার মানতে হল চাণক্যকে। একই সঙ্গে প্রণববাবুর প্রয়াণে ভারতীয় রাজনীতিতে একটি যুগের অবসান হল।